
হজের কার্যক্রম মূলত পাঁচদিন। জিলহজের আট তারিখ থেকে বারো তারিখ পর্যন্ত। আট তারিখ পবিত্র মক্কা শরিফ থেকে হজের নিয়তে ইহরাম ধারণ করে মিনায় গমনের মাধ্যমে হজের কার্যক্রম শুরু হয়।
৮ জিলহজ: হজের ইহরাম বাঁধা ও মিনায় অবস্থান
হজের কার্যক্রম শুরু হয় ৮ জিলহজ থেকে। এ দিন মক্কার হারাম শরিফ বা বাসা/হোটেল থেকে হজের নিয়তে ইহরাম বেঁধে মিনার উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। সঙ্গে এক জোড়া ইহরামের কাপড়, হালকা শুকনো খাবার, গামছা নিবেন। বর্তমানে হাজিদের সংখ্যাধিক্যের কারণে সরকারিভাবে ৮ তারিখের আগেই হাজিদের মিনায় নিয়ে যাওয়া হয়। সুতরাং সরকারি শিডিউল অনুযায়ী নির্ধারিত দিনে ইহরাধ বেঁধে মিনায় যাত্রা করতে হবে। ৮ জিলহজ জোহর থেকে ৯ জিলহজ ফজর পর্যন্ত ৫ ওয়াক্ত নামাজ মিনায় আদায় করা মোস্তাহাব এবং সেখানে অবস্থান করা সুন্নাত। তবে এদিন মিনায় কোনো নির্দিষ্ট কাজ থাকে না। মিনায় গিয়ে হাজি সাহেবান সাধারণ ইবাদত বন্দেগিতে মগ্ন থাকবে। মিনায় অবস্থান করাও একটি ইবাদত।
৯ জিলহজ: আরাফাতের ময়দানে অবস্থান
জিলহজের ৯ তারিখে ঐতিহাসিক আরাফার ময়দানে হজের মূল কাজ অনুষ্ঠিত হয়। জিলহজের ৯ তারিখে দুপুর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফার ময়দানে অবস্থান করতে হয়। পরিভাষায় তাকে উকুফে আরাফা বলা হয়। উকুফে আরাফাকেই হজ বলা হয়। উকুফে আরাফা করতে না পারলে হজ হয় না। ৯ জিলহজ ফজরের পর সম্ভব হলে মিনায় গোসল করে নেবে অথবা ওজু করে সকাল সকাল আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। কিন্তু বর্তমানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৮ তারিখ রাত থেকেই হাজিদের আরাফায় নিতে শুরু করে। সুতরাং আরাফার ময়দানে গিয়ে গোসল করা উত্তম।
৯ জিলহজ জোহরের আগেই হজের অন্যতম রোকন পালনে আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হতে হয় এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থান করতে হয়। উকুফে আরাফা হজের অন্যতম রোকন।
আরাফাতের ময়দানে তাওবা-ইসতেগফার, তাকবির, তাসবিহ, তাহলিল ও রোনাজারিতে মগ্ন থাকবে।
সূর্যাস্তের পর মাগরিব নামাজ না পড়ে আরফার ময়দান থেকে মুজদালিফার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাবে। মুজদালিফায় গিয়ে একবার আজান ও ইকামত দিয়ে প্রথমে মাগরিব নামাজ আদায় করবে, এরপর শুধু ইকামত দিয়ে ইশার নামাজ আদায় করবে। মাগরিব ও ইশার নামাজ আদায়ের পর খোলা আকাশের নিচে চাদর বিছিয়ে ঘুমিয়ে যাবে। রাতে মুজদালিফায় ঘুমানো সুন্নাত।
১০ জিলহজ: কংকর নিক্ষেপ, কোরবানি ও মাথা মুণ্ডন
জিলহজের দশ তারিখ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদিন মৌলিকভাবে তিনটি কাজ করতে হয় এবং কাজগুলো ধারাবাহিকভাবে করতে হয়।
কংকর নিক্ষেপ করা: ১০ জিলহজ মুজদালিফায় ফজরের নামাজ আদায় করবে। এখান থেকে কংকর সংগ্রহ করবে। কংকরগুলো তোয়ালে অথবা ছোট বোতলে নিয়ে মিনার জামরার উদ্দেশ্যে রওনা হবে। মিনার তিনটি জামরা রয়েছে। মুজদালিফা থেকে প্রথম যে জামরাটি দেখবেন এটি ছোট জামরা বা ছোট শয়তান। তার পরেরটি মধ্যম জামরা বা মাধ্যম শয়তান। তার পরেরটি বড় জামরা বা বড় শয়তান। ১০ জিলহজ ছোট ও মধ্যম জামরায় কংকর নিক্ষেপ করা হয় না। শুধুমাত্র সর্বশেষ জামরা তথা বড় শয়তানকে কংকর নিক্ষেপ করবে। বড় জামরায় ৭টি কংকর নিক্ষেপ করবে। কংকরগুলো নির্দিষ্ট বৃত্তের ভেতরে ফেলতে হবে। কোনোভাবেই যেন বৃত্তের বাইরে না পড়ে। যে কংকর বৃত্তের বাইরে পড়বে তার পরিবর্তে আরেকটি কংকর বৃত্তের ভেতরে ফেলতে হবে।
হজের কোরবানি করা: জামরায় কংকর নিক্ষেপের পর দ্বিতীয় কাজ হলো হজের কোরবানি করা। এই কোরবানিকে দমে শোকর বা কৃতজ্ঞতার কোরবানি বলা হয়। হজ আদায়ের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এই কোরবানি করা হয় বিধায় তাকে দমে শোকর বলা হয়। এটি সম্পদের কারণে ওয়াজিব হওয়া কোরবানি থেকে আলাদা। কারো সম্পদ থাকলে দমে শোকরের পাশাপাশি আরো একটি কোরবানি দিতে হবে।
মাথা মুণ্ডন করা: এ দিনের তৃতীয় কাজ মাথা মুণ্ডন করা। তবে পশু কোরবানির আগে মাথা মুণ্ডাবে না। পশু কোরবানির ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর মাথা মুণ্ডাবে। এ ব্যাপারে অনেকের ত্রুটি হয়ে যায়। তাই সতর্ক থাকতে হবে। মাথা মুণ্ডনের মাধ্যমে ইহরাম থেকে হালাল হয়ে যাবে এবং গোসল করে সাধারণ পোশাক পরিধান করে নিবে। তবে তাওয়াফে জিয়ারতের আগে স্ত্রী সহবাস জায়েজ হবে না।
তাওয়াফে জিয়ারত: এদিনের আরেকটি কাজ কাবা শরিফের তাওয়াফ করা ও সায়ি করা। একে তাওয়াফে জিয়ারত বলা হয়। এই তাওয়াফ ফরজ। এটি না করলে হজ বাতিল হয়ে যাবে। তবে তাওয়াফটি ১০ জিলহজ করা জরুরি নয়। ১০ তারিখে সম্ভব না হলে ১১ বা ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত যেকোনো সময়ে করা যায়। তবে ১০ তারিখে করা উত্তম। ১০ তারিখ তাওয়াফে জিয়ারত সম্পন্ন করে মিনায় চলে যাবে এবং মিনায় রাত যাপন করবে।
১১ ও ১২ জিলহজ: মিনায় অবস্থান ও কংকর নিক্ষেপ
১১ ও ১২ জিলহজের কাজ হলো মিনায় অবস্থান করবে এবং প্রতিদিন তিনটি জামরায় কংকর নিক্ষেপ করবে। তাওয়াফে জিয়ারত আদায়ের জন্য কেউ মক্কায় গেলে তাওয়াফ শেষে মিনায় ফিরে আসবে এবং মিনায় রাত যাপন করবে। ১০, ১১ ও ১২ জিলহজ এই তিন রাত মিনায় অবস্থান করবে। ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের আগেই মিনা ত্যাগ করবে। সূর্যাস্তের আগে মিনা ত্যাগ করতে না পারলে ১৩ জিলহজ রাতও মিনায় অবস্থান করবে এবং ১২ জিলহজের মতো তিনটি জামরায় ৭টি করে ২১টি কংকর নিক্ষেপ করে মিনা ত্যাগ করবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ১৩ জিলহজও মিনায় অবস্থান করেছিলেন।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট