ঢাকা শনিবার, ৩১ মে ২০২৫ , ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন ও বাংলাদেশ

মতামত

ইমরান ইমন

প্রকাশিত: ০৭:৩০, ২৯ মে ২০২৫

সর্বশেষ

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন ও বাংলাদেশ

পারস্পরিক যুদ্ধ-সংঘাত কখনো সুফল বয়ে আনতে পারে না। শান্তির জন্য যুদ্ধ-সংঘাত পরিহার করতে হয়। বিশ্বের সংঘাতময় অঞ্চলগুলোতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম হয় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের।

বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর ২৯ মে আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস পালিত হয়। বিভিন্ন দেশের শান্তিরক্ষীদের মহান আত্মত্যাগ স্মরণ করে ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ইউক্রেনের শান্তিরক্ষী সংস্থা এবং ইউক্রেন সরকারের যৌথ প্রস্তাবনায় ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের গৃহীত ৫৭/১২৯ প্রস্তাব অনুযায়ী এ দিবসের রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়।

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত আরব-ইসরায়েল যুদ্ধকালীন যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণে গঠিত জাতিসংঘ ট্রুস সুপারভিশন অর্গানাইজেশন (আন্টসো) দিনকে উপজীব্য করে ২৯ মে তারিখটি ‘আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এখানে বলে রাখা দরকার, আন্টসো হচ্ছে প্রথম জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী। সে হিসেবে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী এ বছর ৭৭ বছর পূর্ণ করলো।

উল্লেখ্য, এদিনে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী সব পুরুষ-নারীকে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সর্বোৎকৃষ্ট পেশাদারী মনোভাব বজায় রাখা, কর্তব্যপরায়ণতা, নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাদের মহান আত্মত্যাগের ঘটনাকে গভীর কৃতজ্ঞতা ও যথোচিত সম্মানপূর্বক স্মরণ করা হয়। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষায় নারীদের অবদান ও ভূমিকার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে। শান্তিরক্ষায় নারীর ভূমিকা ও লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যেই মূলত এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ইউএন ইরান-ইরাক মিলিটারি অবজারভেশন গ্রুপ (ইউনিমগ) মিশনে মাত্র ১৫ জন সেনা পর্যবেক্ষক প্রেরণের মাধ্যমে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিলো। সে থেকে বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল পথচলা।

তা ছাড়া ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে আফ্রিকার রুয়ান্ডার গণহত্যার সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেড গ্রুপ সেখানে নিয়োজিত ছিলো। প্রায় ১০০ দিনের গৃহযুদ্ধে তখন ৬ লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়েছিলো। সার্বিকভাবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী চলতি বছরে ৭৭ বছর (১৯৪৮-২০২৫) পূর্ণ করলো। অন্যদিকে, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের অধীনে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী বাহিনী পূর্ণ করলো ৩৭ বছর। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে যোগদানের শুরু থেকেই বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী সেনারা নিজেদের কর্মদক্ষতার পরিচয় দিয়ে সবার কাছ থেকে সুনাম ও ভালোবাসা কুড়িয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ এক গর্বিত সহযোগী। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা অর্জন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে শীর্ষ অবস্থানটি ধরে রাখা। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর ‘মজ্জা বা সমকক্ষ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

হাইতি থেকে পূর্ব তিমুর, লেবানন থেকে ডিআর কঙ্গো পর্যন্ত বিশ্বের সব সংঘাতপূর্ণ এলাকার জনমনে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার জায়গা করে নিয়েছেন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা। একসময় যেসব দেশের সাধারণ মানুষ ‘বাংলাদেশ’ শব্দটির সঙ্গেই পরিচিত ছিলো না, সেসব দেশে এখন বাংলাদেশ হয়ে ওঠেছে অতি ভালোবাসার দেশ, লাল-সবুজের পতাকা হয়ে ওঠেছে আবেগ ও শ্রদ্ধার অবিচ্ছেদ্য অংশ।

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সেনাদের অংশগ্রহণে ফলে বিশ্বের বুকে বেড়েছে বাঙালি ও বাংলা ভাষার পরিচিতি। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র, রাজনৈতিক মতাদর্শ, ধর্মীয় বিশ্বাস, আঞ্চলিক বৈষম্যকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন বিশ্বমানবতার মহান সেবায়।

পেশাগত দক্ষতা, নিরপেক্ষতা, সততা ও মানবিক আচরণের কারণে তারা আজ সেসব দেশের মানুষের কাছে হয়ে ওঠেছেন অনুকরণীয় আদর্শ। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অবদান রাখা দেশগুলোর অবস্থান সম্পর্কে জাতিসংঘের ‘ডিপার্টমেন্ট অব পিসকিপিং অপারেশন্স’ প্রতিবেদন অনুসারে, এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ সেনা প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান সবার শীর্ষে। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাস থেকে বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে তার শীর্ষ অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশি সেনাকর্মকর্তাদের মধ্যে ৬ জন ফোর্স কমান্ডার ও ৭ জন ডেপুটি ফোর্স কমান্ডার সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালনেরও গৌরব অর্জন করেছেন।

তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বের ৪৩টি দেশের ৬৩টি মিশনে শান্তি রক্ষায় অসামান্য অবদান রেখে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা বিশ্বব্যাপী দেশের গৌরব ও মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও তারা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলছেন। শান্তিরক্ষা মিশনের মাধ্যমে বর্তমানে দেশের রেমিট্যান্স আয় হচ্ছে দুই হাজার কোটি টাকার অধিক।

জীবনের মায়া ত্যাগ করে বিশ্বমানবতার এই সেবায় কাজ করতে গিয়ে জাতিসংঘের ৬৩টি মিশনে বিশ্বের ৪৩ দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এখন পর্যন্ত জীবন বিসর্জন দিয়েছেন ১৬৮ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী। এর মধ্যে ১৩১ জন সেনাবাহিনীর সদস্য, নৌবাহিনীর চার জন, বিমান বাহিনীর ৯ জন এবং বাংলাদেশ পুলিশের ২৪ জন সদস্য রয়েছেন। বিভিন্ন মিশনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আহত হয়েছেন ২৫২ জন। বর্তমানে বিশ্বের ১১টি সক্রিয় শান্তিরক্ষা মিশনের মধ্যে ১০টিতে কর্মরত আছেন মোট ৫ হাজার ৬৭৭ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী।

এ সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী এই মিশনে দায়িত্ব পালন করে আসছে ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। বাংলাদেশের পুলিশ সদস্যরা এই মিশনে অংশ নিচ্ছেন ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে থেকে। বাংলাদেশ পুলিশের এ পর্যন্ত ২১ হাজার ৪৫৩ জন শান্তিরক্ষী বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মিশনে পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর মধ্যে ১ হাজার ৯২৫ জন নারী। বর্তমানে ছয়টি দেশে পুলিশের ১২০ জন নারীসহ ৩৬৪ জন শান্তিরক্ষী নিয়োজিত রয়েছেন। এ পর্যন্ত ২৪ জন পুলিশ শহীদ হয়েছেন।

দেশের প্রায় তিন হাজার নারী শান্তিরক্ষী এরই মধ্যে বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ দেশে সাফল্যের সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন সম্পন্ন করেছেন। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশি নারী শান্তিরক্ষীদের অংশগ্রহণও ক্রমশই বাড়ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের ২৭০ জন নারী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করছেন।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যোগদানের ৩৭ বছর ধরে সুনাম, ভালোবাসা, কৃতিত্ব ও সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসছে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা বাহিনী। আঘাত, সংঘাত, ভয়ভীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতি মোকাবিলা করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা শান্তির বার্তা নিয়ে বিশ্বমানবতার সেবায় কাজ করে যাচ্ছেন নিরন্তর।

তাদের এই মহান ত্যাগের মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষা সমাদৃত হচ্ছে। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা অর্জন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে নিজেদের শীর্ষ অবস্থানটি ধরে রাখা। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বিশ্বশান্তি রক্ষায় অবদান রাখা বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের স্মরণ করছি। বিনম্রচিত্তে। শান্তির সুবাতাস ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বব্যাপী।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

জনপ্রিয়