
বলা হয়, ‘শিক্ষকই জাতির রূপকার’। শ্রদ্ধা, ভক্তি আর নিষ্ঠার এক মহৎ প্রতীক ছিলেন যিনি, আজ তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এক শিক্ষার্থী হাত তোলে! সমাজ কি তবে উল্টো পথে হাঁটছে? একসময় ছিলো, যখন স্কুলের মাঠে দূর থেকে শিক্ষককে দেখে মাথা নিচু করতো শিক্ষার্থীরা।
আজ শিক্ষক হেঁটে এলে অনেকে তাকিয়েও দেখে না, কেউ কেউ আবার তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অপমান করার সাহস পায়। অথচ এই শিক্ষকই তো শিশুদের পথ দেখান, চোখে স্বপ্ন বুনে দেন, সমাজে সত্য ও ন্যায়ের বীজ বপণ করেন। তবে আজ প্রশ্ন ওঠে এই সাহস শিক্ষার্থীরা পেলো কোথায়? তারা কোথায় শিখলো, একজন শিক্ষকের গায়ে হাত তোলা যায়?
এই উত্তর হয়তো লুকিয়ে আছে আমাদের সমাজব্যবস্থার ভেতরেই পরিবারে, মিডিয়ায়, রাজনীতিতে, এবং সবচেয়ে বড় কথা আমাদের শিক্ষার ভেতরে। শাসন যেখানে সহিংসতা হয়ে ওঠে, শ্রদ্ধা যেখানে শূন্যে, সেখানে গড়ে ওঠে এমন প্রজন্ম যে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক নয়, ‘টার্গেট’ খোঁজে। আজ শিক্ষকের কণ্ঠ থেমে যায় অপমানের ভয়ে, জ্ঞানের আলো ম্লান হয়ে যায় অবজ্ঞার অন্ধকারে। এই সমাজ কি তবে হারাচ্ছে তার মেরুদণ্ড? শিক্ষককে কোনো জাত, ধর্ম, বর্ণ, দিয়ে বিভাজন করা যায় না। তারা আজ নোংরা পাশবিক রাজনীতির শিকার!
শিক্ষক কে? শিক্ষক হলেন সেই মহান ব্যক্তি যিনি অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসেন। একজন শিক্ষক শুধু পাঠ্যপুস্তক শেখান না, তিনি শিখিয়ে দেন ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, সৎ-অসৎ-এর পার্থক্য। তিনি একজন মানুষ গড়ার কারিগর, যার হাতে জাতি গঠনের ভিত্তি রচিত হয়।
শিক্ষকের গুরুত্ব কী? শিক্ষকের গুরুত্ব নির্ধারণ করা শুধু কঠিন নয়, প্রায় অসম্ভব। তিনি শিশুর প্রথম গাইড, যুবকের অনুপ্রেরণা, সমাজের বিবেক, রাষ্ট্রের স্থপতি। শিক্ষা শুধু সার্টিফিকেট নয়, এটি মূল্যবোধ, চরিত্র, আত্মবিশ্বাস ও নৈতিকতা গঠনের অস্ত্র যার মূল কারিগর শিক্ষক। একজন ভালো শিক্ষক একটি প্রজন্মকে গড়ে তুলতে পারেন, আবার উপেক্ষিত বা অবহেলিত শিক্ষক একটি সমাজকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিতে পারেন।
আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে গণতান্ত্রিক আন্দোলন, দুর্যোগকালীন সহায়তা, করোনা মহামারির সময় ঘরে বসে পড়ানো সবখানেই শিক্ষকদের অবদান অনস্বীকার্য। তারা প্রান্তিক শিশুদের আলোর পথে এনেছেন, মেয়ে শিশুদের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করেছেন, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মূল্যবোধের বীজ বপন করেছেন। তারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সীমিত সুযোগ-সুবিধা নিয়েও অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। অথচ তাদের যথাযথ স্বীকৃতি নেই।
আজ আমরা কী করছি? আমরা শিক্ষকদের মারছি, তাদের অপমান করছি, সামাজিক মাধ্যমে ট্রল করছি, তাদের পেশাকে হেয় করে দেখছি। কেনো করছি? উত্তর নেই। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, পরিবারের কাছ থেকে নৈতিক শিক্ষার অভাব, নোংরা রাজনীতির বেড়াজাল, মিডিয়ার নেতিবাচক প্রভাব, ও দুর্বল শিক্ষা নীতির কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক আজ ভেঙে পড়েছে।
ফলাফল কী ভেবেছি কখনো? শিক্ষকেরা পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন, যোগ্য মানুষ শিক্ষক হতে আগ্রহ হারাচ্ছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছে, ছাত্ররা হয়ে উঠছে দায়িত্বজ্ঞানহীন ও সহিংস। জাতি যদি তার শিক্ষকদের সম্মান না করে, সে জাতি কখনো উন্নতির পথে যেতে পারে না। এটি শিক্ষার ক্ষয়, সভ্যতার ক্ষয় এবং মানবতার ক্ষয়।
সমাধান কী? পরিবার থেকে নৈতিক শিক্ষা নিশ্চিত করা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা, শিক্ষকদের জন্য সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা, সংশ্লিষ্ট আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা, শিক্ষাব্যবস্থায় মূল্যবোধভিত্তিক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা, মিডিয়ায় শিক্ষকদের ইতিবাচক উপস্থাপন করা, শিক্ষককে শুধু চাকরিজীবী হিসেবে না দেখে, জাতি গঠনের কারিগর হিসেবে দেখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা রাজনীতির নোংরা ছোবল থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করা।
নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, শিক্ষা হলো সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র যা আপনি পৃথিবীকে বদলাতে ব্যবহার করতে পারেন। আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন, শিক্ষকের অন্যতম সেরা কৌশল হলো সৃজনশীল প্রকাশ ও জ্ঞানে আনন্দ জাগানো। মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, এভাবে জীবনযাপন করুন যেনো আপনি আগামীকাল মারা যাবেন, আর শিখুন যেনো আপনি চিরকাল বাঁচবেন। মার্টিন লুথার কিং বলেছেন, শিক্ষার কাজ হলো একজনকে গভীরভাবে চিন্তা করতে ও সমালোচনামূলক চিন্তা করতে শেখানো। প্লেটো বলেছেন, যে শিক্ষক, তিনি এমন একজন ব্যক্তি, যিনি মানুষকে বিশ্বাস করান যে জ্ঞানই শক্তি। জন ডিউই বলেছেন, যদি আমরা আজকের ছাত্রদের আগের মতো শিক্ষা দিই, তবে আমরা তাদের আগামীকালের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করি।
বিভিন্ন দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে তুলনা করি তাহলে স্পষ্ট বোঝ যায় আমরা কোথায়। ফিনল্যান্ডে বিশ্বের সেরা শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে পরিচিত। ফিনল্যান্ডের শিক্ষকরা অত্যন্ত প্রশিক্ষিত ও স্বাধীনভাবে পাঠদান করেন। তারা শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ এবং সমস্যা সমাধানে উৎসাহিত করেন। দেশটি শিক্ষকদের উচ্চ সম্মান দেয় এবং শিক্ষাব্যবস্থায় তাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক, যা তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে।
জাপানে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা খুবই উচ্চ। তারা শিক্ষার্থীদের শৃঙ্খলা ও আন্তরিকতা শিখিয়ে তাদের জীবনকে গঠন করে। শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান একটি জাতিগত বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। জাপানে শিক্ষকরা মেধার বিকাশের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষা ও সুস্থ জীবনযাপনে সহায়তা করেন।
আমেরিকায় শিক্ষকদের প্রতি নানা ধরনের অবমূল্যায়ন ও সম্মানহানির ঘটনা ঘটলেও, শিক্ষকরা বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন ও নীতিগত পরিবর্তনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকদের নেতৃত্ব ও ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রেই পরিবর্তন আনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যে শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা ও সম্মান এখনও উচ্চ, তবে ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বাজেট কাট ও নীতিগত পরিবর্তনের কারণে তারা কিছুটা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। তবে দেশটির অনেক শিক্ষক এখনো সমাজে শক্তিশালী পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট।
সিঙ্গাপুরের শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। দেশটি শিক্ষকদের প্রতি উচ্চ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করে, যা তাদের পেশাগত মর্যাদা ও মান উন্নয়নে সহায়ক। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, পেশাগত উন্নয়ন এবং মানসম্মত শিক্ষাদানে সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত।
শিক্ষার্থী যদি শ্রদ্ধা না শেখে, কেবল ডিগ্রি নিয়ে বের হয়, তাহলে সে সমাজের বোঝা। শিক্ষককে অপমান করার শিক্ষা কোনো পাঠ্যবইয়ে নেই। এ শিক্ষা এসেছে আমাদের আচরণ থেকে। এখনই সময় পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবাই মিলে আত্মসমালোচনায় ফেরার। নইলে সেই দিন আর দূরে নয়, যেদিন জ্ঞানের মশাল হাতে নেয়ার কেউ থাকবে না, থাকবে শুধু অন্ধকার আর অনুশোচনা। একটি সভ্য জাতি গঠনে শিক্ষক হচ্ছেন মেরুদণ্ড। শিক্ষককে অসম্মান মানেই নিজেদের শেকড় কেটে ফেলা। আমরা যদি জাতি হিসেবে বাঁচতে চাই, যদি উন্নত সমাজ গড়তে চাই, তবে আমাদের শিক্ষককে ভালোবাসতে হবে, সম্মান করতে হবে। কারণ, ‘শিক্ষক আছেন বলেই আমরা মানুষ’।
লেখক: বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত