
কবি বলেছেন, প্রতিটি শিশুর মধ্যেই সুপ্ত আছে আগামী দিনের জাতির কর্ণধার। অভিভাবক, ভবিষ্যৎ শিল্পী, সাহিত্যিক, আলোকতীর্থের অভিসারী যুগাবতার ধর্মগুরু, ভবিষ্যতের ইতিহাসখ্যাত কীর্তিমান পুরুষ, বিজ্ঞানী ও আজকের শিশুদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে অনাগত দিনের নতুন ইতিহাস।
হাঁটি হাঁটি পা পা করে যে শিশুটি বেড়ে উঠছে। সংসার প্রাঙ্গণে আজকে যার ভীরু চরণধ্বনি, কালের ব্যবধানে সেখানে রচিত হবে তারই দৃপ্ত পদচারণা।
অথচ আমরা বেশিরভাগই উদাসীন তাদের যথোপযুক্ত পরিচর্যার বিষয়ে। শিশুদের বেড়ে ওঠা ও মানসিক বিকাশের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতকরণে, আগামী প্রজন্মের স্বপ্ন নির্মাণ ও বাস্তবায়নে। এ আমাদের অজ্ঞতা, অবজ্ঞা, নিষ্ঠুরতা ও চরম ব্যর্থতাও বটে।
আমরা প্রায় ভুলে যাই আজকে যে শিশু, সেই ভবিষ্যতের উজ্জ্বল সম্ভাবনার বলিষ্ঠ অঙ্গীকার, যার কর্মসাধনায় পরিচালিত হবে গোটা জাতি, রচিত হবে জাতির গৌরব-ইতিহাস এবং বাস্তবায়িত হবে আগামীর স্বপ্ন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য শিশুরও যে অধিকার থাকতে পারে তা এ দেশের বেশিরভাগ মানুষেরই অজানা।
আমাদের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অতি ক্ষুদ্র একটি অংশই শুধু শিশুদের নিয়ে ভাবেন এবং তাদের সার্বিক বিকাশ সাধনের জন্য তৎপর থাকেন। বাকিরা শিশুদের ভাগ্য নিয়তির হাতে ছেড়ে দিতেই বেশি পছন্দ করেন।
যে পরিবারে মা-বাবা দুজনই চাকরিজীবী সে পরিবারে শিশুরা জন্মলগ্ন থেকেই অবহেলার শিকার। এ ক্ষেত্রে শিশুর দায়িত্ব এসে পড়ে তাদের বৃদ্ধ দাদাদাদি, নানা-নানি অথবা কাজের মেয়ের ওপর। কাজের মেয়েরা কখনই মা-বাবার বিকল্প হতে তো পারেই না, বরং মা-বাবার অনুপস্থিতিতে তাদের দ্বারা অবুঝ শিশুদের ওপর চলে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।
আর এই নির্যাতনের কারণেই অনেক শিশু ট্রমাগ্রস্ত হয়ে মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং একপর্যায়ে চিকিৎসার অযোগ্য হয়ে পড়ে ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। অসহায় শিশুটি ভাষাহীন হওয়ায় মা-বাবাকে জানাতে পারে না তার ওপর নির্যাতনের নিষ্ঠুর কাহিনি।
অন্যদিকে নিরুপায় মা-বাবাও জানতে পারেন না তাদের অবুঝ শিশুটির ওপর ঠিক কী ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। মা-বাবা অফিস গমনের প্রাক্কালে তাদের পরম আদরের শিশুটির জন্য যে খাবার রেখে যান তারও বেশিরভাগই চালান হয়ে যায় কাজের মেয়ের পাকস্থলিতে। আবার শিশু অপহরণকারী চক্রের কবলে পড়ে একটি সম্ভাবনাময় শিশুর জীবন অকালেই ধ্বংস হয়ে যাবার ঘটনাও এদেশে বিরল নয়। অপহৃত শিশুটিকে পঙ্গু করে দিয়ে সেই পঙ্গু শিশুকে দেখিয়ে ভিক্ষা আদায় করার মতো ন্যক্কারজনক, ঘৃণ্য এবং অমানবিক ঘটনাও ঘটে থাকে।
এমন ঘটনায় শুধু অপহৃত শিশুটির জীবনই ধ্বংস হয়ে যায় না বরং আদরের শিশুটিকে হারিয়ে মা-বাবাও অনেক সময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বিশৃঙ্খল জীবনযাপনে বাধ্য হয়। এ সবকিছুর পেছনে দায়ী কে? এক কথায় এর জবাব হয় না, তবু বলা যায় সব অঘটনের মূলে রয়েছে শিশুর প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালনের অভাব। এর জন্য দায়ী শিশুর মা-বাবা নিজেরাই, সেইসঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা।
একটি অবুঝ শিশুরও যে কিছু অধিকার আছে তা অজ্ঞতার কারণে বেশিরভাগ মা-বাবাই জানেন না। শিশুকে জন্মদানের পূর্বে প্রায় কোনো মা-বাবাই ভেবে দেখেন না অনাগত শিশুটি যথাযথ যত্নে বেড়ে ওঠার সুযোগ পাবে কি না, অর্থাৎ আমাদের দেশে পরিকল্পিত উপায়ে শিশুর জন্মদান নিশ্চিত করা হয় না। আমাদের দেশে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর নামে সরকারের একটি বিভাগ আছে বটে তবে সেখান থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা ছাড়া আর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না।
খোদ রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন কানাগলিতে উঁকি দিলে দেখা যাবে অসংখ্য পথশিশু যারা অশিক্ষার অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছে, প্রতিনিয়তই শিকার হচ্ছে সমাজের নির্মম অবহেলার। আজও কতো শিশু গৃহ পরিত্যক্ত ও অনাথ এবং ক্ষুধার তাড়নায় ও পরিবেশের শিকার হয়ে তারা নানান সমাজবিরোধী কর্মে জড়িয়ে পড়ছে, মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে এবং কিশোর গ্যাং এর বলি হয়ে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে।
শিশুকল্যাণ শব্দটি আমাদের কমবেশি জানা থাকলেও আসলে বিষয়টি কী তা অনেকেরই জানা নেই। আধুনিক বিশ্বে শিশুকল্যাণের বিষয়টি ব্যাপক গুরুত্ব পাচ্ছে। শিশুর জন্মের পূর্ব থেকেই শিশুকল্যাণ শুরু হয় এবং কৈশোর পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে।
শিশু যখন মাতৃগর্ভে থাকে তখন থেকে বা তারও আগে থেকেই মায়ের বিশেষ পরিচর্যার মাধ্যমে গর্ভে থাকা শিশুটির পরিচর্যা শুরু হয় যাতে গর্ভে থাকা শিশুটির প্রয়োজনীয় পুষ্টিসাধন হয় এবং স্বাস্থ্য ও সুস্থতা নিয়ে ভূমিষ্ঠ হতে পারে। জন্মের পরপরই শুরু হয় শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তির সার্বিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ধরনের কার্যক্রম গ্রহণের পদক্ষেপ। শিশুকল্যাণের কাজটি একক কারো দ্বারা পরিচালিত হতে পারে না।
পরিবারের সকল সদস্য, সামাজিক পরিবেশ, বিদ্যালয়, আত্মীয়স্বজন সবাইকেই এ কাজে সম্পৃক্ত হতে হয় যাতে বেড়ে ওঠার প্রতিটি পর্যায়ে সুষ্ঠু ও বাঞ্ছিত পরবেশ তৈরি করা যায় এবং শিশুটি কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন না হয়। জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু অধিকার সনদে বলা হয়েছে—শিশুর সুস্থ বিকাশের জন্য চাই নিরাপদ পরিবেশ, চাই তার সব ধরনের সুরক্ষার ব্যবস্থা, চাই তার সুষম খাদ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, চাই স্বাস্থ্যসেবা ও উপযুক্ত শিক্ষা। এক কথায় একটি শিশুকে দিতে হবে উপযুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য অভাবমুক্ত ও অনুকূল পরিবেশ। কোনোভাবেই বিস্মৃত হলে চলবে না যে আজকের এই শিশুটিই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ ।
আমাদের দেশের শিশুদের অবস্থার পরিবর্তনে বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে তবে সেগুলো শুধু কর্মসুচি পালনের মধ্যেই সীমিত, শিক্ষিত এবং উচ্চবিত্ত কিছু পরিবার ছাড়া বাস্তবে শিশুদের ভাগ্যে দৃশ্যমান তেমন কোনো পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয় না।
প্রতিবছরই আমরা পালন করছি ‘বিশ্ব শিশু দিবস’, ‘শিশু অধিকার দিবস’ এবং ‘শিশুদের জন্য হ্যাঁ বলুন’ এর মতো কিছু কর্মসূচি। দেশে শিশুদের জন্য রয়েছে আলাদা মন্ত্রণালয়, রয়েছে শিশু একাডেমি এবং আরো রয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, তবু এখন পর্যন্ত তাদের সুষ্ঠু বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা যায়নি, তারা এখনো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অধিকার বঞ্চিত, ভাগ্য বিড়ম্বিত।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে বহুতল ভবনের আশে পাশেই দেখা যায় বস্তি এলাকা যেখানে শিশুদের স্বাস্থ্য দেখলেই বুঝা যায় তারা দারিদ্র্য ও পুষ্টিহীনতার শিকার। শুধু কি তাই? কারখানা এবং হোটেলসমূহে উঁকি দিলে খুব সহজেই বুঝা যায় অগণিত শিশু শুধু ক্ষুধার তাড়নায়, জীবিকার প্রয়োজনে শ্রমদাসে পরিণত হয়েছে। নির্মল আনন্দের মুখ তারা কখনো দেখেনি, ভূমিষ্ঠ হবার পর পরই যা দেখেছে তা হলো তাদের অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত বাবা-মায়ের দুঃখের বিরুদ্ধে সংগ্রামী জীবন, বেঁচে থাকার তাগিদে তাদের অপর্যাপ্ত এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ এবং নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস
এ অবস্থার উত্তরণ ঘটবে কবে এবং কীভাবে? সব ধরনের উন্নয়নের চাবিকাঠি হলো উপযুক্ত শিক্ষা, যা দিয়ে মানুষ সহজেই দারিদ্র্য দূর করে এবং উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে নিজেকে উন্নত করতে পারে, সমাজকে বদলে দিতে পারে।
আমাদের দেশে শিশুশ্রম একটি অপ্রিয় বাস্তবতা যা শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিপর্যয় ডেকে আনে এবং একটি সম্ভাবনাময় জীবনকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেয়। যেকোনো মূল্যে এটি বন্ধ করতে হবে। দেশ ও জাতির স্বার্থে ভবিষ্যতের এই নাগরিককে তার ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে হবে।
শিশু নির্যাতনের যেকোনো ঘটনাকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। সর্বোপরি, শিশুশ্রম ও শিশু অধিকার সম্পর্কে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে পারলে তবেই শিশুর ভেতরে যে সুপ্ত প্রতিভা লুকিয়ে আছে, দেশগড়ার ভবিষ্যৎ যে কারিগর লুকিয়ে আছে তার সফল বহিঃপ্রকাশ ঘটানো সম্ভব।
লেখক: পরিচালক (প্রশাসন), বাউবি