
শিক্ষা মৌলিক অধিকার। অথচ শিক্ষাক্ষেত্রেও বৈষম্য! কষ্টটা ‘কাঁচা ঘায়ে নুনের ছিটা’ হয়, যখন দেখি ‘আরো একটি প্রতিষ্ঠান সরকারি হলো’ এমন খবর। বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের শপথে পথচলা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক।
এমপিওভুক্তদের আশা ছিলো, শিক্ষকবান্ধব বর্তমান সরকারের সময়ে কিছু একটা জুটবে তাদের ভাগ্যে। শিক্ষকদের উৎসব ভাতা যৎসামান্য বাড়লেও, কর্মচারীদের যে-ই সে-ই! তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের কষ্টের কান্নার মধ্যে শিক্ষকদের খণ্ডিত উৎসব ভাতা বৃদ্ধি প্রাতিষ্ঠানিক বন্ধনে আবদ্ধ শিক্ষক-কর্মচারীর পরিবারে অসম্পূর্ণ আনন্দবার্তা নয় কি?
আমি একই কলেজে তেত্রিশ বছর। আইনজীবী, বিচারক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা অন্যান্য পেশাজীবীর অভিজ্ঞার যেমন মূল্য-মূল্যায়ন শিক্ষকদের বেলায় ঠিক তার উল্টো। বড় ডাক্তারের ভিজিট বেশি, প্রবীণ উকিলের মোয়াক্কেল ও ফি দুই-ই বেশি। অথচ সমাজে প্রবীণ শিক্ষকের কেইবা খোঁজ নেন। জীবনচক্রের স্বাভাবিকতায় বয়স শেষে অবসরে-আয় বন্ধ হলেও ব্যয় বাড়ে, কমে যায় দৈহিক সার্মথ্যটুকুও, তখন?
বিগত সময়ে শিক্ষা জাতীয়করণে হয়েছে চরম বৈষম্য। প্রয়োজনীয় মানদণ্ড ও যাচাই-বাছাই ছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের উদ্যোগ বৃহত্তম শিক্ষকসমাজকে চরমভাবে বিদ্রুপ করছে।
বিচ্ছিন্নভাবে জাতীয়করণের সুবাদে, সামগ্রিকভাবে বঞ্চিতরা মানসিক লাঞ্ছনাবোধ করা কি অস্বাভাবিক? বরং অনেকের বিষণ্ন ভাবনা-কান্না সবই যেনো এখন ব্যর্থ, ভুল ও নীরব হাহাকার।
জাতীয়করণ বঞ্চিত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর ভাগ্যের লিখন মেনে নেয়াই কি চরম সত্য? অভিন্ন সিলেবাসে পাঠদানকারী কেউ হবে ভাগ্যবান, আর কেউবা অপমানিত? জন্মস্থানের কারণেই একজন হবে জাতীয়করণের সুবিধা বঞ্চিত?
জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষকরা তৎপর হলেই অনেকেই ভাবেন; শিক্ষকরা টাকার জন্য এসব করেন। এগুলো নিতান্তই হীন মানসিকতা ও বিভ্রান্তিকর। টাকার কাঙালরা সবকিছু করলেও শিক্ষকতা করেন না। নিরীহ, নির্লোভরাই শিক্ষক হন। দারুণ সম্ভাবনা ছেড়েও অনেকে শিক্ষকতায় আসেন কেবল অন্তরের আকাঙ্ক্ষা ও জাতির প্রতি কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধের দায়ে।
দেশে সরকারি-বেসরকারি এবং গ্রাম-শহরে শিক্ষা খাতে বৈষম্য দূরীকরণের কোনো বিকল্প নেই। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররা বেতন বেশি দেয়, শিক্ষকরা পান কম বেতন। সরকারি প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা দেয় কম বেতন, শিক্ষকরা পান বেশি। এটা দেশের সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি।
বিগত সরকারের পদক্ষেপে বিচ্ছিন্নভাবে প্রায় সব উপজেলায় একটি করে কলেজ জাতীয়করণ হয়। ফলে গাজীপুর জেলায় ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম প্রতিষ্ঠিত কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ বাদ গেলো। প্রায় ৬০ বছরেও বেসরকারিই রইলো কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ। ময়মনসিংহে পুলিশি অভিযানে ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ এবং ছফর আলী নামের এক পথচারী প্রাণহানি ঘটলো।
তবুও কি জাতীয়করণ হয়েছে? উপজেলা সদরে অবস্থিত দেশের অন্যতম প্রাচীন কলেজ, ভৈরবের হাজী আসমত কলেজ জাতীয়করণও দুর্ভাগ্যের গ্যাঁড়াকলে আটকে আছে। গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলা সদরে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী কালিয়াকৈর ডিগ্রি কলেজও বাদ গেলো জাতীয়করণের দৌড়ে। এমনি করে দেশের বিভিন্ন স্থানে উপজেলা সদরের বেশকিছু প্রতিষ্ঠিত কলেজ জাতীয়করণ বঞ্চিত রয়ে গেলো।
উল্লেখ্য, অনেক প্রতিষ্ঠিত কলেজ জাতীয়করণের তালিকাভুক্ত হয়নি। যদিও ওই কলেজগুলো জাতীয়করণকৃত কলেজের চেয়ে যোগ্যতর। বিষয়টি পর্যালোচনা হলে ক্ষতি কী?
দেশে মানুষগড়ার কারিগরদের নিয়ে কারো যেনো টেনশন নেই! এমপিওভুক্তরা পূর্ণাঙ্গ মেডিক্যাল ও উৎসব ভাতা পান না। তারা সেচ্ছায় অবসর, বদলি সুবিধাসহ অসংখ্য বঞ্চনার শিকার। ‘জাতীয় লজ্জা’ এমপিওভুক্ত কেউই পদমর্যাদা অনুযায়ী বাড়িভাড়া পান না। তাদের বাড়িভাড়া ১ হাজার টাকা, চিকিৎসাভাতা ৫০০ টাকা। সমাধান; এক ঘোষণায় শিক্ষা জাতীয়করণ।
আফসোস! ‘ঢেলে সাজানো’র কথা বলে শুধু ঢালা হয়, সাজানো হয় না! কে শোনে কার কথা? বিচ্ছিন্নভাবে জাতীয়করণের মস্ত মহড়ায়, সমস্ত শিক্ষকসমাজের মধ্যে বৈষম্য, হতাশা, অপমানের তিক্ত অভিজ্ঞতা তৈরি হওয়াই কি শেষ কথা? স্মরণ রাখা প্রয়োজন, শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার ও শিক্ষকের সম্মান সবার ওপরে। কবির ভাষায়- ‘এক ফোটা পদধূলি নহে পরিমাণ, গয়া কাশি বৃন্দাবন তীর্থের সমান।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান (ইসলামিক স্টাডিজ), কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর