
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনিক ও অশিক্ষক পদের প্রার্থী বাছাই ও সুপারিশের দায়িত্ব এনটিআরসিএর হাতে না থাকায় কোটি কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য, মামলা ও হামলার ঘটনা যুগ যুগ ধরে চলছে। শিক্ষা উন্নয়নের বৃহত্তর স্বার্থে এটি পুরোপুরি বন্ধ করতে না পারলেও রেশ টানা দরকার।
তাই পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে সুপারিশের ক্ষমতা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচচশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)কে দেয়ার প্রস্তাব করার কথা। এ প্রস্তাব অনুযায়ী মাউশির ৯টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে প্রার্থী বাছাই করে নিয়োগ সুপারিশ করা হবে বলে জানা যাচ্ছে।
কিন্তু অতি সম্প্রতি একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে শিক্ষার একমাত্র প্রিন্ট পত্রিকা ‘দৈনিক আমাদের বার্তা’ ও শিক্ষাবিষয়ক ডিজিটাল পত্রিকা ‘দৈনিক শিক্ষাডটকমে’। সংবাদটি হচ্ছে এখন থেকে জেলা প্রশাসকেরাই নিয়ন্ত্রণ করবেন এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অশিক্ষক কর্মচারী (অফিস সহকারী, নৈশ প্রহরী, আয়া ইত্যাদি) নিয়োগ।
জানা যায় এ সিদ্ধান্ত নেয়ার পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করেছেন এনটিআরসিএতে কর্মরত একজন অতিরিক্ত সচিব। এভাবে বেসরকারি স্কুল-কলেজে সহকারী শিক্ষক ও প্রভাষক ছাড়া বাকি ১৫পদে নিয়োগের কমিটিতে জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি থাকবেন। পাঁচ সদস্যের এ নিয়োগ কমিটিতে শিক্ষা বোর্ড ও মাউশির একজন করে প্রতিনিধিও থাকতে হবে। নিয়োগ পরীক্ষায় প্রতি পদের বিপরীতে কমপক্ষে তিনজন প্রার্থী থাকতে হবে।
সিদ্ধান্তটিকে আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটিতে আসা বা আসতে চাওয়া ব্যক্তিরা নিরুৎসাহিত হবেন এবং নিয়োগ দুর্নীতি, হানাহানি ও মামলা ও হামলা বন্ধ হবে। তবে, অনেকে আশংকা প্রকাশ করেছেন যে, সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ ডিসির নিয়ন্ত্রণে যেখানে প্রশ্নফাঁস, ঘুষ লেনদেন ও তদবিরসহ অনেক কিছু হয়।
এবার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী নিয়োগের বিষয়টি সেই প্রশাসনের হাতে চলে গেলো, দুর্নীতি যে আরো কতভাবে হবে সেটি নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ব্যবস্থা আছে দৃশ্যমান হচ্ছে না। ডিসির নিয়ন্ত্রণে মানে ডিসি তিনি যে জেলায় কর্মরত সেখানকরা কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের প্রভাবের মধ্যেই কাজটি করতে হবে। তার নিজের তো এতসব কিছু দেখার সময় নেই, সম্ভবও না।
যেসব লোকদের দ্বারা তিনি কাজটি করাবেন তারা তো বিষয়টিকে নিজেদের স্বার্থে, নিজেদের পছন্দেই করবেন। সেখানে দুর্নীতি রোধ করার উপায় কি? তারা তো অর্থের বিনিময়ে সবকিছু করে ডিসির স্বাক্ষর নিবেন। রাজনৈতিক প্রভাব ঠেকানোর দক্ষতা সব ডিসির নেই---এটিও তো সত্য। তাই অনেক শিক্ষাবিদ ও অংশীজনরা বলছেন শিক্ষকদের দাবি উপেক্ষা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটি একটি বিশেষ ক্যাডার এবং খোলাসা করে বললে আমলাদের খুশি করার জন্যই করা হয়েছে। এতে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কারণ তারা মনে করেন এর দ্বারা দুর্নীতি রোধ করা যাবেনা।
আবার বিষয়টিকে অন্যভাবে দিয়ে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, বহু বছর যাবত এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী নিয়োগে জনপ্রতি চার থেকে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুস লেনদেন হয়ে আসছে। এই ঘুষের টাকা ভাগ-বাটোয়ারার দায়িত্ব এতদিন ছিলো বেসরকারি পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা কমিটির হাতে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডিসির নেতৃত্বাধীন কমিটি এই কর্মচারী নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করবেন।
কমিটিতে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা এবং পুরনো সরকারি কলেজের অধ্যক্ষও থাকবেন। এটি খারাপ নয়। তবে, জনপ্রতিনিধি এবং এলাকার প্রভাবশালীরা এর বিরোধিতা করবেন, এটিই স্বাভাবিক। ভাল কিছু করতে গেলে অনেকের সমালোচনা সহ্য করতে হয় ও বাধা পেরিয়ে আসতে হয়। এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই।
আমরা জানি স্থানীয় প্রভাবশালীরাই হন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য। তাদের অধিকাংশেরই ধান্দা থাকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। যার ফলে, সঠিক কোনো প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়াটা কঠিন হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে চলে বরং অর্থ লেনদেন যার পরিমাণ বেড়েই চলছে। শুধু অর্থ লেনদেন দিয়েই ঘটনা শেষ হয়না, হানাহানি, মারামারি এবং মামলা পর্যন্ত গড়ায়। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পবিত্রতা নষ্ট হয়। সেই দিক থেকে জেলা প্রশাসকদের জড়িত করা এক অর্থে খারাপ নয়। মাউশির আঞ্চলিক অফিসগুলো যদি এটি করে তাতেও কি ঘুস, দুর্নীতি বন্ধ হবে? সেটিরও গ্যারান্টি দেয়া যাচ্ছেনা। ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে এবং এটি পূর্বের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো।
নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিক্ষকরা চেয়েছিলেন এন্ট্রি লেভেলের শিক্ষক নিয়োগের মতোই কর্মচারী নিয়োগের প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষমতাও এনটিআরসিএকে দেয়া হোক অথবা শিক্ষা অধিদপ্তরগুলোকে।
শিক্ষক নেতারা বলেন বহুদনি ধরে জোরালো দাবি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রধান নিয়োগও এনটিআরসিএর হাতে দেয়ার, দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই দাবি এখন তুঙ্গে কিন্তু এনটিআরসিএর একজন অতিরিক্ত সচিব এতে বাধ সেধেছেন।
জানা যায়, গত ২৮ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক মো. সাইফুল ইসলাম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচচশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব মহোদয়কে এই প্রস্তাব পাঠান। প্রস্তাবে বলা হয়, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রধান ও সহকারি প্রধান, সুপারিনটেনডেন্ট, সহকারি সুপার এবং অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে এনটিআরসিএ থেকে প্রার্থী নির্বাচন ও সুপারিশ সংক্রান্ত প্রস্তাব বিবেচনার জন্য পাঠানো হলো। এতে এনটিআরসিএ আইন সংশোধন ও একটি নতুন ধারা ও উপধারা সংযোজন এবং প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সহকারী প্রধান এবং অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষা গ্রহণ বিধিমালা প্রণয়নের কথাও বলা হয়েছে।
সংসদ কার্যকর না থাকায় অর্ডিন্যান্স জারির কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডার নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টি এড়িয়ে যায়।
২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে প্রকাশিত গেজেট অনুযায়ী এন্ট্রি লেভেলে (প্রভাষক, সহকারী শিক্ষক) নিয়োগের প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্ব এনটিআরসিএর। আর অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক ও কর্মচারীদের নিয়োগ এখনও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবস্থাপনা কমিটির হাতে থাকায় ঘুস লেনদেনের ব্যাপার ঘটেই চলছে।
বর্তমানে সারাদেশে ৩২ হাজারের বেশি এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাড়ে পাঁচ লাখের বেশি শিক্ষক-কর্মচারীকে সরকারি কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা দেয়া হয় যার আমলাতান্ত্রিক নাম এমপিও। এছাড়াও কয়েকলাখ শিক্ষক আছেন ননএমপিও প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। আবার এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতেও খন্ডকালীন নামে হাজার হাজার ননএমপিও শিক্ষক।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগে প্রায়ই অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটিকে কর্মচারী নিয়োগ দেয়ার জন্য ক্ষেত্রবিশেষে ৮ থেকে ১৫ লাখ টাকা ঘুস দেয়া নেয়ার অভিযোগ বহুদিনের।
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক