
প্রতীকী ছবি
আরব মরুভূমির এক স্নিগ্ধ সকাল। বৃদ্ধ বাবার দুটি চোখ যেন অশ্রুতে ছলছল। অজস্র দোয়ার বদৌলতে পাওয়া কিশোর বয়সী প্রাণপ্রিয় পুত্রকে হারাবার আতঙ্কে বিহ্বল। তবু হৃদয়রাজ্যে পরম শান্তি ও অপরিসীম তৃপ্তি, পাহাড়সম ঈমানের দৃঢ়তা ও প্রভুর আনুগত্যের স্বর্গীয় অনুভূতি।
বলছিলাম দেড় সহস্রাধিক বছর আগের কথা। যখন কাবা শরিফের চারপাশে মাইলের পর মাইল ছিল ধূ ধূ মরু-প্রান্তর। জনবসতি বলতে হাতে গোনা কজন। শিশু ইসমাঈল তখন শৈশবের গন্ডি পেরিয়ে চাঞ্চল্যময় কিশোর। বয়োজ্যেষ্ঠ পিতার দীর্ঘদিনের দোয়া ও কান্নার ফসল, জীবনের পড়ন্ত বেলায় প্রাপ্ত বহুল প্রার্থিত নেয়ামত। যাকে ঘিরে তাঁর সমস্ত ভালোবাসা, প্রীতি ও প্রত্যাশা। হঠাৎ এক নিস্তব্ধ নীরব রজনীতে ইবরাহীম (আ.) স্বপ্নে দেখেন- কলিজার টুকরো ছেলে ইসমাঈলকে নিজ হাতে জবাই করছেন। নবী ইবরাহীম (আ.) সহজেই বুঝে নিলেন, এ যে মহামহিমের পক্ষ হতে তার জন্য অগ্নিপরীক্ষা। সর্বময় ক্ষমতার আধার আল্লাহর নামে আদরের পুত্রকে কোরবানি করার স্পষ্ট ইঙ্গিত।
ইবরাহীম (আ.) কালবিলম্ব না করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন। অব্যক্ত যন্ত্রনা আর শত কষ্ট মুছে গেল নয়নজলে, অন্তরের অন্তস্থলে। পুত্রপ্রেম বিসর্জন দিলেন প্রভুপ্রেমের সামনে। খোদা প্রদত্ত নেয়ামতকে খোদার রাহে উৎসর্গ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বাবা। বিষয়টি ছেলে ইসমাঈলের কাছে পেশ করতেই স্বতঃস্ফুর্ত কণ্ঠে পিতাকে অভয় দিয়ে বলে উঠলেন: “আপনি আপনার রবের নির্দেশ পালন করুন। নিশ্চয় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল হিসেবে পাবেন।” পবিত্র কোরআনে পিতা-পুত্রের এ আলাপচারিতা এভাবেই বাঙময় হয়েছে- “এরপর সে যখন তার পিতার সঙ্গে কাজ করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইবরাহীম তাকে বলল, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে আমি তোমাকে জবাই করছি। এখন তোমার অভিমত কী? তখন সে বলল, হে আমার পিতা, আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।” (সুরা সাফফাত: ১০২)
সদ্য ফোটা পুষ্পতুল্য ইসমাঈলের প্রজ্ঞাপূর্ণ প্রতিউত্তরে পিতা ইবরাহীম (আ.) অত্যন্ত পুলকিত ও শংকামুক্ত। রবের কৃতজ্ঞতায় মস্তকাবনত। আর্দশ বাবার আদর্শ ছেলে বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিলেন প্রভুর ফরমান। মক্কার অনতিদূরে মীনার প্রান্তরে সৃষ্টি হল পিতা-পুত্রের অপূর্ব ত্যাগের এক সোনালি উপাখ্যান।
পিতার ধারালো ছুরি চলে স্নেহের পুত্রের গলে। পার্থিব মোহ-টান তুচ্ছ করে বাবা-ছেলের এই কোরবানি আল্লাহর আরশ ছুঁয়ে গেল। ত্যাগের মহিমায় এ ধরা আবার জেগে উঠল। ইথারে-পাথারে প্রতিধ্বনিত হল তাওহীদের জয়গান। মহান আল্লাহর কৃপায় অলৌকিকভাবে ইসমাঈল (আ.)-এর পরিবর্তে জবাই হল এক জান্নাতি দুম্বা। বরাবরের মতো মর্যাদাবৃদ্ধির এ পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হলেন আদি পিতা ইবরাহীম (আ.)। এই অনন্য ত্যাগের নির্দশনস্বরূপ আল্লাহ তায়ালা মুসলিম জাতির উপর অবধারিত করে দিলেন পশু কোরবানির বিধান। মুসলিম উম্মাহর পালনীয় ইবরাহীমি সুন্নাহ পশু কোরবানির এ ধারা দুনিয়ার ইতিহাসে দৃষ্টান্তহীন ত্যাগের চির অক্ষত স্মারক। প্রচলিত পশু কোরবানির যোগসূত্র আলোচ্য ঘটনা সংশ্লিষ্ট হলেও কোরবানির ইতিহাস অতি পুরনো ও প্রাচীন। মানব সভ্যতার শুরু থেকে প্রতি যুগেই ছিল কোরবানির প্রথা । যদিও পন্থা ও পদ্ধতিতে ছিল বিস্তর ব্যবধান। তখনকার সময় কোরবানিতে প্রাণী জবাইয়ের এই পদ্ধতি স্বীকৃত ছিল না। মানুষ নিজের কোরবানির বস্তু পাহাড়ে বা উন্মুক্ত ময়দানে রেখে আসতো। যার কোরবানি কবুল হতো আসমানি অগ্নিখণ্ড এসে তা জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিত। এভাবে সবার সামনে প্রকাশ হয়ে যেতো কার কোরবানি কবুল হয়েছে, কার হয়নি? পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম কোরবানি করেছিল আদম (আ.)-এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিল। প্রখ্যাত মুফাসসির আল্লামা ইবনে কাসিরের বর্ণনায় আছে হাবিল একটি ভেড়া আর কাবিল তার ফসলের কিছু অংশ স্রষ্টার উদ্দেশ্যে নিবেদন করে। আল্লাহর নির্ধারিত পদ্ধতিতে আকাশ থেকে নেমে আসা আগুন হাবিলের কোরবানি কবুল করে নেয়, আর কাবিলের কোরবানি অগ্রহণযোগ্যই থেকে যায়।
কোরবানির ইতিহাস যেমন ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল ও চির ভাস্বর, তার তাৎপর্যও তেমন সুগভীর ও মজবুত। পশু কোরবানির নামান্তরে প্রতিপালকের আনুগত্যে নিজেকে সমর্পণ করাই মুখ্য। মহান রবের নির্দেশে মনের পশুত্বকে বর্জন করে প্রকৃত ত্যাগের শিক্ষায় উজ্জীবিত হওয়াই কোরবানির লক্ষ্য ও তাৎপর্য। তাই বছর ঘুরে কোরবানি এসে আমাদেরকে মনে করিয়ে যায় ত্যাগেই প্রেম, রাশি রাশি ভালোবাসা; ত্যাগেই সফলতা-সম্মান।
লেখক: শিক্ষক ও প্রবন্ধিক