ঢাকা শনিবার, ১৭ মে ২০২৫ , ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

প্রাকৃতিক চিকিৎসা আধুনিক চিকিৎসার পরিপূরক

মতামত

মো. তৌফিকুল ইসলাম, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০৮:৩০, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সর্বশেষ

প্রাকৃতিক চিকিৎসা আধুনিক চিকিৎসার পরিপূরক

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রাকৃতিক উৎস থেকে তৈরি ওষুধের চাহিদা ক্রমবর্ধমান। এ চাহিদার কারণ হিসেবে প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতি মানুষের আস্থা বৃদ্ধি এবং কেমিক্যালভিত্তিক ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য। প্রাকৃতিক চিকিৎসা এমন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি, যা প্রকৃতির উপাদান এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে সহায়তা করে। এটি আধুনিক চিকিৎসার বিকল্প নয়; বরং পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে পারে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান রোগ নির্ণয় ও দ্রুত নিরাময়ের জন্য কার্যকরী হলেও, অনেক ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক চিকিৎসার মাধ্যমে দেহের প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানো এবং দীর্ঘমেয়াদি সুস্থতা অর্জন সম্ভব।

বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও প্রাকৃতিক চিকিৎসার গুরুত্ব স্বীকার করেছে এবং বিভিন্ন দেশে ঐতিহ্যবাহী ভেষজ চিকিৎসা গবেষণার ওপর জোর দিচ্ছে। বর্তমানে গ্লোবাল ওষুধ শিল্পেও প্রাকৃতিক উৎস থেকে তৈরি ওষুধের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকান পাইজিয়াম ছাল প্রোস্টেট সমস্যার সমাধানে ব্যবহৃত হচ্ছে, আর গুগুল গাছের রজন কোলেস্টেরল কমানোর জন্য কার্যকরী হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়া, ওক গাছের ছাল রক্তক্ষরণ কমাতে সাহায্য করে এবং জিনসেং উদ্ভিদ দেহের শক্তি ও কর্মক্ষমতা বাড়াতে ব্যবহৃত হয়। ননি ফল, যা দক্ষিণ এশিয়ায় জনপ্রিয়, তা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং পেটের সমস্যা সমাধানে উপকারী বলে মনে করা হয়।

প্রাচীনকালে ঔষধি গাছ নিয়ে গবেষণা মূলত অভিজ্ঞতাভিত্তিক ছিলো। আয়ুর্বেদ, ইউনানি, এবং চীনা ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা ব্যবস্থায় ঔষধি গাছের ব্যবহার শুরু হয়েছিলো হাজার হাজার বছর আগে। কালমেঘ লিভারের রোগ নিরাময়ে, তুলসী শ্বাসকষ্ট ও ঠান্ডা কমাতে এবং থানকুনি হজমশক্তি বৃদ্ধি ও ক্ষত নিরাময়ে ব্যবহৃত হতো। এই জ্ঞান সাধারণত প্রজন্মের পর প্রজন্ম মৌখিকভাবে সংরক্ষিত ছিলো। প্রাচীন মিশরীয় ও গ্রিক চিকিৎসাশাস্ত্রেও বিভিন্ন উদ্ভিদের ব্যবহার দেখা যায়। মিশরীয়রা অ্যালোভেরাকে ত্বকের যত্ন ও ক্ষত নিরাময়ে ব্যবহার করতো। আর গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস উইলো গাছের বাকল থেকে ব্যথানাশক তৈরি করেছিলেন, যা পরবর্তীতে অ্যাসপিরিন তৈরির উৎস হয়েছে।

অপরদিকে, আধুনিক ফার্মাকোগনসি বিজ্ঞানের ভিত্তিতে আরো সংগঠিত এবং পরিমাপযোগ্য। হলুদের সক্রিয় উপাদান কারকিউমিন প্রদাহপ্রতিরোধী হিসেবে কাজ করে, যা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত। আদায় উপস্থিত জিঞ্জারল এবং শোগাওল আর্থ্রাইটিসের প্রদাহ এবং ব্যথা উপশমে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া, পেয়ারা পাতার নির্যাস ডায়রিয়া ও পেটের ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর, আর তুলসী শুধু ঠান্ডা-কাশি নয়, বরং মানসিক চাপ কমাতেও সাহায্য করে।

তা ছাড়া, গ্রিন টি-তে থাকা ক্যাটেচিন হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে এবং ব্রাহ্মী শাকে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট শরীরকে ডিটক্সিফাই করতে সাহায্য করে। ব্রাহ্মীতে ব্যাকোসাইড নামে একটি রাসায়নিক থাকে, যা স্নায়ুকোষের অবক্ষয় অনেকটাই বন্ধ করে দেয় এবং মস্তিষ্কের কিছু রাসায়নিকের ক্ষরণ বাড়ায়, ফলে স্মৃতিভ্রম কমে।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল বোটানিক্যাল গার্ডেন দেশের বৃহত্তম উদ্ভিদ সংরক্ষণ কেন্দ্র। এটি প্রায় ৮৪ হেক্টর (২১০ একর) এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এখানে ৫৬০ প্রজাতির ঔষধি উদ্ভিদ সংরক্ষিত রয়েছে। জাতীয় বোটানিক্যাল গার্ডেন উদ্ভিদ সংরক্ষণ, গবেষণা এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখানে সংরক্ষিত ঔষধি উদ্ভিদগুলো আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং ফার্মাকোগনসি চর্চার জন্য অমূল্য সম্পদ।

বিশেষত, কস্তুরি মেথি শুধু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেই নয়, এটি চুলের বৃদ্ধি বাড়াতেও ব্যবহৃত হয়। অপরদিকে, রুদ্রাক্ষ গাছের বীজ মানসিক চাপ কমাতে ও ধ্যানের সময় মনঃসংযোগ বাড়াতে সহায়ক বলে বিশ্বাস করা হয়। এই গার্ডেনের অনন্য উদ্ভিদ সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে মহুয়া, কৃষ্ণচূড়া, শ্বেত চন্দন, আমলকী, বাওবাব ইত্যাদি। এসব উদ্ভিদ শুধুমাত্র প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে না বরং ঔষধি গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

উদ্যানের লতা-গুল্ম ও বৃক্ষের বিশাল সংগ্রহে রয়েছে ২২ প্রজাতির বাঁশ, ১৬ প্রজাতির ইউক্যালিপটাস এবং আকাশমণি। এ ছাড়া বিশেষ ভেষজ উদ্ভিদের বাগানে কালমেঘ, পুনর্নভা, শতমূলী এবং তেলাকুচার মতো উদ্ভিদ স্থান পেয়েছে, যা হজমশক্তি বৃদ্ধি, প্রদাহ নিরাময় এবং লিভারজনিত রোগের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

এই কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ঔষধি গাছ এবং তাদের কার্যকারিতা সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান লাভ করেছেন। শিক্ষার্থীরা ঔষধি গাছের বিভিন্ন প্রজাতি, তাদের চাষাবাদ, সংগ্রহ এবং ঔষধি ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা লাভ করেন।

বিশ্বজুড়ে হারবাল ওষুধের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের উদ্যোগ ভবিষ্যৎ গবেষকদের উদ্ভিদ ভিত্তিক ওষুধের কার্যকারিতা বিশ্লেষণ এবং নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবনে উৎসাহিত করবে। বিশেষ করে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে ঔষধি গাছের সংরক্ষণ ও গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ভবিষ্যতে, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে, প্রাকৃতিক উৎস থেকে ওষুধ প্রস্তুত করার প্রযুক্তি আরো উন্নত করার প্রয়োজনীয়তা বাড়বে। হারবাল চিকিৎসা কেবল ব্যক্তিগত সুস্থতার জন্যই নয়, বরং বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার টেকসই উন্নয়নের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

লেখক: প্রভাষক, ফার্মেসি বিভাগ, ইউআইটিএস

(মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন)

 

জনপ্রিয়