
ইসলামের অন্যতম বরকতময় ও তাৎপর্যপূর্ণ রাতগুলোর মধ্যে শবে বরাত এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এটি শাবান মাসের ১৪ তারিখের দিনগত রাতে পালিত হয় এবং অনেক মুসলিম সমাজে একে ‘লাইলাতুল বরাত’ বা ‘মুক্তির রাত’ বলা হয়। এই রাতে আল্লাহ বান্দাদের জন্য রহমতের দরজা খুলে দেন, ক্ষমা ও মুক্তি প্রদানের ঘোষণা দেন এবং অনেকের তাকদির নির্ধারণ করেন বলে বিশ্বাস করা হয়।
শবে বরাত মুসলমানদের জন্য এক মহিমান্বিত রাত, যেখানে গুনাহ মাফের সুযোগ মেলে, দোয়া কবুল হয় এবং আত্মশুদ্ধির পথ উন্মুক্ত হয়। এটি শুধুমাত্র নামাজ-রোজার রাত নয়, বরং আত্মজিজ্ঞাসা ও ভবিষ্যৎ জীবনকে সুন্দরভাবে গঠন করার প্রতিজ্ঞারও রাত। ইসলামের আলোকে শবে বরাতের গুরুত্ব, আমল, প্রচলিত বিদআত ও আমাদের করণীয় সম্পর্কে জানাতেই এ লেখা।
‘শবে বরাত’ শব্দটি ফারসি থেকে এসেছে, যেখানে ‘শব’ অর্থ রাত ও ‘বরাত’ অর্থ মুক্তি বা পরিত্রাণ। অর্থাৎ, ‘শবে বরাত’ মানে ‘মুক্তির রাত। আরবিতে একে বলা হয় ‘লাইলাতুল বরাত’, যার অর্থ হলো ‘অধিক মুক্তির রাত’।
এটি এমন এক রাত, যেখানে আল্লাহ তাআলা অসংখ্য বান্দাকে গুনাহ থেকে মুক্তি দেন, অনুগ্রহ বর্ষণ করেন এবং কৃত পাপের জন্য ক্ষমা দান করেন। এই রাতের মাহাত্ম্য মুসলিম উম্মাহর কাছে দীর্ঘকাল ধরে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে আসছে।
ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই শবে বরাতকে একটি ফজিলতপূর্ণ রাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইসলামি পরিভাষায়, এটি সেই রাত, যেখানে আল্লাহ তাআলা বান্দাদের তাকদির নির্ধারণ করেন এবং গুনাহগারদের ক্ষমা করেন। একাধিক হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই রাতে আল্লাহ দুনিয়ার দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকান, ক্ষমার ঘোষণা দেন এবং তার বান্দাদের দোয়া কবুল করেন।
শবে বরাতের মূল তাৎপর্য হলো-১. এই রাতে আল্লাহ অসংখ্য বান্দাকে ক্ষমা করেন, যারা আন্তরিকভাবে তওবা করেন। ২. অনেক ব্যাখ্যায় বলা হয়, এই রাতে মানুষের পরবর্তী এক বছরের ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়। ৩. এই রাত মানুষকে নিজের ভুল-ত্রুটির কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং আত্মশুদ্ধির জন্য ইবাদতে মনোযোগী হতে অনুপ্রাণিত করে।
শবে বরাত ইবাদতের রাত, তাই এই রাতে কিছু বিশেষ আমল করা উচিত। যদিও ইসলামে নির্দিষ্ট কোনো ইবাদতের বাধ্যবাধকতা নেই, তবে নিম্নলিখিত আমলগুলো করা মুস্তাহাব (সুন্নাতসম্মত) বলে বিবেচিত।
শবে বরাতে ব্যক্তিগতভাবে অতিরিক্ত নফল নামাজ পড়া সুন্নাহ। বিশেষ করে, তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কেউ চাইলে ২, ৪, ৬, ৮ বা ১২ রাকাত নফল নামাজ আদায় করতে পারেন। শবে বরাত উপলক্ষে কুরআন অধ্যয়ন ও তিলাওয়াত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, সূরা ইয়াসিন, সূরা দুখান ও সূরা মুলক পড়ার বিশেষ ফজিলত রয়েছে।
এই রাতে আল্লাহ তার বান্দাদের ক্ষমা করেন, তাই আমাদের উচিত গুনাহের জন্য আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাওয়া। দোয়া করা ও ইস্তেগফার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক হাদিসে শাবান মাসের রোজার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসে বেশি বেশি রোজা রাখতেন। তাই শবে বরাতের পরদিন নফল রোজা রাখা মুস্তাহাব। রাসুল (সা.) শবে বরাতে জান্নাতুল বাকিতে গিয়ে কবরবাসীদের জন্য দোয়া করেছেন। তাই কবর জিয়ারত করা মুস্তাহাব আমল হিসেবে গণ্য হয়।
শবে বরাত উপলক্ষে কিছু সংস্কৃতি ও কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে, যা ইসলামি শরিয়তের পরিপন্থি। শবে বরাতে ১০০ রাকাত বিশেষ নামাজ পড়ার কোনো দলিল নেই। কেউ চাইলে নফল নামাজ পড়তে পারেন, তবে একে ফরজ বা বাধ্যতামূলক মনে করা ভুল।
অনেক মুসলিম সমাজে শবে বরাত উপলক্ষে হালুয়া, রুটি বা অন্য কোনো খাবার তৈরি করে বিতরণ করা হয়। এটি বাধ্যতামূলক নয় এবং ইসলামে এর কোনো ভিত্তি নেই।
কিছু দেশে শবে বরাতকে উৎসবের রাত হিসেবে পালন করা হয়, যেখানে আতশবাজি, আলোকসজ্জা ও আনন্দ-উল্লাস করা হয়। এটি সম্পূর্ণরূপে ইসলামের মূল শিক্ষার বিপরীত।
শবে বরাতের শিক্ষা হলো-১. শবে বরাত আমাদের শিক্ষা দেয় যে, আল্লাহর রহমত সীমাহীন, তাই আমাদের সবসময় তাঁর দিকে ফিরে আসা উচিত। ২. আল্লাহ আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করেন, তাই আমাদের উচিত তাকদিরের ওপর আস্থা রাখা। ৩. এই রাত তওবার জন্য এক অনন্য সুযোগ এনে দেয়। ৪. আমাদের উচিত শবে বরাতের প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করা এবং বিদা’ত থেকে দূরে থাকা।
শবে বরাত ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ রাত, যেখানে আল্লাহ বান্দাদের জন্য রহমতের দরজা খুলে দেন। এটি গুনাহ থেকে মুক্তি, আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের রাত। তবে এই রাতকে কেন্দ্র করে বিদা’ত ও কুসংস্কারে জড়িয়ে না গিয়ে, কুরআন-হাদিস অনুযায়ী শুদ্ধ উপায়ে ইবাদত করাই উত্তম।
আমাদের উচিত এই রাতে নিজের অতীত ভুল-ত্রুটি স্মরণ করে আল্লাহর দরবারে ফিরে আসা, ভবিষ্যতে ভালো কাজ করার সংকল্প করা এবং দোয়া ও ইবাদতে নিজেদের মগ্ন রাখা। তাহলেই শবে বরাত আমাদের জন্য সত্যিকার অর্থে মুক্তির রাত হয়ে উঠবে।
লেখক: আলেম ও লেখক