
প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, ‘বিচার বিভাগের সংস্কার একটি বৃহত্তর সাংবিধানিক নবজাগরণের অংশ, যা বিচার বিভাগের মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যদি বিচার বিভাগের স্বাধীন না হয়, কোনো সেক্টরের সংস্কার কার্যক্রমই স্থায়িত্ব পাবে না।’
রোববার (৪ মে) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের অডিটোরিয়ামে আয়োজিত ‘রিমেইনিং দ্যা ফিউচার জাস্টিস’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন। এ কে খান ফাইনন্ডেশন এবং চবির আইন অনুষদের যৌথ উদ্যোগে এটি আয়োজিত হয়েছে।
সেমিনারে প্রধান বিচারপতি আরো বলেন, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন এবং পদ্ধতিগত দক্ষতা- এই তিন লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে এগিয়ে যাচ্ছে বিচার বিভাগ সংস্কার রোডম্যাপ। এরই অংশ হিসেবে নির্বাহী বিভাগ এবং আইনসভার হস্তক্ষেপ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল এবং সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যা দুটি স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে উচ্চ আদালতের বিচারকদের নিয়োগ এবং অপসারণের একমাত্র ক্ষমতা রাখে।’
তিনি আরো বলেছেন, ‘বিচার বিভাগের পূর্ণ প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে একটি আলাদা বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্ন হয়েছে, যা সংস্কার অগ্রগতির মূল স্তম্ভ হিসেবে কাজ করবে। সারাদেশে বিচারকদের বদলি ও পদায়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা এবং সামঞ্জস্য নিশ্চিত করতে একটি বিস্তৃত বদলি ও পদায়ন নীতিমালা সরকারের কাছে ইতোমধ্যে পেশ করা হয়েছে।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আরও বিভিন্ন বিশেষায়িত আদালত প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সুপ্রিম কোর্ট হতে সরকারের কাছে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। যার মধ্যে শিশু আদালত, বিদ্যুৎ আদালত এবং অন্যান্য বিশেষায়িত আদালত উল্লেখযোগ্য। ইতোমধ্যে সরকার এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করছে।’
এছাড়াও বিশেষায়িত বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘বিচারিক সংস্কার রোডম্যাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে জেলা পর্যায়ে বিশেষায়িত বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এটি হলে বাণিজ্যিক বিরোধগুলোর দ্রুত এবং কার্যকর সমাধান নিশ্চিত হবে।’
প্রযুক্তিগত অগ্রগতি অপরাধের ধরন বদলে দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখন অপরাধের প্রকৃতিতে এক মৌলিক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। আগে যেখানে অপরাধ হতো বাস্তব জগতে, এখন তা ক্রমশ স্থানান্তরিত হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া ও ইন্টারনেটের মতো ভার্চুয়াল জগতে। ডিজিটাল জগৎ নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়ন করতে গিয়ে অনেক সময়ই মত প্রকাশের স্বাধীনতা লঙ্ঘনের শঙ্কা দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে আমাদের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে এমন একটি পরিশীলিত ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা তৈরি করা, যা একদিকে ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষা করবে, অন্যদিকে সাইবার অপরাধ, হয়রানি এবং গোপনীয়তার লঙ্ঘন প্রতিরোধ করবে।’
মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বিচার ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই প্রযুক্তিনির্ভর নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতার ওপর। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্রমবিকাশ বিচারপ্রক্রিয়ায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে, যার মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সম্ভব।’
ইউএনডিপি, যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং সুইডেনসহ উন্নয়ন সহযোগীরা এই সংস্কার প্রক্রিয়ায় তাদের নীতিগত সমর্থন দিয়ে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বলেও জানান প্রধান বিচারপতি।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এম জাফরুল্লাহ্ তালুকদার।