ঢাকা সোমবার, ১২ মে ২০২৫ , ২৮ বৈশাখ ১৪৩২ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

শূন্য থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক আরাভ খান

জাতীয়

আমাদের বার্তা প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৭:০৬, ১৭ মার্চ ২০২৩

সর্বশেষ

শূন্য থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক আরাভ খান

নানা বিতর্কের মধ্যেও দুবাইয়ে উদ্বোধন হয়েছে পুলিশ পরিদর্শক খুনের মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলামের স্বর্ণের দোকান।

‘আরাভ জুয়েলার্স’ নামের ওই স্বর্ণের দোকানের লোগো তৈরিতেই খরচ হয়েছে ৪০ কোটি টাকা। দোকানটিতে রেকর্ড পরিমাণ স্বর্ণের মজুত করেছেন আরাভ। ঘোষণা দিয়েছেন পুরোনো সব ব্যবসায়ীর চেয়ে কম দামে স্বর্ণ বিক্রির। দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা টাওয়ারের ৬৫ তলায় কিনেছেন ফ্ল্যাট।

বিলাসবহুল শহর দুবাইয়ে আরও ৪-৫টি ফ্ল্যাট রয়েছে তার। বানিয়েছেন একটি সুইমিংপুল, বাগানসহ বড় ডুপ্লেক্স বাড়িও। হয়েছেন দুবাইয়ের একটি গোল্ড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। যুক্তরাষ্ট্রে ‘আরাভ জুয়েলার্স’-এর আরও একটি ব্রাঞ্চ উদ্বোধনের ঘোষণা দিয়েছেন।

অথচ শূন্য হাতে ঢাকায় এসেছিলেন ফেরিওয়ালা বাবার সন্তান আরাভ। খুন করে দেশ ত্যাগের পর ছিলেন ভারতের বস্তিতে। আর এখন হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গিয়েছেন। অথচ এই সম্পদের উৎস সম্পর্কে পরিষ্কার করে কিছু জানাতে পারেননি তিনি। তবে ফেসবুকে এক লাইভে এসে জানিয়েছেন, তার এসব কর্মকাণ্ডে পুলিশের সর্বোচ্চ এক কর্মকর্তার সহযোগিতার অভিযোগ সত্য নয়।

বুধবার ‘আরাভ জুয়েলার্স’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশ্বসেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানসহ দেশের অনেক তারকা উপস্থিত ছিলেন। তদন্তের স্বার্থে ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত সাকিবসহ অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

বিষয়টি নিয়ে সারা দেশে যখন বিতর্ক চলছে, তখন আরাভ খান ফেসবুকে এক লাইভে হত্যাকাণ্ডে জড়িত না থাকার দাবি করেছেন। এ অবস্থায় ডিবি জানিয়েছে, ইন্টারপোলের মাধ্যমে আরাভকে দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এদিকে সমালোচনার মধ্যে স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন আয়োজনে অংশ নেওয়ায় এবং অতিথি হয়ে বাসায় যাওয়ায় সাকিবের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন আরাভ।

তবে সাকিব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ শেষে বৃহস্পতিবার সকালে দেশে ফিরেছেন বলে জানা গেছে। এর মধ্যে আরাভ ঘোষণা দিয়েছেন ৬৪ জেলায় একটি করে মসজিদ নির্মাণের। এ নিয়ে তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বইছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। এলাকায় সোহাগ মোল্লা হিসাবে পরিচিত আরাভ দিনমজুরের ছেলে হয়েও কীভাবে এত টাকার মালিক বনে গেলেন, এ নিয়ে আলোচনা এখন সবার মুখে।

কোটালীপাড়া থানা জানিয়েছে, আরাভের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত থানায় ৯টি ওয়ারেন্ট এসেছে। তবে এতদিন এলাকায় তার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।

বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, আরাভ একজন পুলিশ ইনস্পেকটর হত্যা মামলার চাজশিটভুক্ত আসামি। দুঃখজনক যে মিডিয়ার মাধ্যমে সাকিবসহ অন্য তারকারা এটা জেনেও সেখানে হাজির হয়েছিলেন। আমরা অবগত করার পরও তারা দুবাই গিয়ে আরাভ খানের স্বর্ণের দোকান উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। এটা খুবই দুঃখজনক। এটা তারা কেন করেছেন, আমরা জানি না। তবে আমরা আমাদের মতো করে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার আইনগত ব্যবস্থা নেব।

যুগান্তরের গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, কোটালীপাড়ায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সোহাগ মোল্লা ওরফে আরাভ আশুতিয়া গ্রামের দিনমজুর মতিয়ার রহমান মোল্লার ছেলে। মতিয়ার একসময় বাগেরহাট জেলার চিতলমারী উপজেলায় ফেরি করে সিলভারের হাঁড়িপাতিল বিক্রি করতেন। এখানেই ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে সোহাগের জন্ম হয়।

২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে চিতলমারী সদরের একটি বিদ্যালয় থেকে সোহাগ এসএসসি পাশ করেন। দারিদ্র্যের কারণে এরপর আর তার লেখাপড়া হয়নি। চিতলমারী থেকে ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে ভাগ্যের অন্বেষণে তিনি ঢাকা চলে যান। ঢাকা গিয়ে নাম পরিবর্তন করে হয়ে যান মোল্লা আপন। প্রবেশ করেন অপরাধজগতে।

ঢাকায় পুলিশ হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের কারণে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় বেশ কয়েকটি মামলা হয়। এরপর পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে সোহাগ মোল্লা ওরফে মোল্লা আপন, ওরফে রবিউল ইসলাম রবি, ওরফে শেখ হৃদি, ওরফে আরাভ খান ভারতের কলকাতায় পালিয়ে যান। সেখান থেকে আরাভ খান চলে যান দুবাইয়ে।

আরাভ খানের দুবাইয়ে এই স্বর্ণের দোকান উদ্বোধনের খবর জানাজানি হলে এলাকায় আলোচনার ঝড় ওঠে। সবার মুখে মুখে একই প্রশ্ন-সোহাগ মোল্লা কীভাবে রাতারাতি এত টাকার মালিক বনে গেলেন? সরেজমিনে কথা হয় সোহাগের চাচাতো ভাই ফেরদৌস মোল্লার সঙ্গে। তিনিও সোহাগ ওরফে আরাভ খান অল্পদিনে এত টাকার মালিক হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেন। কয়েকদিন আগে সোহাগ তার দুই বোন ও মা-বাবাকে দুবাই নিয়ে গেছেন বলে জানিয়েছেন চাচাতো ভাই ফেরদৌস।

হিরণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাজাহারুল আলম পান্না বলেন, সোহাগ মোল্লা ওরফে আরাভ খান একই ব্যক্তি। আমার গ্রামেই তার বাড়ি। সে একটি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। গত পাঁচ-সাত বছর সে এলাকায় আসে না। হঠাৎ সে কীভাবে এত টাকার মালিক হলো, এটা আমাদের বোধগম্য নয়।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র ও আরাভের ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন, পরিদর্শক হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত ৮নং আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন কার্ডধারী। আছে কানাডিয়ান পাসপোর্ট। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে রবিউল ভারতের পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন। তার ভারতীয় পাসপোর্ট নং ইউ ৪৯৮৫৩৮৯।

ওই বছরের ২৮ জুলাই কলকাতা থেকে ইস্যু করা পাসপোর্টে রবিউলের নাম আরাভ খান হিসাবে উল্লেখ করা হয়। তার বাবার নাম জাকির খান এবং মা রেহানা বিবি খান বলে উল্লেখ করা হয়। পাসপোর্টের মেয়াদ ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জুলাই শেষ হবে। আরব আমিরাত সরকার ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ অক্টোবর তাকে রেসিডেন্ট পারমিট দেয়। আগামী বছরের ৩০ অক্টোবর এই পারমিটের মেয়াদ শেষ হবে।

জানা যায়, ভারতে গিয়ে পশ্চিম বঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগোনা জেলার উদয় সংঘ ক্লাবের পাশে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে ছিলেন আরাভ। খুনের মামলায় আসামি হওয়ার পর পালিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে ওঠেন কর্তাবাদ এলাকার নরেন্দ্রপুর বস্তিতে। অথচ এখন দুবাইয়ে বিলাসী জীবনযাপন করছেন তিনি। বস্তির জাকির হোসেনের বাড়িতে অবস্থান ছিল তার। অভিযোগ রয়েছে, জাকির ও তার স্ত্রী রেহানা বিবির সঙ্গে সখ্য গড়ে তাদের বাবা-মা বানিয়ে নিজের ও স্ত্রীর ভারতীয় পাসপোর্ট বানান আরাভ। তবে রেহানা বিবির দাবি, আধার কার্ড দিলেও পাসপোর্ট তৈরির বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।

যা বলছে ডিবি : গোয়েন্দা কর্মকর্তা মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, আমাদের পুলিশের একজন মেধাবী কর্মকর্তা ছিলেন পরিদর্শক মামুন। তাকে শুধু হত্যাই করেনি, তার লাশ যেন না পাওয়া যায়, সেজন্য কালীগঞ্জের জঙ্গলে ফেলে দিয়েছিল। এ ঘটনার পর মামলা হয়, যার তদন্ত করেছে ডিবি। হত্যা মামলায় আসামি আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলাম পালিয়ে গেলেও নকল একজন আসামি জেলখানায় দেয় সে।

পরে ডিবির তদন্তে নকল আসামির ঘটনা সামনে আসে। এর মধ্যে মূল আসামি দুবাইয়ে স্বর্ণের দোকানের মালিক রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান ভারতে পালিয়ে যায়। সেখান থেকে ভারতীয় পাসপোর্টে দুবাই যায়। তার বিরুদ্ধে ১২টি ওয়ারেন্ট রয়েছে। আরাভ খানই যে রবিউল, ডিবি কখন নিশ্চিত হয়েছে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যখন কোনো মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়, তখন সব আসামি কে কোথায় আছে, তা খোঁজখবর নেওয়া হয়।

আরাভ খানের বিভিন্ন ছবি প্রকাশ হয় এবং সাকিব আল হাসান টেলিভিশন ও ফেসবুকে ওই স্বর্ণের দোকান উদ্বোধনের বিজ্ঞাপন দিচ্ছিলেন। সবকিছু মিলেই আমরা তথ্য পাই আরাভ খানই পুলিশ খুনের মামলার আসামি রবিউল ইসলাম। খুনের পর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নাম ধারণ করেন রবিউল ইসলাম।

ক্রিকেটার সাকিব অথবা অন্য যারা গিয়েছেন দুবাইয়ে, ডিবি কারও সঙ্গে কথা বলেছেন কি না-এমন প্রশ্নের উত্তরে হারুন অর রশীদ বলেন, সাকিবসহ অন্যদেরও জানানো হয়েছে। জানানোর পরও তারা কেন পুলিশ খুনের মামলার আসামির ডাকে দুবাই গেলেন, এটা আমি জানি না।

লাইভে যা বললেন আরাভ : বৃহস্পতিবার ফেসবুক লাইভে এসে সমসাময়িক বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেন আরাভ খান। ২২ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের লাইভে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে হেল্প করে ফ্লাইট করে দিয়েছেন-এমন অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। আপনারা কি কখনো শুনেছেন একটা পুলিশ মার্ডার কেসে আরেকটা পুলিশ হেল্প করবে? আমার সঙ্গে যে ভাইদের নাম বলছে, তারা কোনোদিন কোনোকিছুতে আমার সঙ্গে জড়িত না। একটা মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে, সেটা স্বাভাবিক। আমি একজন ব্যবসায়ী হিসাবে আমার সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল।’

খুনে জড়িত নন দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমি জীবনে কাউকে একটা চড় মারিনি। যে কেস, সেটি সত্যি। কিন্তু আমি এর সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। আমার দোষ শুধু ওই অফিসটা আমার ছিল। আমার মনে কোনো দুর্বলতা নেই। কোর্টের রায়ের জন্য অপেক্ষা করেন। দেখেন আমি অপরাধী কি না। অপরাধী হলে আদালতই বলে দেবে। যদি আদালতের বিচারে আমি অপরাধী হই, তাহলে সাজা মাথা পেতে নেব। আমি এই মামলা মোকাবিলা করতে রাজি আছি। এমন না যে আমি লুকিয়ে যাব বা পালিয়ে যাব।

কখনো যাইওনি। এটা সত্যি, বাঁচার আশা সবাই করে। এখন বলছে, আমি এত টাকা নিয়ে বাংলাদেশ থেকে চলে এসেছি? আমি কী করেছি? আমি কি চাঁদাবাজি করেছি? কেউ বলতে পারবে না।’ ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা করতেন বলেও জানার আরাভ। তার কোম্পানির নাম ছিল আপন বিল্ডার্স।

তার পেছনে ব্যবসায়িক শত্রুরা লেগেছে উল্লেখ করে বলেন, আমি গোল্ড অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট হয়েছি। তখন ঘোষণা দিয়েছিলাম, সব দোকানের চেয়ে কমে ডিসকাউন্টে মাল (স্বর্ণ বিক্রি) দেব। আর আশপাশে ১০০ দোকান থাকলেও ক্রেতারা যেখানে ডিসকাউন্ট পাবে, সেখানেই তো যাবে। এতে অন্য ব্যবসায়ীরা ভয় পেয়ে এগুলো শুরু করেছে। এই ঘোষণাটা দিয়েই ভুল করেছিলাম। এ সময় সংবাদ প্রকাশের হুমকি দিয়ে একটি মাধ্যম থেকে তার কাছে পাঁচ কোটি টাকা দাবি করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

দেশে ফিরেছেন সাকিব : এদিকে দুবাই থেকে বৃহস্পতিবার সকালে দেশে ফিরেছেন সাকিব আল হাসান। তবে এখনো বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) দায়িত্বশীলরা এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করতে রাজি হননি। শনিবার আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম ওয়ানডে অনুষ্ঠিত হবে সিলেটের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। এজন্য সিলেট যাওয়ার কথা রয়েছে সাকিবেরও।

জনপ্রিয়