ঢাকা মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫ , ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

আধুনিক বিশ্বের শিক্ষানীতি ও দেশের বাস্তবতা

মতামত

রাসেল মাহমুদ হাবিবী

প্রকাশিত: ০৭:৩০, ২০ মে ২০২৫

সর্বশেষ

আধুনিক বিশ্বের শিক্ষানীতি ও দেশের বাস্তবতা

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। যে জাতি শিক্ষায় যতো উন্নত, সে জাতি ততো উন্নত ও সমৃদ্ধ। বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন উন্নত দেশগুলো তাদের শিক্ষানীতিকে এমনভাবে গড়ে তুলেছে, যা তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শুধু কর্মদক্ষতা সম্পন্নই করছে না, বরং মানবিক, নৈতিক এবং উদ্ভাবনী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলছে।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা মূল্যায়নের পূর্বে এসব দেশের শিক্ষানীতির কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা প্রয়োজন।

বিশ্বের সবচেয়ে উত্তম শিক্ষানীতির উদাহরণ হিসেবে ফিনল্যান্ডকে ধরা হয়। এখানে শিক্ষাকে জীবনের আনন্দময় অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শিক্ষা বাধ্যতামূলক হলেও চাপহীন। প্রাথমিক স্তরে কোনো পরীক্ষা নেই। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা অত্যন্ত উচ্চ, এবং তারা ন্যূনতম মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। ফিনল্যান্ড সরকার শিক্ষায় জিডিপির প্রায় ৬ শতাংশ ব্যয় করে, যা শিক্ষার মান উন্নয়নে সরাসরি প্রভাব ফেলে।

সিঙ্গাপুরের শিক্ষানীতি অত্যন্ত কাঠামোগত ও দক্ষতাভিত্তিক। ‘স্কিলফিউচার’ নামে একটি সরকারিভাবে পরিচালিত কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ পছন্দ ও দক্ষতা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ পায়।

এই দেশের শিক্ষানীতিতে শিক্ষার্থীদের ওপর আত্মনির্ভরতা ও বিশ্লেষণী চিন্তার বিকাশে জোর দেয়া হয়। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ে তুলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।

জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা, কর্মনিষ্ঠা ও জাতীয় চরিত্র গঠনের ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়। এখানে ৯ বছরের বাধ্যতামূলক শিক্ষা, কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত পাঠ্যক্রম এবং অভিভাবকদের অংশগ্রহণমূলক শিক্ষানীতির কারণে শিক্ষার্থীরা দায়িত্বশীল ও আত্মনিয়ন্ত্রিত হয়ে গড়ে ওঠে। শিক্ষকদের নিয়োগেও কঠোর মানদণ্ড প্রয়োগ করা হয়।

কানাডার শিক্ষাব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে বৈচিত্র্যময় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক। এখানে আদিবাসী, অভিবাসীসহ সব সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক শিক্ষানীতি গ্রহণ করা হয়েছে। কানাডায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ, প্রযুক্তিনির্ভর পাঠদান এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করেছে।

অপরদিকে, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো অনেক দিক থেকে পিছিয়ে আছে। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে কিছু আশাব্যঞ্জক দিক তুলে ধরা হলেও বাস্তবায়নে নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে সালে চালু হওয়া নতুন পাঠ্যক্রমে বিশ্লেষণমূলক চিন্তাভাবনা, জীবনঘনিষ্ঠ জ্ঞান এবং মূল্যবোধ শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত থাকলেও তা বাস্তবে রূপ পায়নি।

শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ এখনো মুখস্থনির্ভর শিক্ষায় অভ্যস্ত। শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশিক্ষণের অভাব এবং বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত অবকাঠামোর ঘাটতি এখনো প্রকট।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে একজন শিক্ষার্থী প্রায় ১১ বছর বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করলেও তার শেখার স্তর বাস্তবিক অর্থে ৬ দশমিক ৮ বছর শিক্ষার সমান, যা শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

ইউনেসকোর মতে, উন্নত শিক্ষা নিশ্চিত করতে জাতীয় বাজেটের অন্তত ২০ শতাংশ এবং জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ থাকা উচিত। অথচ বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে বরাদ্দ হয়েছিলো মাত্র১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ, যা জিডিপির ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করতে হলে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার তা হলো—কর্মমুখী জাতীয় সিলেবাস প্রণয়ন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার উন্নয়ন, প্রাথমিক স্তরেই মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষা চালু করা, মেধাভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা, কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষার সুযোগ প্রসার করা এবং বাজেট বরাদ্দে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করা। পাশাপাশি, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে শিক্ষার ডিজিটালাইজেশন, ই-লার্নিং, এবং একাডেমিক গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত করা।

সর্বোপরি, একটি মানবিক, দক্ষতানির্ভর, নৈতিকতাসম্পন্ন এবং আত্মনির্ভর জাতি গঠনে শিক্ষানীতিকে কেবল নথিতে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবায়নের স্তরে দৃঢ়ভাবে পৌঁছে দেয়া এখন সময়ের দাবি।

লেখক: সংবাদকর্মী ও সাবেক শিক্ষক

 

জনপ্রিয়