
পিয়ন থেকে দারোয়ান বদলি ব্যবস্থা চালু আছে সবার। বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি দরকার তা সরকার বাহাদুরকে বুঝাতে সময় লেগেছে ৩০ বছর। একের পর এক কর্মশালা-সেমিনার ও সভা করেও কর্মকর্তারা বদলি চালু করতে যাচ্ছেন, তা সব শিক্ষকদের জন্য নয়।
শুধু অল্প সংখ্যক শিক্ষকদের জন্য বদলি চালু করতে যাচ্ছেন। এখন তাহলে প্রশ্ন জাগে সকল শিক্ষক-কর্মচারীর বদলি চালু করতে কত বছর সময় লাগবে? বেসরকারি শিক্ষকতায় পেশা নয়, শিক্ষকদের সঙ্গে তুঘলকি কান্ড ঘটছে। একের পর এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে।
শিক্ষকদের কফিনে সর্বশেষ পেরেকটি মারলো মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর । গত ১৯ ডিসেম্বর বেসরকারি শিক্ষকদের একাংশ, শুধুমাত্র গুটি কয়েক শিক্ষকদের বদলি চালু করতে যাচ্ছে মাউশি। শিক্ষকরা এমনি নানা টানাপড়েনের মধ্যে থাকেন। ভয়ে-ভয়ে থাকেন, কখন মব জাস্টিসের শিকার হন কেউ বলতে পারেন না।
সব শিক্ষকদের বদলি চালু না করে শুধু মাত্র এনটিআরসিএ কতৃক সুপারিপ্রাপ্ত শিক্ষকদের বদলি চালু কতটুকু যৌক্তিক? এই নাতিমালা ফ্যাসিস্ট শাসন আমলের তৈরি। গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শাসন আমলের নীল নকশা হলেও তা এখনও বাতিল হয়নি। একই প্রতিষ্ঠানে কেউ বদলি হবেন, কেউ হবেন না, এটা কেমন বৈষম্য। অথচ মানুষ স্বপ্ন দেখেছিলো বৈষম্য বিরোধী দেশে আর নতুন করে কোনো বৈষম্য হবে না।
বেসরকারি আর সরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বেতনে সুযোগ-সুবিধায় পাহাড়সম বৈষম্য। এখন আবার বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি হতে যাচ্ছে। কেউ বদলি পাবে কেউ পাবে না। বদলি অনার্থিক বিষয় এটাতেও বৈষম্য। আমরা আর কত রক্ত দিলে বৈষম্যের অবসান হবে। হে আবু সাইদ মুগ্ধ এসে দেখে যাও!
এনটিআরসিএর প্রধান কাজ হলো বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগের জন্য প্রার্থী বাছাই করার কাজ। এনটিআরসিএ যেহেতু নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ নয়, তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হয়।
এতে বুঝা যায় যে কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ পেয়ে থাকেন সব শিক্ষক। এখন প্রশ্ন হলো তাহলে কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া অন্যান্য শিক্ষকদের কি দোষ। সনদবিহীন শিক্ষকরা কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন, সনদধারীরাও কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন, এনটিআরসিএ বাছাই করা শিক্ষকরাও কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন।
একই মাতা হয়ে কেনো বিমাতা সুলভ আচরণ? কার স্বার্থে, এই নীতিমালা। শুধু নিয়োগের ধরণটা ভিন্ন। আবার বিভিন্ন বিভিন্ন সময়ে নিয়োগের ধরন বদল হয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। এতে শিক্ষকদের দোষ কোথায়। ভিন্ন সময়ে ভিন্ন নিয়মে শিক্ষক নিয়োগ হলেও সবার এক পরিচয় হয়ে গেছে, সবাই ইনডেক্সধারী শিক্ষক। তারপরও এই বৈষম্য কেনো, একই প্রতিষ্ঠানে কেউ বদলি পাবে, কেউ পাবেন না, এ কেমন আচরণ।
বদলি শুধু এনটিআরসিএ কর্তৃক বাছাইকৃত শিক্ষকদের দরকার। অন্যান্য শিক্ষকদের ঘর-বাড়ি নেই, মা-বাবা অসুস্থ হন না, ছেলে-মেয়ের জন্য দুচিন্তা হয় না। ৫০০ মাইল দূরত্বে থাকেন না। বদলি শুধু একটা ক্ষুদ্র অংশের দরকার। সত্যিকার অর্থে বদলি চালু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষকদের দরকার।
বিশেষ করে প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সহকারী প্রধানদের আরো বেশি বেশি করে বদলি চালু করা দরকার। কেননা গত বছরের ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন অঞ্চলের বেসরকারি স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের এমপিওভুক্ত অনেক শিক্ষক জোরপূর্বক পদত্যাগের স্বীকার হয়েছেন, বরখাস্ত বা বহিষ্কৃত হয়েছেন, কর্মস্থলে পলাতক বা অনুপস্থিত রয়েছেন অথবা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন।
শিক্ষার্থীদের লাঞ্ছনা সহ্য করতে না পেরে অনেক শিক্ষক মৃত্যুবরণ পর্যন্ত করেছেন। কেউ কেউ মারধরের শিকার হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। জোর করে পদত্যাগ করা অনেক শিক্ষক ভয়ে প্রতিষ্ঠানে আর যেতে পারছেন না। এমন অনেক শিক্ষক বেতন-ভাতাও পাচ্ছে না।
এতে স্কুল-কলেজ পর্যায়ের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই চলছে এমন অস্থিরতা। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বদলি থাকলে এভাবে হাজার-হাজার শিক্ষক নির্মম নির্যাতনের শিকার হতেন না। মব জাস্টিসের রোশানলে পড়তেন না। তাই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সকলের শিক্ষকদের বদলি চালু করা জরুরি।
স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে আর্থিক ও সুযোগ সুবিধায় পাহাড়সম বৈষম্য তৈরি হয়েছে। এখন বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে অনার্থিক বিষয় বদলি নিয়ে অমানবিক বৈষম্যমূলক আচরণ করছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর। যেখানে সরকারি ও বেসরকারি বৈষম্য দূরীকরণের জন্য মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
সেখানে বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বদলি নিয়ে বিভাজন তৈরি হয়েছে। কারা বদলি পাবেন, কারা বদলি পাবেন না, তা নিয়ে তুমুল সংঘর্ষ চলছে বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে। এ যেনো ব্রিটিশ শাসন আমলের মত নীতিমালা তৈরি হয়েছে শিক্ষকরা নিজেদের মধ্যে কাদাছোড়াছুড়ি করবে।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আমাদের ভাগ করবে, আর শাসন করবে ব্রিটিশদের মতো। সর্বশেষ বদলি চালু স্থগিত করবে, নয় অন্য পক্ষ হাইকোর্টের সর্বজনীন রায়ের কপি নিয়ে আইনের আশ্রয় নিবে। অতএব বদলি কেউ আর হতে পারবেন না।
তাই সবার জন্য একই নিয়ম করে সর্বজনীন বদলি চালু হোক। এতে সবাই উপকৃত হবে। সব শিক্ষকদের মঙ্গল হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা ঝগড়া-বিবাদ থেকেও বিরত থাকবেন। কার বদলি দরকার, কার বদলি হবে না এ নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে কথা কাটাকাটি চলছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীদের সর্বজনীন বদলি চালু করে শিক্ষকদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা হোক।
বেসরকারি শিক্ষকদের জাতীয়করণসহ বিভিন্ন দাবি রয়েছে। তার মধ্যে আর্থিক ও অনার্থিক বিষয় রয়েছে। বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি চালু এটা অনার্থিক বিষয় তারপরও বদলি চালুতে বৈষম্য কেনো? বদলি নীতিমালায় বলা হয়েছে, বদলি নাকি এনটিআরসিএ সুপারিশ প্রাপ্ত শিক্ষকদের। কমিটি নিয়োগ প্রাপ্তদের কেনো নয়?
আবারও বৈষম্যের ফাঁদে বেসরকারি শিক্ষকরা। এখানে এনটিআরসিএ সুপারিশপ্রাপ্ত, কমিটি নিয়োগে বিভক্ত করা হয়েছে। অথচ এনটিআরসিএ সুপারিশপ্রাপ্ত নিয়োগের পূর্বেই এমপিও নীতিমালায় বদলি চালুর কথা বলা হয়েছে। এমনকি আদালতের নির্দেশ রয়েছে সব শিক্ষকদের বদলির কথা বলা হয়েছে।
বদলি চালুর কথা শিক্ষানীতি, শিক্ষা আইন এমনকি প্রতিটা এমপিও নীতিমালায় ১৯৯৫, ২০০৫,২০১০ ও ২০১৮ নীতিমালায় বিভিন্ন অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। কথায় আছে, ঘুমন্ত মানুষকে জাগানো গেলেও যে জেগে ঘুমায় তাকে জাগানো যায়না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এনটিআরসিএর সুপারিশের বাইরে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের অধিকাংশ নিজ জেলা অথবা পাশের জেলায় চাকরি করছেন। সময়ের প্রয়োজনে কমিটি নিয়োগ বাতিল হয়েছে। এনটিআরসিএ নিয়োগ দিচ্ছে, নিয়োগ দিচ্ছে বললেও ভুল হবে।
প্রার্থী বাছাই করে দিচ্ছে এনটিআরসিএ, মূলত নিয়োগ হচ্ছে কমিটির মাধ্যমে। এখন প্রশ্ন হলো যেভাবে নিয়োগ হোক প্রতিষ্ঠান তো এক। এক প্রতিষ্ঠানে কেউ বদলি হবে কেউ হবে না এটা কোন প্রতিষ্ঠানে আছে। এ এক চরম অমানবিক বৈষম্য।
বহুধা বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা। ধারা উপধারায় বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা। তেমনি বেসরকারি শিক্ষকদের সংগঠন যে কয়টি তা বলা কঠিন। নানান ভাবে শিক্ষক সংগঠনগুলো বিভক্ত। তারা এক হতে পারেন না। শিক্ষকদের কোনো দাবি দাওয়াও পূরণ হয় না।
বরং শিক্ষকদের পকেট থেকে ৪ শতাংশ টাকা কেটে নেয়া হলো কিন্তু আমরা প্রতিবাদ করতে পারিনি। এখন আবার বদলি চালুতে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। এই বৈষম্য কে ভাঙবে। বৈষম্য বিরোধীদেশে মানুষ স্বপ্ন দেখেছিলো আর কোনো বৈষম্য হবে না। বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি চালু এটা অনার্থিক বিষয়। এখানেও বৈষম্য তৈরি করা হলো।
সব শিক্ষকদের বদলি চালু নাকি জটিল বিষয়। শিক্ষকরা প্রতিনিয়ত সর্বজনীন বদলি চালুর কথা বলে আসছেন। কেউ ৩০ বছরে বদলি হতে পারেননি, কেউ ২ বছরে বদলি হবেন একই প্রতিষ্ঠান থেকে এ কেমন বৈষম্য তৈরি হতে যাচ্ছে! কর্মকর্তা ও মন্ত্রণালয়ের ইচ্ছা থাকলে সর্বজনীন বদলি চালু করা সম্ভব। আর কোনো বৈষম্য চাই না। সব ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের বদলি চালু করে, অন্তত শিক্ষকদের মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিন।
লেখক: শিক্ষক, দিরাই, সুনামগঞ্জ