
নীতিহীনের নীতিকথা সমাজকে ধোঁকা দিচ্ছে। বৈধ আয়ের চেয়ে যার চাক্ষুস সম্পদ বেশি সেই রাক্ষস মানুষকে সততা-নৈতিকতার গল্প শোনাচ্ছে। আশেপাশের বদরা যখন সততার পাঠ দেয় তখন হাসি আটকে তাদের মতো ও পথের সঙ্গে তাল মেলানো যে কতো কঠিন তা ভুক্তভোগীরা জানে। সমাজ থেকে ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে রাষ্ট্রের সমস্যাসমূহ শতভাগের কাছাকাছি নিমিষেই সমাধান হয়ে যেতো। অথচ সিস্টেমও আজ অপ-সিস্টেমের কাছে চরমভাবে জিম্মি। কেরানির শতকোটি টাকা, বসের বিদেশে বাসা-বউ এসব গল্প জাতির অজানা নয়।
অথচ কোনো এক অজানা কারণে অসৎ জিতে যায়। অডিটে খুঁত ধরা পড়ে না কিংবা গোপন বৈঠকে সব অসংগতি দফারফা হয়ে যায়। অবশেষে জুমাবারে মসজিদে খতিবের মাইক কেড়ে দুর্নীতিবাজ গলা চড়িয়ে মুসুল্লিদেরকে পরকালের ফায়দার খুতবা শোনায়। মাহফিলের সভাপতি হওয়ার জন্য, সভা-সমিতিতে প্রধান অতিথি থাকার জন্য দুহাত ভরে দান-চাঁদা দেন। যার আছে সে দিতেই পারে কিন্তু আজকাল মাওলানারাও দাতার দানের উৎস না জেনেই হাত বাড়িয়ে দেয়। সুদ-ঘুষের টাকায় সুরম্য মাদরাসা-মন্দিরের দেয়াল উঠছে।
বাবা তার সন্তানকে আয়কৃত সম্পদের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করতে ভুলে যাচ্ছে। স্ত্রী স্বামীকে জিজ্ঞেস করছেন না--এমন বিলাসী ভোগের উৎস আসে কোন পথে? সন্তান তার বাবার কাছে জানতে চায় না, আয়ের সঙ্গে সম্পদের এতোটা তারতম্য ঘটালেন কী করে? আইন-আদালতেও ফাঁকফোকর আছে। এই বাবা-মা, সন্তান-বন্ধুরাই তো সর্বত্র বসা।
টাকা কার না লাগে? অথচ এমনভাবে চলতে থাকলে এই দেশ স্বপ্নের সোনার দেশ হওয়া তো দূরের কথা বরং দিনে দিনে বাসযোগ্যতা হারাবে। এদেশে প্রতিনিয়ত দুর্নীতিবাজ-ঘুষখোরদের সঙ্গে সাধারণ খেঁটে খাওয়া মানুষদের বৈষম্য প্রকট হচ্ছে। দেশের টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। পাচার কারা করে কিংবা কাদের করার সামর্থ্য আছে সেটা সরকার-জনগণ ও রাষ্ট্র জানে। অথচ গরিব কৃষক ন্যায্য দাম পাবে না জেনেও রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে সোনার ফসল ফলাচ্ছে, রেমিট্যান্স যোদ্ধারা দিনরাত একাকার করে, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছে। তাদের কষ্টার্জিত সম্পদের কতোটুকু মূল্যায়ন এবং কতোখানি অবমূল্যায়ন হচ্ছে তা দেশের অর্থনৈতিক সম্মৃদ্ধি দেখেই বোঝা যায়। স্বাধীন বয়স ৫৩ বছর পেরুলেও বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক সুযোগ-সুবিধার গণ্ডিতে আটকে আছে।
সরকারি কর্মজীবীদের বাজারমূল্যের চেয়ে বেতন কম। ঘুষ-দুর্নীতির পক্ষে দুষ্টদের এটা একটা যুক্তি। অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি চাকরিজীবীদের বেতনের সঙ্গে তুলনা করে বেসরকারি খাতসমূহের বেতন নির্ধারণ করা হয়। যদি বেতন কম হয় তবে রাষ্ট্রের কাছে যুগোপযোগী বেতন দাবি করতে হবে। তাই বলে স্পিড মানিকে বৈধ করার কোনো সুযোগ নেই। ঘুষ-দুর্নীতি থেকে অর্জনকৃত সম্পদ-অর্থ, ক্ষমতা সরাসরি হারাম। হারাম যখন হালালের সঙ্গে মিশ্রিত হয় তখন হালালও অপবিত্র হয়ে যায়। হারামের সবচেয়ে শক্তিশালী ক্ষতিকর দিক হচ্ছে জীবনাচার থেকে বরকত কমে যাওয়া এবং বিপদ ডেকে আনা।
সুতরাং প্রচণ্ড দুর্নীতিগ্রস্ত খাতসমূহকে চিহ্নিত করে সেখানে শুদ্ধাচারের কঠোর অপারেশন করতে হবে। এক টাকার দুর্নীতিতে রাষ্ট্র এক হাজার টাকার ক্ষতিতে পতিত হয়। কেনোনা ঘুষ-দুর্নীতি একটি চেইন। যা রাষ্ট্রের পা থেকে মাথা অবধি বিস্তৃত। পায়ের দিকে কিছুটা সরু হলেও মাথার দিকে ঘুষ-দুর্নীতির অঙ্ক সাধারণত বিস্তৃত হয়। তবে কোনো স্ট্রাকচারাল বডির মাথা যদি সুস্থ হয় তবে সেটার লেজের সামান্য সামান্য ক্ষতগুলো সারানো কঠিন নয়। একজন পিয়নের দুর্নীতি, আরেকজন প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতি রাষ্ট্রকে সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে না।
বাংলাদেশকে যদি সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হয় তবে ঘুষ-দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করতে হবে। যারা ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধে আইন প্রয়োগ করবে তাদেরকে সবার আগে শুদ্ধ হতে হবে। নীতির চর্চা বাড়ানোর জন্য পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মচর্চা বৃদ্ধি করতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা না হলে, এই সমাজের পচন থামবে না। আয়কর রিটার্ন, সম্পদ বিবরণী ধরে ধরে সমাজের রাঘব-বোয়ালদেরকে কৈফিয়তের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) শক্তিশালী করতে পারলে দুর্নীতির লাগাম টানা যাবে। সংবিধানে অলঙ্কৃত ন্যায়পাল ব্যবস্থার বাস্তবায়ন করতে না পারাটা নীতিনির্ধারকদের জন্য লজ্জার। সব চাকরিজীবীদেরকে কঠোর নজরদারিতে রাখতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান-অফিস দুর্নীতির আখড়া হিসেবে ইতোমধ্যেই চিহ্নিত, সেখানে মাঝে মাঝেই শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করতে হবে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধ উত্থাপিত অভিযোগ প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
যেসব সেবাসমূহ এবং সেবাসামগ্রী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জনগণের মধ্যে বিনামূল্যে দেয়া হয়, সেগুলোতে যখন দুর্নীতি ভর করে তখন যোগ্য ও প্রাপ্যতার দাবিদাররা প্রাপ্য সব অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। ভালো মানুষদেরকে চিহ্নিত করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোকে অলংকৃত করাতে পারলে দেশ থেকে ঘুষ-দুর্নীতির মাত্রা কমে আসবে। বিদেশে যারা অবৈধভাবে অর্থপাচার করে তাদেরকে শাস্তির মুখোমুখি করতেই হবে। সবার সব অবৈধ সম্পদ ক্রোক করে গরিবের মধ্যে বিলিয়ে দিতে পারলে ন্যায্য ও সমতা তথা ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ করা সম্ভব হবে।
’২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের যে স্পিরিট, তা ধারণ ও লালন করতে বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের কোনো বিকল্প নাই। ছাত্র-জনতার কাঙ্ক্ষিত রূপকল্পে রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলার জন্য ঘুষ-দুর্নীতির লাগাম টানতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে। যেহেতু স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে দুর্নীতিকে বহু আগে থেকেই অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করা গেছে, সেহেতু ঘুষ-দুর্নীতিমুক্ত সমাজ সৃষ্টিতে গণজাগরণ ঘটাতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক