ঢাকা শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫ , ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

প্রসঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষকদের জবাবদিহিতা

মতামত

মো. সিদ্দিকুর রহমান

প্রকাশিত: ০৭:৩০, ২৩ মে ২০২৫

সর্বশেষ

প্রসঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষকদের জবাবদিহিতা

প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতি না হলে শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হবে। গত ৪ মে লক্ষীপুরে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার এমন বক্তব্যটি দেন।

তিনি বলেছেন, প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন না হলে অদক্ষ জনবল তৈরি হবে। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতি না হলে, আমাদের ভবিষ্যৎ কখনো ভালো হবে না। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, বিদ্যালয়ের পরিদর্শনের সময় বাচ্চা পড়াশোনা পারে কি না তার ওপর বেশি গুরুত্ব দেবেন। যদি কোনো বিদ্যালয়ের পারফরম্যান্স ভালো না হয়, তবে শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তাকে কারণ দর্শাতে হবে। যদি শিক্ষার উন্নতি না ঘটে, তাহলে শাস্তির ব্যবস্থা নেবেন।

উপদেষ্টার বক্তব্যটি শুধুমাত্র শিক্ষক ও তৃণমূলের কর্মকর্তাদের ওপর বর্তায়। বাস্তবে প্রাথমিক শিক্ষা মানসম্মত না হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি দায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, মন্ত্রী, সচিব ও মহাপরিচালকসহ নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তাদের ওপর বর্তায়। প্রাথমিক শিক্ষকেরা যেসব একেবারে ধোয়া তুলসী পাতার মতো পবিত্র এ কথা বলার অবকাশ নেই।

পানি বা তরল পদার্থ নিচের দিকে গড়াবে এটাই স্বাভাবিক। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন ব্যাহত হওয়ার পেছনে শিক্ষক কর্মকর্তাসহ সবার দায় আছে। অনুসন্ধান করে সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান হল মানুষের মৌলিক চাহিদা। এই চাহিদা নিশ্চিত করার বিষয়ে রাষ্ট্র বা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। ব্যক্তি শ্রেণিসহ রাষ্ট্রের সহযোগিতা ছাড়া ভালোভাবে চাহিদাগুলো নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষক, অভিভাবক সর্বোপরি সব স্তরের কর্মকর্তা, উপদেষ্টা, মন্ত্রি, সচিব মহাপরিচালকসহ সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। যেকোনো পর্যায়ে অবহেলা বা ভুল সিদ্ধান্ত প্রাথমিকের শিক্ষা মানসম্মত বিঘ্ন হবে। যেমন-অভিভাবকের রীতিমত সন্তানকে বিদ্যালয়ে না পাঠালে, শিক্ষক পাঠদান কার্যক্রম যথাযথভাবে না করলে, সর্বস্তরের কর্মকর্তা যথাযথভাবে কার্যক্রম পরিচালনার না করাসহ উল্লেখিত সবাইকে যথাযথভাবে শিক্ষক তথাবিদ্যালয়ের চাহিদা পূরণ না করলে, ‘বাবু ও মাঝি’ কবিতার সারমর্মের মতো ষোল আনাই মিছে, মানসম্মতের প্রাথমিক শিক্ষার কার্যক্রম হবে।

শিক্ষার মধ্যে শিশু শিক্ষা হলো ভিত। এ ভিতকে মজবুত করার লক্ষ্যে সরকার প্রধান, অর্থ মন্ত্রণালয়, প্রাথমিকের উপদেষ্টা, সচিব ও মহাপরিচালক সবাইকে উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাজেটে বরাদ্দ করা প্রয়োজন। যাতে শিশুদের মানসম্মত শিক্ষার জন্য অর্থের ঘাটতি না নয়।

অনাহুত সময়ক্ষেপণ না করে ৩২ হাজার সহকারী শিক্ষককে প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ পদোন্নতি কাম্য। সহকারী শিক্ষকদের শূন্যপদ পূরণে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, এমনকি যুগও অতিক্রম হচ্ছে পদ শূন্য, পদোন্নতি শূন্য বা নানা সমস্যা জিইয়ে রেখে শুধু তৃণমূলের কর্মকর্তা সহকারী শিক্ষকদের ওপর জবাবদিহিতা বা শাস্তির হুঁশিযারি দেয়া কতোটা যৌক্তিক?

পরিবার সমাজ তথা রাষ্ট্র সব শিশুদের ওপর অপরিসীম নির্যাতন চালাচ্ছে। অভিভাবক বলবেন, শিশুর দ্রুত বৃদ্ধির তথা মহাবিদ্যান হওয়ার জন্য খাদ্য ও লেখাপড়ার জন্য চাপ দিচ্ছি। সমাজে বলবে, খাওয়া-দাওয়া তথা শিক্ষার জন্য প্রেসার দেয়া যথার্থ। সাবেক মন্ত্রী, সচিব, মহাপরিচালকসহ বর্তমানরা ও শিশুর ওপর পড়াশোনায় অত্যাধিক চাপ দিয়ে বিশ্বের মহাবিদ্যানে পৌঁছে দেয়ায় বিশ্বাসী। হে চাপাচাপির মহাবিপ্লব জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো আজ নিদারুণ শিক্ষার্থী সংকটে।

সম্মানিত মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিব, মহাপরিচালকসহ নীতি-নির্ধারকরা প্রাথমিক শিক্ষায় খুব বেশি দক্ষ অভিজ্ঞ নয়। শিশু মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে তাদের ব্যাপক তেমন ধারণা নেই। প্রকৃত শিশু শিক্ষা দিতে হলে, তাদের বয়স, রুচি ও সামর্থের কথা বিবেচনা করতে হবে। শিশু কতো সময় এক নাগাড়ে মনোযোগ ধারণ করতে পারে, এই বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রাথমিক বিদ্যালয় এক শিফটের কার্যক্রমের কারণে প্রাথমিক শিক্ষার্থী সংকট তলানিতে নেমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। ‘কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন’ এই ব্যবস্থা শিশুশিক্ষার কার্যকর না করে শিশুর শারীরিক মানসিক বিকাশে বয়স, রুচি, সামর্থ্য অনুযায়ী শিশুবান্ধব সময়সূচি প্রবর্তন হলে, প্রাথমিক বিদ্যালয় হবে শিশুদের স্বর্গ। বিদ্যালয়গুলো অস্তিত্ব সংকটের হাতে রেখে রক্ষা পাবে। বর্তমান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচি হল সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কার্যক্রম ৯টা ১:১৫মিনিট পর্যন্ত। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির কার্যক্রম ৯টা থেকে ৩:৩০টা পর্যন্ত। বাকি ৪৫ মিনিট হলো দুর্বল শিক্ষার্থীর পাঠদান।

অপরদিকে, কিন্ডারগার্টেনসহ বেসরকারি-সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখার কার্য্যক্রম দুপুর ২টার মধ্যে সমাপ্ত হয়। তারা বাড়িতে এসে, গোসল সেরে গরম গরম খাবার খেয়ে থাকে। দুপুরে ঘুমিয়ে বা বিশ্রাম নিয়ে ফুরফুরে মেজাজে খেলতে বা ঘুরাফেরা করতে পারে।

এতে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সমৃদ্ধ হয়। অপরদিকে, দীর্ঘসময় প্রাথমিকের শিশুরা বিদ্যালয়ে অবস্থান করে দুপুরে গরম খাবার থেকে বঞ্চিত হয়ে, ক্ষুধার যন্ত্রণায় পিঠ পেট একাকার হয়ে খাবারের থলি সংকুচিত হয়ে পড়ে। বিকালবেলা খেলাধুলা বা বিনোদন আর হয়ে ওঠে না। যার ফলে অপুষ্টি শারীরিক মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ বা মানসিক রোগীতে পরিণত হয়। প্রাথমিকসহ সব শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুপুরে দুইটার মধ্যে শিশুবান্ধব শিক্ষা কার্যক্রম হোক-এই কামনা করছি।

বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষার অস্তিত্ব সমূলে বিপর্যস্ত করার আরেকটি চক্রান্ত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাহলো শনিবার প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা রাখা। কন্ট্রাক আওয়ার বৃদ্ধির নামে এ অপতৎপরতা। বেশি চাপাচাপি করলে মিষ্টি রসের পরিবর্তে তিতা রস বের হবে। শিক্ষকতা পেশার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন পেশা প্রাথমিকের শিক্ষকতা।

শিক্ষার্থীদের চিল্লা-চিল্লি, হৈ-চৈ, একনাগাড়ে ৭টা থেকে ৮টি ক্লাস নেয়ার মধুর অভিজ্ঞতা নেয়ার জন্য, প্রাথমিকের উপদেষ্টা, সচিব, মহাপরিচালকসহ কনসালটেশন কমিটির সব সদস্যদের আহ্বান জানাই। আশাবাদী তারা একদিনের শ্রেণির কার্যক্রম করলে মানসিক রোগী হওয়ার উপক্রম হবে। মনে-প্রাণে উপলব্ধি করতে হবে, এই পেশায় শিক্ষক শিক্ষার্থীর শারীরিক ও মানসিক চাপ বেশি।

উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটির চেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছুটি বেশি প্রয়োজন। শিশুদের শিক্ষার বিষয়টি উপলব্ধি না করে, কোনোদিন যদি আমাদের কাজের অতিরিক্ত চাপ পড়ে, তখন শারীরিক ও মানসিক অবস্থা কেমন লাগে একটু ভাবুন। এ পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষাকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে কতিপয় পরামর্শ উপস্থাপন করা হলো-

১. প্রাথমিকের শিশুবান্ধব সময়সূচি সব শিশুর ক্ষেত্রে এক ও ও অভিন্ন হওয়া প্রয়োজন। ২. সব সরকারি বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিকের শাখা বন্ধ করা অতীব জরুরি। ৩. প্রাথমিকের কাছাকাছি সকল শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা প্রয়োজন। ৪. সহকারী শিক্ষকদের থার্ড ক্লাস মর্যাদা থেকে সেকেন্ড ক্লাস মর্যাদা দিয়ে ১০ম গ্রেডে যৌক্তিক প্রত্যাশা প্রদান করা।

৫. আদালত বা অন্য যেকোন সমস্যা এড়িয়ে সব প্রধান শিক্ষককে ১০ম গ্রেড প্রদান করা। ৬. সহকারী শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ পদোন্নতি দ্রুত দেয়া। ৭. শিক্ষক নিয়োগ পদোন্নতি জিরো টলারেন্স এ কার্যকর করা। ৮. অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত প্রাথমিক শিক্ষা বন্ধ করা থেকে বিরত থাকা।

সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন ও বিশ্বস্ত সচিব ফরিদ আহমেদ সিদ্ধান্ত মোতাবেক সহকারি শিক্ষকদের ১২ গ্রেড কতিপয় বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক পদের মুলা জুলানোসহ কনসালটেশন কমিটির প্রাথমিক শিক্ষা ধ্বংস তথা বেসরকারিকরণের ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করার আহ্বান জানাই।

প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সব পর্যায়ে জবাবদিহিতা তথা শাস্তির ব্যবস্থা কার্যকর হোক-এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: শিক্ষাবিদ

 

জনপ্রিয়