ঢাকা শনিবার, ২৪ মে ২০২৫ , ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’: সাধু সাবধান!

মতামত

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ

প্রকাশিত: ০৭:৪০, ২৪ মে ২০২৫

সর্বশেষ

ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’: সাধু সাবধান!

চলতি মাসের ১১ তারিখে ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত একটি খবর বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ফেসবুকে পোষ্ট করা খবরটি ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রিক। ‘ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাস’ শিরনামে লেখা ফেসবুক পোষ্টটির হুবুহু লেখাটি হচ্ছে, ‘বঙ্গোপসাগরে একটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির প্রবল আশঙ্কা করা যাচ্ছে মে মাসের ২৩ তারিখ থেকে ২৮ তারিখের মধ্যে।

সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়টির নাম হবে ‘শক্তি’ (শ্রীলঙ্কার দেয়া নাম) ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের ওড়িশা উপকূল ও বাংলাদেশের চট্টগ্রাম উপকূলের মধ্যবর্তী যে কোনো স্থানের ওপর দিয়ে স্থল-ভাগে আঘাত করার প্রবল আশঙ্কা করা যাচ্ছে। ২৪ থেকে ২৬ মের মধ্যে। তবে সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত বেশি পশ্চিমবঙ্গ ও খুলনা বিভাগের ওপর দিয়ে স্থল-ভাগে আঘাত করার।’ এই পোষ্টটি যিনি লিখেছেন তার নাম মোস্তফা কামাল পলাশ। তিনি একজন আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষক হিসেবে পরিচিত।

‘ঘূর্ণিঝড়’ মানে হচ্ছে, এটি একটি নিম্নচাপযুক্ত এলাকা। ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র হচ্ছে সেই অঞ্চলের সর্বনিম্ন বায়ুমণ্ডলীয় চাপের এলাকা। কেন্দ্রের কাছে, চাপের গ্রেডিয়েন্ট বল (ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রে চাপের তুলনায় ঘূর্ণিঝড়ের বাইরের চাপের তুলনায়) এবং কোরিওলিস প্রভাবের বল আনুমানিক ভারসাম্যে থাকে, অন্যথায় চাপের পার্থক্যের ফলে ঘূর্ণিঝড়টি নিজেই ভেঙে পড়ে। ইংরেজ বিজ্ঞানী হেনরি পিডিংটন ‘ঘূর্ণিঝড়’ বা ‘সাইক্লোন’ নামটির প্রবক্তা। 

গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড় নিয়ে তার গবেষণাপত্র ৪০টি। এগুলো তিনি ‘দ্য জার্নাল অব দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি’-তে প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি ‘সাইক্লোন’ শব্দটিও প্রবর্তন করেন, যার অর্থ ‘সাপের কুণ্ডলী’।

২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’-এর কারণে বাংলাদেশে এক ভয়ংকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। স্যাফির-সিম্পসন ঘূর্ণবাত বায়ুপ্রবাহ মাপনি যা সংক্ষেপে ‘এসএসএইচডাব্লিউএস’-তে ‘রেমাল’-কে গত ১ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে আঘাত হানা সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

ওয়ার্ল্ড ওয়েদার ইনফরমেশন সার্ভিস থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশ প্রতিবছর গড়ে অন্তত ৪ বার ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে। বৈশিষ্ট্যগতভাবে, বেশিরভাগ ঘূর্ণিঝড় কেবল বাংলাদেশের প্রভাব বলয়ে প্রবেশ করে না বরং স্থলভাগেও আঘাত হানে।

পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, তুলনামূলকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল হচ্ছে, চট্টগ্রাম, খুলনা এবং ঢাকা। সাধারণত ঘূর্ণিঝড়ের মৌসুম গ্রীষ্মকালীন বর্ষার ওপর নির্ভর করে। এর আগের (মে থেকে জুন) এবং পরে (অক্টোবর থেকে নভেম্বর) মাসগুলোতে সবচেয়ে তীব্র ঝড় হয়।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেখানে জলবায়ু সংক্রান্ত সমস্যায় মানবিকতা বিঘ্নিত হয়েছে বা হচ্ছে এমন দেশগুলোয় সরেজমিনে কাজ করছেন ফ্রান্সের সাংবাদিক ম্যানুয়েল ক্যালোকুইস্পে ফ্লোরেস। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে তিনি এসব বিষয়ে কাজ করছেন।

যেসব দেশে আপদকালীন সংকটে জাতিসংঘসহ অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবক সংস্থাগুলো ত্রাণ নিয়ে যায়, সেগুলোর সুষ্ঠু বন্টন নিয়েও তিনি কাজ করছেন। ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ পূর্ববর্তী সময়ে সাংবাদিক ম্যানুয়েল ক্যালোকুইস্পে ফ্লোরেস বাংলাদেশে এসেছিলেন।

তিনি বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত এবং আক্রান্ত এলাকার মানুষের অসহায়ত্বের কথা জাতিসংঘের কাছে তুলে ধরেন। এক প্রতিবেদনে তিনি লেখেন, ‘২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬ টায় বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলায় ওই সময় বাতাসের গতিবেগ ছিলো প্রতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার এবং সেই সময় এর ব্যাস ছিলো ১০৩ কিলোমিটার। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সাফির-সিম্পসন শ্রেণিবিভাগ অনুসারে, এটি একটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড় ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিলো। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে ‘রেমাল’ সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়।

বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে সার্বিক সহায়তা প্রদানের আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। তার সেই আবেদন বিশ্ববাসীর কাছে সাড়া জাগায়। তার প্রতিবেদনটি ইউএনএইচসিআর-এ প্রকাশিত। চলতি বছরে স্যাফির-সিম্পসন স্কেলে কমপক্ষে ৩ নম্বর শ্রেণিতে পৌঁছানো নয়টি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়ের স্যাটেলাইট ছবি জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে পাওয়া গেছে।

এর মধ্যে, ভিন্স (প্রথম সারিতে তৃতীয় চিত্র) সবচেয়ে তীব্র, যার সর্বনিম্ন কেন্দ্রিয় চাপ প্রতি ঘণ্টায় ৯২৩ কিলোমিটার। স্যাফির-সিম্পসন জানায়, ‘গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় সাতটি প্রধান জলাশয়ে তৈরি হবে, যা সাধারণত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় অববাহিকা নামে পরিচিত। সাম্প্রতিক সময়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিভিন্ন আবহাওয়া সংস্থা গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করবে। যেমন ‘শক্তি’-এর নামকরণ করেছে শ্রীলঙ্কা। চলতি বছরের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় হলো ঘূর্ণিঝড় ‘ভিন্স’ যার সর্বনিম্ন গতি বেগ ছিলো প্রতি ঘণ্টায় ৯২৩ কিলোমিটার।

ঘূর্ণিঝড়ের আর্কাইভ ঘেঁটে জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে শীর্ষ স্থানে রয়েছে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’। ‘আম্ফান’ ছিলো অত্যন্ত শক্তিশালী এবং বিপর্যয়কর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়। এর প্রভাবে পূর্ব ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশায় এবং বাংলাদেশে ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়।

এটি ছিলো গাঙ্গেয় বদ্বীপে আঘাত হানা সবচেয়ে শক্তিশালী গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘আম্ফান’ ছিলো একটি বিরল ঘূর্ণিঝড়, যা ২১ মে ভোরে প্রবল বাতাসের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজশাহী থেকে রংপুর পর্যন্ত উত্তরাঞ্চলে ওপর আঘাত হানে। এটি রাজশাহী ও রংপুরের আম উৎপাদনে মারাত্মক ক্ষতি করে।

আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’-এর সঙ্গে ‘আম্ফান’-এর সাদৃশ্য রয়েছে। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’ ১৩ মে শ্রীলঙ্কার কলম্বো থেকে কয়েকশ মাইল (৩০০ কিলোমিটার) পূর্বে অবস্থিত একটি নিম্নচাপ অঞ্চল থেকে উদ্ভূত হয়েছিলো। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ মে ‘আম্ফান’ সিস্টেমটিকে একটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় নিম্নচাপে উন্নীত করে এবং পরের দিন ভারত আবহাওয়া বিভাগ (আইএমডি) একইভাবে পরিস্থিতি অনুসরণ করে। ১৭ মে ‘আম্ফান’ দ্রুত তীব্রতা অর্জন করে এবং ১২ ঘণ্টার মধ্যে একটি অত্যন্ত তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়। সেই সময়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হলে, হয়তো ক্ষয়-ক্ষতি এবং বহু প্রাণ বাঁচানো যেতো বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করেন।

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডাব্লিউএমও)-এর সর্বশেষ তথ্য মতে, ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’ ও ‘আম্ফান’-এর সঙ্গে ঠিক কতোটা সাদৃশ্যময় সেটা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করার মতো পর্যাপ্ত সময় হাতে নেই। সিস্টেমটি ট্র্যাক করার জন্য স্যাটেলাইট ডেটা ব্যবহার করে তারা জানিয়েছে, ‘উষ্ণ সমুদ্রের তাপমাত্রার কারণে প্রায়শই মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ঘূর্ণিঝড়ের সঞ্চালন তীব্র হয়। বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বর্তমানে ২৯-৩০° সেলসিয়াস, যা ঘূর্ণিঝড় গঠনের জন্য আদর্শ। বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’ আছড়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং চলতি মাসের ২৩ মে থেকে ২৮ মের মধ্যে এটি আঘাত হানতে পারে।

আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’ ২৪ থেকে ২৬ মের মধ্যে স্থলভাগে আঘাত হানতে পারে। সম্ভাব্য আঘাতের এলাকা ভারতের ওড়িশা উপকূল থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের খুলনা বিভাগ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ উপকূল। এখনো ঘূর্ণিঝড়টি তৈরি হয়নি। তবে বঙ্গোপসাগরে যে পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, তা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য অনুকূল বলে জানিয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যম।

পরিস্থিতি যেমন যাচ্ছে, এতে করে ঘূর্ণিঝড় তৈরি হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাই সবাইকে আগাম সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানানো হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়টি যদি বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসে, তাহলে উপকূলীয় এলাকায় ঝড়ো হাওয়া, ভারি বৃষ্টি এবং জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা রয়েছে। এতে মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতির ঝুঁকি বাড়বে।

বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে আঘাত হানা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়ের ফলে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে প্রায় ১ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন মানুষ নিহত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’র ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পারছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা।

তাদের কেউ কেউ বলছেন, ‘বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় শক্তি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম বড় ঝড় হতে পারে’ এবং ‘ঘূর্ণিঝড় শক্তি ২০২৫ পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে ভারী বৃষ্টিপাত আনতে পারে।’ বিশেষজ্ঞরা উপকূলীয় এলাকার মানুষদের এখন থেকেই সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। বিশেষ করে মাছ ধরার ট্রলার ও নৌকাগুলোকে নিরাপদ স্থানে রাখার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আশঙ্কায় যেকোনো সময় আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকার কথাও বলা হয়েছে। অর্থাৎ ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’র মোকাবিলায় নিজেদের সর্বাত্মক শক্ত বলয় গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

 

জনপ্রিয়