ঢাকা রোববার, ১১ মে ২০২৫ , ২৭ বৈশাখ ১৪৩২ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

‘মা’ ভালোবাসার অবিনাশী ছায়া

মতামত

গুরুদাস ঢালী, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০৮:০০, ১১ মে ২০২৫

সর্বশেষ

‘মা’ ভালোবাসার অবিনাশী ছায়া

‘আমাকে একটা শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটা সুন্দর জাতি উপহার দেবো’, ‘মা’ কথাটি ছোট্ট অতি, কিন্তু জেনো ভাই, ইহার চেয়ে নাম যে মধুর ত্রিভূবনে নাই’। মাকে নিয়ে এ রকম অগণিত শব্দ ব্যবহার করা যাবে কিন্তু এই ছোট্ট শব্দটি যতো সহজে উচ্চারণযোগ্য, এর গভীরতা ততোটাই অসীম।

প্রতিটি সন্তানের জীবনে মা হচ্ছেন প্রথম শিক্ষক, প্রথম ভালোবাসা আর প্রথম আশ্রয়। বিশ্ব মা দিবস আমাদের সেই চিরচেনা, চির নতুন ভালোবাসাটিকে আরো একবার স্মরণ করার সুযোগ দেয়। যদিও মাকে ভালোবাসার জন্য আলাদা দিনের প্রয়োজন পড়ে না। তারপরও এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমরা কতোটা ঋণী সেই মহীয়সীর কাছে যিনি নিঃস্বার্থভাবে জীবন উৎসর্গ করেছেন আমাদের জন্য।

মা একটি ছোট্ট শব্দ, কিন্তু এর মধ্যে লুকিয়ে আছে অসীম ভালোবাসা, ত্যাগ ও মমতার এক মহাসাগর। মা হচ্ছেন পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তি, যিনি নিজের সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে সন্তানের মুখে হাসি ফোটান। মা শুধু একটি সম্পর্ক নয়, তিনি একজন শিক্ষক, বন্ধু, পরিচারিকা ও জীবনের পথপ্রদর্শক। তার ভালোবাসা নিঃশর্ত, অকৃত্রিম ও চিরন্তন।

মাকে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাতে কোনো দিনক্ষণ প্রয়োজন হয়। মায়ের প্রতি প্রতিদিনই সন্তানের ভালোবাসা থাকে। জানেন কি? আজ থেকে বহু বছর আগে এভাবেই এক মেয়ে তার মায়ের জন্য প্রবর্তন করেছিলেন মা দিবস। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের আনা জারভিস নামের নারী মারা গেলে তার মেয়ে আনা মারিয়া রিভস জারভিস মায়ের কাজকে স্মরণীয় করে রাখতে সচেষ্ট হন।

তিনি তার সান ডে স্কুলে প্রথম এ দিনটি মাতৃদিবস হিসেবে পালন করেন। আনা জারভিস ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর ও ওহাইওর মাঝামাঝি ওয়েবস্টার জংশন এলাকার বাসিন্দা। তার মা অ্যান মেরি সারাজীবন অনাথদের সেবা করে জীবন কাটিয়েছেন। অনাথদের জন্য মেরির উৎসর্গিত জীবনের কথা অজানাই থেকে যায়। লোকচক্ষুর আড়ালে কাজ করা মেরিকে সম্মান দিতে চাইলেন তার মেয়ে আনা জারভিস। জারভিস নতুন এক উদ্যোগ নেন।

মা অ্যান মেরির মতো ছড়িয়ে থাকা সব মাকে স্বীকৃতি দিতে আনা জারভিস প্রচার শুরু করেন। সাত বছরের চেষ্টায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায় ‘মা দিবস’। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি রাজ্যে মা দিবস পালনের ঘোষণা দেয়া হয়।

ইউরোপ এবং যুক্তরাজ্যে ‘মাদারিং সানডে’ নামের এক অনুষ্ঠান পালন করা হতো, যা মূলত ছিলো মায়েদের সম্মান প্রদর্শনের জন্য। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় মাকে সম্মান জানাতে বিভিন্ন জাতি এমন অনেক আচার অনুষ্ঠান পালন করতো। তবে ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের ৮ মে মার্কিন কংগ্রেস মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে ‘মা’ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এভাবেই শুরু হয় মা দিবসের যাত্রা। এরই ধারাবাহিকতায় আমেরিকার পাশাপাশি মা দিবস এখন বাংলাদেশসহ অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, রাশিয়া ও জার্মানসহ শতাধিক দেশে মর্যাদার সঙ্গে দিবসটি পালিত হচ্ছে।

মা তার সমস্ত জীবন সন্তানের মঙ্গলের জন্য উৎসর্গ করেন। তার নিজের ইচ্ছা, স্বপ্ন, সুখ সবকিছুই সন্তানের পেছনে বিলিয়ে দেন। একটি শিশু যখন পৃথিবীতে আসে, মা নিজের ঘুম, খাওয়া, বিশ্রাম সবকিছু ত্যাগ করে শুধু সন্তানের যত্ন নেন। বড় হওয়ার পথে প্রতিটি পদক্ষেপে মা সন্তানের পাশে থাকেন।

জীবনের প্রতিটি সংকটে মা-ই হচ্ছেন প্রধান আশ্রয়স্থল। মায়ের ত্যাগের কোনো শেষ নেই। তিনি সন্তানের সুখের জন্য নিজের সুখ বিসর্জন দেন, সন্তানের স্বপ্ন পূরণের জন্য নিজের স্বপ্ন ভুলে যান। এমনকি সন্তান বড় হয়ে নিজের পথে চলে গেলেও মা তার জন্য প্রার্থনা করতে থাকেন, ভালোবাসা দিতে থাকেন।

মা হচ্ছেন সন্তানের প্রথম শিক্ষক। একটি শিশু মায়ের কাছ থেকেই প্রথম শেখে কথা বলা, হাঁটা, ভালো-মন্দের পার্থক্য বোঝা। মা-ই সন্তানকে নৈতিকতা, শিষ্টাচার ও মূল্যবোধ শেখান। তার আদর্শ ও আচরণ সন্তানের চরিত্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মায়ের শিক্ষা সারাজীবন সন্তানের সঙ্গে থাকে।

তিনি যেমন সন্তানকে সত্য বলতে শেখান, তেমনি অধ্যবসায়, সহনশীলতা ও দয়া প্রদর্শনেরও শিক্ষা দেন। বিশ্বের অনেক মহান ব্যক্তিত্বই তাদের সাফল্যের কৃতিত্ব মায়েদের দিয়েছেন। আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন, ‘আমি যা কিছু পেয়েছি, বা হতে পেরেছি, তার সবকিছুর জন্যই আমি আমার মায়ের কাছে ঋণী।’

মা শুধু সন্তানের জন্যই নন, সমাজের জন্যও অপরিহার্য। একজন মা পরিবারের ভিত্তি। তার হাতেই গড়ে ওঠে সুস্থ, শিক্ষিত ও নৈতিকতাসম্পন্ন প্রজন্ম। মায়েরা শুধু সন্তান লালন-পালনই করেন না, তারা সমাজের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেন।

একজন মা যখন শিক্ষিত ও সচেতন হন, তখন পুরো পরিবার ও সমাজ এগিয়ে যায়। তাই নারী শিক্ষা ও মায়েদের সম্মান প্রদর্শন সমাজের উন্নতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘স্ত্রীজাতিকে অবহেলা করিলে পৃথিবীতে কোনো মহৎ কাজ চিরস্থায়ী হইতে পারে না।’

মা আমাদের জন্য যা করেন, তা কোনোভাবেই পরিশোধ করা সম্ভব নয়। তবে আমাদের দায়িত্ব হলো মায়ের সম্মান করা, তার ভালোবাসার মূল্য দেয়া এবং তার যত্ন নেয়া। অনেক সময় বড় হয়ে সন্তানেরা ব্যস্ত জীবনে মায়ের প্রতি অবহেলা করে, যা কখনোই কাম্য নয়। মায়ের খুশি আমাদের খুশি। তার একটি হাসি আমাদের জীবনের সব দুঃখ মুছে দেয়। তাই মায়ের সেবা করা, তার কথা শোনা এবং তার ভালোবাসাকে সম্মান দেয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

প্রযুক্তির এই যুগে শিশুরা দিন দিন যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়ছে, পারিবারিক মূল্যবোধ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মা দিবসের মতো দিনগুলো যদি নতুন প্রজন্মকে শেখায় মা কেবল জন্মদাত্রী নন, তিনি আমাদের জীবনের মেরুদণ্ড, তাহলে এই দিনটি সার্থক। স্কুলে ‘মাকে চিঠি লেখা’, ‘মা দিবসের কবিতা আবৃতি’, ‘মা সম্পর্কে গল্প লেখা’ এমন আয়োজন শিশুদের মধ্যে ভালোবাসা ও মানবিকতা গড়ে তুলতে পারে।

আমাদের মতো আবেগপ্রবণ ও পারিবারিক বন্ধনে বিশ্বাসী সমাজে ‘মা’ শব্দটি শুধু সম্পর্ক নয়, একটি অনুভূতি, একটি সংস্কৃতি। তাই মা দিবস আমাদের দেশেও দিন দিন গুরুত্ব পাচ্ছে, নতুন প্রজন্মকে পরিবারমুখী ও মানবিক করে তুলতে ভূমিকা রাখছে।

মা দিবস শুধু একটি দিন নয়, এটি ভালোবাসা প্রকাশের একটি উপলক্ষ, যত্ন নেয়ার একটি উপলক্ষ। এই দিনে আমরা যদি একটি সময় মায়ের জন্য রাখি, একটি চিঠি লিখি, একটি ফোন করি কিংবা শুধু বলি ‘মা, আমি তোমাকে ভালোবাসি’, তাহলেই দিনটি সফল। যে মা আমাদের হাসি দেখার জন্য নিজের কান্না লুকান, যে মা নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ গড়েন, তার কাছে এই ছোট্ট ভালোবাসাটুকুই অনেক বড়। তাকে সম্মান জানানো হোক প্রতিদিন, তাকে ভালোবাসা দেয়া হোক প্রতিটি মুহূর্তে, এই হোক মা দিবসের অঙ্গীকার।

লেখক: বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত

 

জনপ্রিয়