
বিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে। এই যুগে শিক্ষা কেবল বই ও শ্রেণিকক্ষে সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রযুক্তি, মনোবিজ্ঞান ও সৃজনশীলতাভিত্তিক পদ্ধতির সমন্বয়ে একটি নতুন পরিমণ্ডলে প্রবেশ করছে। এ পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো গেমিফিকেশন, যা শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো, উপায় ও ফলাফলকে আমূল পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে।
‘গেমিফিকেশন’ শব্দটি প্রথম জনপ্রিয়তা পায় ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে, তবে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে এটি আন্তর্জাতিক শিক্ষা ও কর্পোরেট প্রশিক্ষণ জগতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করতে শুরু করে।
২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী গেমিফিকেশন মার্কেটের আর্থিক মূল্য প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে এবং এটি ২০২৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ৩০ বিলিয়নে পৌঁছাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে । এই প্রবন্ধে গেমিফিকেশন কী, এটি কীভাবে কাজ করে, এর সুবিধা-অসুবিধা, বাস্তব প্রয়োগ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করা হবে।
গেমিফিকেশন হলো এমন একটি পদ্ধতি যেখানে গেমের কাঠামোগত উপাদানগুলো, যেমন- পয়েন্ট, ব্যাজ, লেভেল, চ্যালেঞ্জ, রিওয়ার্ড, কুইজ ইত্যাদি এবং অ-গেমিং প্রসঙ্গে, যেমন-শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মার্কেটিং, প্রয়োগ করে ব্যবহারকারীর অংশগ্রহণ, মনোযোগ ও উদ্দীপনা বাড়ানো হয়।
শিক্ষা গবেষণায় দেখা গেছে, গেমিং উপাদানসমূহ মানুষের মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃসরণ ঘটায়, যা শেখার ইচ্ছা ও তৃপ্তি বাড়ায়। বিশেষ করে শিশু ও কিশোর বয়সী শিক্ষার্থীরা যখন শেখাকে খেলা মনে করে, তখন তারা বাধ্যতামূলক নয় বরং আনন্দ ও উদ্দীপনার মাধ্যমে শিখে।
গেমফিকেশনের মূল লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীর আগ্রহ তৈরি করা, অংশগ্রহণ বাড়ানো, এবং শেখার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করা।
গবেষণায় দেখা গেছে, গেমিফিকেশনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা- শেখার সময় কম মনোযোগ হারায়, ভুল করলে ভয় পায় না, নিজে থেকেই শিখতে উৎসাহিত হয়, সহযোগিতামূলক আচরণ শেখে। বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য গেমিফিকেশন শেখাকে আনন্দময় অভিজ্ঞতায় রূপ দেয়।
গেমিফিকেশনের মনোবৈজ্ঞানিক ভিত্তি: গেমিফিকেশনের কার্যকারিতা তিনটি মূল মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়: ১. শেখার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা, দক্ষতা অর্জন ও সম্পর্কবোধ তৈরি হলে শিক্ষার্থী অধিক সচেতন ও সক্রিয় হয়।
গেমিফিকেশন এই তিনটি দিকেই সহায়তা করে। ২. যখন একজন শিক্ষার্থী এমনভাবে কাজ করে যে, সে সময়ের হিসাব ভুলে যায়-তাকে বলা হয় ‘ফ্লো স্টেট’। গেমিফিকেশনের মাধ্যমে এই অবস্থা অর্জন সহজ হয়। ৩. পজিটিভ রিওয়ার্ড, যেমন-ব্যাজ বা পয়েন্ট, শিক্ষার্থীর পুনঃআচরণকে উৎসাহিত করে।
গেমিফিকেশন নানাভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে কাজ করে। এর মূল উপাদানগুলো হলো-১. পাঠ শেষ করে বা সঠিক উত্তর দিয়ে পয়েন্ট অর্জন শিক্ষার্থীকে উত্সাহিত করে। ২. নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করলে সম্মানসূচক ব্যাজ দেয়া হয়, যা শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। ৩. অধ্যায়ভিত্তিক লেভেল বিভাজন শেখাকে গেমিংয়ের মতো বিন্যস্ত ও উপভোগ্য করে।
৪. বাস্তবসম্মত সমস্যার সমাধান বা দলগত কার্যক্রম শিক্ষার্থীর বিশ্লেষণ ও নেতৃত্ব দক্ষতা বাড়ায়। ৫. সময়সীমার ভেতরে কাজ সম্পন্ন করার চ্যালেঞ্জ শেখার গতি বাড়ায়। ৬. তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া এবং পুরস্কার শিক্ষার্থীর শেখার অনুপ্রেরণা বজায় রাখে।
৭. একটি প্রশ্ন-উত্তর বিন্যাসে তথ্য উপস্থাপন করে, শিক্ষার্থীরা একটি আকর্ষণীয় এবং রোমাঞ্চকর উপায়ে তারা ইতোমধ্যে, যা জানে তা দ্রুত পর্যালোচনা করতে পারে। ৮. একটি স্কোরিং সিস্টেম প্রয়োগ করা শিক্ষার্থীদের তাদের অগ্রগতি ট্র্যাক করতে এবং নিজেদের বা অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে দেয়। সঠিক উত্তরের জন্য পয়েন্ট প্রদান করা যেতে পারে, অংশগ্রহণকারীদের উচ্চ স্কোরের জন্য প্রচেষ্টা করতে উত্সাহিত করে।
বিশ্বজুড়ে অনেকগুলো গেমিফিকেশন রয়েছে। সেগুলো হলো-১. ডুয়োলিঙ্গ (ইউএসএ): ভাষা শেখার এ অ্যাপটি প্রতিদিনের টাস্ক, ব্যাজ ও স্ট্রিক ধরে রাখার মাধ্যমে শেখাকে আকর্ষণীয় করেছে। বর্তমানে ৫০০ মিলিয়ন ব্যবহারকারী এটির উপযোগিতা প্রমাণ করে।
২. ক্লাসক্র্যাপ্ট (কানাডা): শিক্ষার্থীদের সুপারহিরো রূপে রূপান্তর করে ক্লাসে দলগত মিশনের মাধ্যমে পাঠদান করে। এটি সহানুভূতি, সহযোগিতা ও শৃঙ্খলা শেখায়। ৩. খান একাডেমি: ছাত্রদের জন্য ব্যাজ, মাইলস্টোন, এবং লেভেল দেয়া হয়, যাতে তারা নিজের গতিতে শিখতে পারে। ৪. মাইনক্র্যাপ্ট এডুকেশন এডিশন: শিক্ষার্থীরা ভার্চ্যুয়াল বিশ্বে স্থাপত্য নির্মাণ ও সমাধান ভিত্তিক কাজ করে গণিত, ইতিহাস ও পরিবেশ শিক্ষা পায়।
৫. এডঅ্যাপ: এডঅ্যাপ-এর মতো একটি আধুনিক মোবাইলভিত্তিক শিক্ষার প্ল্যাটফর্ম অগ্রাধিকার দেয়ার জন্য একটি দুর্দান্ত বিকল্প। এটা শেখার অভিজ্ঞতায় উত্তেজনা ছড়ানোর জন্য গেমফিকেশন উপাদান এবং কার্যকারিতা অন্তর্ভুক্ত করে। যা এটিকে অনন্য করে তোলে। তা হলো গেমিফিকেশন এবং মাইক্রোলার্নিং এর সংমিশ্রণ, যেখানে শেখার উপকরণগুলো প্রদর্শিত হয় এবং বোঝার জন্য আরও সহজে ব্যাখ্যা করা হয়, আরও আকর্ষণীয় এবং কম সময় সাপেক্ষ।
৬. উইজআইকিউ: এটি হলো একটি অল-ইন-ওয়ান রিমোট গেমিফাইড লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, যা ভার্চ্যুয়াল ক্লাসরুম এবং একটি এলএমএসকে একত্রিত করে। এটি পোল, কুইজ এবং ইন্টারেক্টিভ হোয়াইটবোর্ডের সঙ্গে ব্যস্ততা বাড়ায়। আপনি সহজেই আপনার কাস্টমাইজযোগ্য শেখার পোর্টাল সেট আপ করতে পারেন এবং যেকোনো ফর্ম্যাটে প্রশিক্ষণ সামগ্রী আপলোড করতে পারেন। মাল্টিমোডাল লার্নিংকে সমর্থন করে, রিয়েল-টাইম অডিয়ো, ভিডিয়ো এবং টেক্সট যোগাযোগ অফার করে।
আইওএস এবং অ্যান্ড্রয়েডে উইজআইকিউ অ্যাপ ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা লাইভ ক্লাসে যোগ দিতে পারে। ৭. কাহুত: কাহুতের মতো সুপরিচিত লার্নিং প্ল্যাটফর্ম! প্রকৃতপক্ষে শেখার জন্য গেমিফিকেশন ব্যবহারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, এবং এটি আকর্ষক শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা তৈরির পথ অব্যাহত রেখেছে। এর প্রাণবন্ত, ব্যবহারকারী-বান্ধব ইন্টারফেসের সঙ্গে, কাহুত!
একইভাবে শিক্ষাবিদ, প্রশিক্ষক এবং ছাত্রদের মধ্যে প্রিয় হয়ে উঠেছে। ৯. আহস্লাইডস: ভার্চ্যুয়াল লার্নিং অ্যাপগুলোর মধ্যে একটি। এটি আশ্চর্যজনক গেমফিকেশন উপাদানগুলো অফার করে, যা একটি শেখার অভিজ্ঞতার প্রতিশ্রুতি দেয়। এটি গতিশীল ও ইন্টারেক্টিভ থাকে।
এর তৈরি টেমপ্লেট এবং প্রশ্নব্যাঙ্ক শেখার গেমগুলো তৈরি করা সহজ করে তোলে এবং এর বিস্তৃত লাইব্রেরি বিভিন্ন বিষয়ের জন্য পূর্ব-তৈরি বিষয়বস্তুর একটি পরিসীমা সরবরাহ করে। আপনি করপোরেট প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা বা শিক্ষায় থাকুন না কেনো, এটি আপনার নির্দিষ্ট চাহিদা পূরণের জন্য তৈরি করা যেতে পারে।
বাংলাদেশে গেমিফিকেশন এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। তবে কিছু উদ্যোগ ইতোমধ্যে আলোড়ন তুলেছে: ১০ মিনিট স্কুল, শিখো, দুর্বিন একাডেমি ইত্যাদি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কুইজ, ব্যাজ ও রিওয়ার্ড সিস্টেমের মাধ্যমে গেমিফিক কনটেন্ট তৈরি হয়েছে।
সরকারি মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ প্রোগ্রামে ডিজিটাল কনটেন্ট ব্যবহারের মাধ্যমে গেমিফিকেশনের ধারণা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এআই ভিত্তিক পাঠ্যবই নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কাজ করছে, যা ভবিষ্যতে গেমিফিকেশনকে আরো এগিয়ে নিতে পারে।
আকর্ষণীয় শিক্ষা খেলাধুলার আনন্দে শেখা বিরক্তিকর মনে হয় না। সক্রিয় অংশগ্রহণ শিক্ষার্থী নিজে থেকেই শেখায় অংশ নেয়। তৎক্ষণাৎ ফিডব্যাক ভুল ধরিয়ে উন্নতির সুযোগ সৃষ্টি করে। দলগত সহনশীলতা দলবদ্ধ চ্যালেঞ্জে সহানুভূতিশীল মনোভাব গড়ে ওঠে চিন্তাশীলতা ও সমাধানমুখিতা বাস্তবমুখী সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে বিশ্লেষণ ক্ষমতা বাড়ে।
গেমিফিকেশনের সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ বেশকিছু। প্রযুক্তি নির্ভরতা ইন্টারনেট ও স্মার্ট ডিভাইস না থাকলে কার্যকর নয়। শিক্ষকের প্রস্তুতির অভাব অধিকাংশ শিক্ষক এ পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন অতিরিক্ত প্রতিযোগিতা কিছু শিক্ষার্থীর জন্য মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বিনোদনের আধিক্য শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে যেতে পারে। ডিজাইসজনিত সমস্যা নিম্নমানের গেমিক উপাদান শিক্ষায় বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
গেমিফিকেশনে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও প্রযুক্তির ভূমিকা রয়েছে। ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে প্রতিটি শিক্ষার্থীর শেখার ধরন অনুযায়ী কনটেন্ট কাস্টমাইজ করা হবে। ২. অগমেন্টেড রিয়েলিটি ব্যবহারে শিক্ষার্থীরা বাস্তব অভিজ্ঞতার মতো শিখতে পারবে।
যেমন- ঐতিহাসিক যুদ্ধ বা বৈজ্ঞানিক গবেষণা। ৩. ভার্চ্যুয়াল ক্যাম্পাসে গেমিং উপায়ে ক্লাস করা সম্ভব হবে, যা গেমিফিকেশনের চূড়ান্ত প্রয়োগ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ৪. গেমভিত্তিক পরিস্থিতি তৈরি করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহানুভূতি, নেতৃত্ব ও সংকটমোচন শেখানো সম্ভব।
শিক্ষাক্ষেত্রে গেমিফিকেশন কেবল একটি কৌশল নয়, বরং একটি বিপ্লব। এর মাধ্যমে শেখা হয় আনন্দময়, ইন্টার্যাকটিভ এবং গভীরতাসম্পন্ন। যদিও এখনো কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, তবে প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগ, শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি, এবং কনটেন্টের গুণগত মান উন্নয়ন-এই তিনটি উপাদান নিশ্চিত করা গেলে গেমিফিকেশন আগামী দিনের শিক্ষায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। গেমিফিকেশন শুধু শিক্ষাকে উপভোগ্য করে না, বরং একে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও ভবিষ্যৎনির্ভর করে তোলে।
লেখক: পিএইচডি গবেষক. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়