ঢাকা মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫ , ২৯ বৈশাখ ১৪৩২ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

ক্ষুধার্ত শিক্ষক দিয়ে জাতি গড়া অসম্ভব

মতামত

মো. সিদ্দিকুর রহমান

প্রকাশিত: ০৭:৩০, ১৩ মে ২০২৫

সর্বশেষ

ক্ষুধার্ত শিক্ষক দিয়ে জাতি গড়া অসম্ভব

শিক্ষক বাঁচলে শিক্ষার আলো জ্বলবে। শিক্ষককে না বাঁচিয়ে জাতির উন্নতি নিছক মূর্খতা। বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবস্থা বর্তমানে চরম সংকটময় অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনি জাতীয় অগ্রগতির অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। জাতিকে শিক্ষিত, সচেতন ও মানবিক করে থাকে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা।

এ শিক্ষাব্যবস্থার মূল স্থপতি, শিক্ষিত জাতির জনক প্রাথমিক শিক্ষকেরা। এ কারিগরেরা চরম অবহেলা ও অবমূল্যায়নের শিকার। তাদের নেতা নামে খ্যাত ব্যক্তিবর্গ, সমাজ ও দেশ জাতির কাছে তেল মারা নেতৃত্ব বুঝতে সক্ষম হচ্ছেন না ক্ষুধার্ত শিক্ষকদের যন্ত্রণা।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা শিক্ষক ড. মনজুর আহমেদ, যিনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের গঠিত কনসালটেশন কমিটির প্রধান ছিলেন, তার কাছে প্রাথমিক শিক্ষক সমাজের নেতারা সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেডের যৌক্তিকতা সম্পর্কে আবেদন-নিবেদন করেছিলেন।

পরে প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টা, সচিব, মহাপরিচালকসহ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের কাছে ১০ম গ্রেডের দাবি যৌক্তিক মনে হয়েছে।

অথচ সমস্যা নিরসনের ক্ষেত্রে ‘যে লাউ সেই কদু’ দৃশ্যমান। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষক হিসেবে তিনিও বুঝতে সক্ষম হননি ক্ষুধার্ত শিক্ষক, যাদের মর্যাদা থার্ড ক্লাস, বেতন গ্রেডের ১৩তম দুর্দশার বেদনা। তিনি বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন, আওয়ামী লীগ আমলের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী দুর্নীতিবাজ জাকির হোসেন আওয়ামী লীগ ও অন্তর্বর্তী সরকারের আমলের প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত সচিব ফরিদ আহমেদের পরিপত্র, যা প্রাথমিক শিক্ষার জন্য তিনি সুপারিশ করেছেন। 

প্রাথমিক শিক্ষাকে সংকুচিত, হেয়প্রতিপন্ন তথা ধ্বংস প্রক্রিয়ার কর্মকাণ্ডগুলো। সেনাসমর্থিত সরকারের আমলে প্রাথমিক শিক্ষা ব্র্যাকের অধীনে ন্যস্ত করার, তিনি ছিলেন মুখ্য ব্যক্তি। সারা দেশব্যাপী আন্দোলনের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী ব্র্যাকের অধীনে ন্যস্ত করার পরিপত্র কার্যকর করতে সক্ষম হননি।

সে সময় একুশে টেলিভিশনে এক টকশোতে অংশগ্রহণ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক কাবেরী গায়েন, সাবেক অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাকের পক্ষে ছিলেন ড. মনজুর আহমেদ, আর তৎকালীন বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ছিলাম আমি।

উক্ত টকশোতে সরকারি শিক্ষক হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষকদের ব্র্যাকের অধীনে ন্যস্ত করার যুক্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম যে প্রাথমিক শিক্ষাকে বেসরকারিকরণের হীনচক্রান্ত ছিলো। সে পরাজিত শক্তির মুখ্য ব্যক্তি ড. মনজুর আহমেদ। তিনি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিমন্ত্রী, সচিবের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা সংকোচন তথা শিক্ষকদের প্রতি তার নির্মম প্রতিশোধ হলো কনসালটেশন কমিটির রিপোর্ট।

দরিদ্র জনগণের সন্তানদের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশে কার্যক্রম বন্ধ করার সুপারিশ হীনমানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। একজন সরকারি কর্মচারী হিসেবে সব কর্মচারীদের মতো প্রাথমিক শিক্ষক টিফিন ভাতা প্রতি মাসে ২০০ টাকা। এ অসম্মানজনক টিফিন ভাতা মানসিক অবহেলার নিদর্শন।

এদিকে সহকারী শিক্ষকেরা ১৩তম গ্রেডে বেতনস্কেল শুরু ১১ হাজার টাকা থেকে শুরু। এই টাকা দিয়ে একজন শিক্ষক কীভাবে মাসিক খরচ চালাতে পারেন, বিষয়টি কনসালটেশন কমিটি, উপদেষ্টা, সচিবসহ সর্বমহলের বেতন উপলব্ধি হচ্ছে না? তারা শুধু নিজেরটা ভালোভাবে বোঝেন, এটাই দৃশ্যমান হচ্ছে। বাসাভাড়া বড় শহরে কমপক্ষে ১০ হাজার বা ছোট শহরে ৬-৮ হাজার টাকা। 

পৈত্রিক নিবাসে গ্যাস, বিদ্যুৎ, মোবাইল ও অন্যান্য খরচ কমপক্ষে ৫ হাজার টাকা। এ ছাড়াও সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যয় পরিবারের চিকিৎসা খরচ, ৪ জনের পরিবারের খাওয়া খরচ বর্তমান বাজারদরে কমপক্ষে ১৬ হাজার টাকা। এসব খরচ মেটাতে শিক্ষককে প্রতিমাসে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়তে হচ্ছে। পরিবারের ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে বাধ্য হয়ে শিক্ষক বা কর্মচারীকে অন্য পেশার পার্টটাইম কাজ, টিউশনি, দোকানে বসাসহ নানাবিধ কাজ-কর্ম করতে হচ্ছেন।

এতে একদিকে শিক্ষকতায় মনযোগ কমে আসছে। অন্যদিকে শিক্ষার মান ও স্বাভাবিকভাবে নিম্নমুখী হচ্ছে। এর দায় শিক্ষক সমাজ বা কর্মচারীদের ওপর চাপানো মোটেই সমীচীন নয়। এর দায় অবশ্যই সরকারের মন্ত্রী উপদেষ্টা সচিবসহ নীতিনির্ধারণী ব্যক্তিদের ওপর বর্তায়। এ অবহেলা বা দায়িত্বহীনতার জন্য। তাদের কোনো জবাবদিহিতা করার কেউ নেই। জাতিকে এগিয়ে নেয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত দুটো হলো-শিক্ষা ও স্বাস্থ্য।

আমাদের দেশে কৃপণ সরকারগুলো এই খাত দুটোতে খুবই নগণ্য বিনিয়োগ করে থাকেন। তারা শিক্ষকদের সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকার বিনিয়োগের চেয়ে, যেখানে তাদের টাকা আয়ের সুযোগ থাকে সেখানে বেশি বিনিয়োগ করে থাকেন। বিশ্বের অনেক দেশেই প্রাথমিক শিক্ষকদের সম্মান ও সুবিধায় এমনভাবে নিশ্চিত করা হয়, যাতে তারা আত্মমর্যাদা নিয়ে কাজ করতে পারেন।

ফিনল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, এমনকি প্রতিবেশী ভারতও শিক্ষকতা পেশাকে সম্মানিত ও মর্যাদাবান করে তোলা হয়েছে। আর আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষকেরা দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োজিত, তাদের প্রতি কোনো সংবেদনশীলতা নেই। সময় এসেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সচেতন হয়ে, প্রতিবাদ করার।

প্রাথমিক শিক্ষা সংকুচিত করার আসল কর্ণধার কনসালটেশন কমিটি, সাবেক সচিব, উপদেষ্টা, তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা প্রয়োজন। বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষকদের ৯ম গ্রেডে বেতন দেয়া সমীচীন। এর ফলে কিছুটা হলেও পরিবারের ক্ষুধার জ্বালা নিবৃত্ত হবে। একজন ক্ষুধার্ত, অবহেলিত ও মর্যাদাহীন শিক্ষক কখনোই শক্তিশালী আত্মবিশ্বাসী শিক্ষার্থী তথা জাতি তৈরি করতে পারেন না। উন্নত জাতি গঠনে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করতে হবে শিক্ষায়। ক্ষুধার্ত শিক্ষক দিয়ে আলোকিত জাতি গড়া যায় না।

লেখক: শিক্ষাবিদ

 

জনপ্রিয়