
দেশে ১০ এপ্রিল থেকে এসএসসি ও সমমানের পাবলিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। কিন্তু পরীক্ষার প্রথম দিন থেকেই বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী যারা ফরম পূরণ করেছেন কিন্তু পরীক্ষায় বসেননি। শিক্ষার্থীদের এই পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ নিয়ে আঁতকে ওঠার মতো কিছু সংবাদ ছাপা হচ্ছে প্রায় প্রতিদিন।
সংবাদগুলো এমন ‘এসএসসির প্রথম দিন ২৬ হাজার ৯২৮ জন পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত, দ্বিতীয় দিনে ২৮ হাজার ৯৪৩ জন পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত। আর বহিষ্কার হয়েছেন ৮৩ জন পরীক্ষা ও ১৮ জন পরিবদর্শক।
পঞ্চম দিনে ২৭ হাজার ৮৪৫ জন পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত, এসএসসি পরীক্ষার সপ্তম দিনে ২৬ হাজার পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত। দাখিল পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিলেন ১ হাজার ৪৯০ জন। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ২ লাখ ৫৮ হাজার ৩৭৯ জন পরীক্ষার্থীর অংশ নেয়ার কথা ছিলো, কিন্তু অংশ নেন ২ লাখ ৪৭ হাজার ৮৮৯ জন। অর্থাৎ ১০ হাজার ৪৯০ জন অনুপস্থিত।
পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করায় ৩৬ জন পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়। শিক্ষার্থীদের এই বিশাল অঙ্কের অনুপস্থিতি শিক্ষা কর্তৃপক্ষককে ভাবিয়ে তুলেছে। তাই ঢাকা বোর্ডের আওতায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের চিঠি পাঠানো হয়েছে শিক্ষার্থীদের এই অনুপস্থিতির কারণ অনুসন্ধানের জন্য।
প্রত্যেক অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীর জন্য পৃথক পৃথক ছকে তথ্য পাঠাতে বলা হয়েছে। যতোজন অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীর তথ্য পাঠাতে হবে, ততোবার লিংকে ক্লিক করে পৃথক পৃথক ফরমে তথ্য পাঠাতে হবে। অনুপস্থিতির কারণ জানার জন্য পরীক্ষার্থী বা অভিভাবকের সঙ্গে স্বশরীরে বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আলোচনা করে তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। ঢাকা বোর্ডের পরে সম্ভবত অন্যান্য বোর্ডও একই পদ্ধতি অবলম্বন করছে।
শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকার আসলে কারণগুলো কী কী? এটি মূলত শ্রেণিকক্ষ থেকেই শুরু হয়। শিক্ষার প্রকৃত বিষয় একপাক্ষিক নয়। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়মুখী হয়। একটি বিষয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা, স্টাডি ও গবেষণা প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের মারাত্মক অনুপস্থিতি। আজ যে শিক্ষার্থী শ্রেণিতে আসেন, কালকে তিনি অনুপস্থিত।
এর ফলে লেখাপড়ায় ছন্দ থাকে না, তারা জ্ঞানার্জন করার প্রকৃত স্বাদ পান না। এটি এমন একটি পর্যায়ে চলে গেছে যে, শিক্ষক এসব শিক্ষার্থীদের জোর করে কিছু বলতে পারেন না দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে।
অনেক অভিভাবকও চান না তাদের ছেলেমেয়েদের ওপর শিক্ষক বা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো বিষয়ে জোর করুক বা চাপ প্রয়োগ করুক। ফলে যা হয়, কোমলমতি শিক্ষার্থী যারা নিজেদের ভালো বোঝেন না, জীবনের গতি প্রকৃতি ঠিক করতে পারেন না। তাদের শিক্ষক ও অভিভাবকদের ওপরই নির্ভর করতে হয়। সেটি যখন ছন্দ হারিয়ে ফেলে তখন তার বহু ধরনের প্রকাশের মধ্যে একটি হচ্ছে পাবলিক পরীক্ষায় না বসা।
দেশের পাবলিক পরীক্ষার (এসএসসি ও এইচএসসি) ফর্ম পূরণ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য এক ধরনের আতঙ্কে কারণ প্রতিষ্ঠানকে বাইরের বিভিন্ন চাপে পড়ে পরীক্ষায় একেবারেই প্রস্তত নয় এমন সব শিক্ষার্থীদের ফরম পূরণ করাতে হয়। স্কুল বা কলেজের নির্বাচনী পরীক্ষার পর প্রায় প্রতিষ্ঠানেই বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়।
এটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরা যাতে বেশি ভালো করে সেজন্য এবং সেখানে কড়াকড়ি নিয়মের কারণে শিক্ষার্থীরা অনুপস্থিত থাকতে পারেননা। আর যেসব প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন কারণে দুর্বল সেগুলোতে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষের মতোই অনুপস্থিত থাকেন। ফলে, কোন বিষয়ের ধারাবাহিকতা তারা বোঝেন না।
এ অবস্থায় যখন পরীক্ষা এসে যায় তখন তারা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে অনেকেই অসদুপায় অবলম্বনের আশায় পরীক্ষার হলে যান। যদি সেটি করতে পারেন তাহলে পরীক্ষা চালিয়ে যান। আর যদি দেখেন যে, অবস্থা বেগতিক তখন তারা পরীক্ষা থেকে কাট মারেন। কাজেই হুট করে একটি বা দুটি কারণই যে শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষার মতো পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকছেন এবং সেটি দ্রুত কোনো পদক্ষেপ নিয়ে সমাধান করা যাবে বিষয়টি এমন নয়।
ঢাকাসহ বড় বড় শহরের অভিভাবকরা বাস্তব কারণে বিভিন্ন ধরনের ব্যস্ততার মধ্যে সময় কাটান। তাদের অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না বিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করার। আবার আমাদের বিদ্যালয়গুলোও এমন অবস্থায় নেই যে, শিক্ষার্থীদের সকল ধরনের দায়-দায়িত্ব তারা নিতে পারে।
বহু ধরনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে তাদের। আমরা এই সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেভাবে গড়ে উঠতে দিইনি, এটি সম্মিলিত ব্যর্থতা। অনেক ঘটনা ঘটার পরে, অনেক আলোচনা সমালোচনার পরে সরকারি একটি সিদ্ধান্ত আসে যেটি হুট করে সমাধান করা বা এক দুটি পদক্ষেপের মাধ্যমেই সমাধান করা যায় না।
এর শেকড়ে যেতে হয়, গভীরে যেতে হয়। দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপের প্রয়োজন হয়, যা করার সময় থাকে না কারোরই, কাজেই এর ফল সমাজেক ভোগ করতেই হয় এবং হবে। এর ফলই আমরা দেখতে পাচ্ছি শিক্ষার্থীরা ইচ্ছে মতো যেমন শ্রেণিকক্ষে আসেন না, প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম, শ্রেণিকার্যক্রম ও বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন না, তার ফল গিয়ে পড়েছে পাবলিক পরীক্ষাতেও।
বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে যে, ইচ্ছে হলে ক্লাসে গেলাম, না হলে গেলাম না। ইচ্ছে হলে স্কুল-কলেজের আভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় বসলাম, ইচ্ছে হলো না বসলাম না। এখানে শুধু প্রতিষ্ঠানের নয়, অভিভাবকদের, সমাজ এবং শিক্ষা প্রশাসন সকলের দায়িত্ব রয়েছে। বিষয়টি এখান থেকে শুরু না হলে পাবলিক পরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় এ ধরনের অনুপস্থিতির ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক।
শিক্ষা বোর্ডগুলো এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় তিন/চার বার পর্যন্ত বৃদ্ধি করে থাকেন। এতে অনুত্তীর্ণ ছাত্র-ছাত্রীরা আবার প্রতিষ্ঠানে এসে ভিড় জমান। টেস্ট পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ ছাত্র-ছাত্রীরা ঢালাওভাবে ফরম পূরণ করার জন্য একটা বাড়তি সুযোগ পেয়ে যান।
এতে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধনরা বিব্রতকর অবস্থায পড়ে যান। বোর্ড কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে নিয়মিত আসার অভ্যাস যাতে গড়ে তোলেন সেজন্য শিক্ষক, প্রতিষ্ঠান, অভিভাবকদের যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে তেমনি শিক্ষা প্রশাসনকে যথাযোগ্য নিয়ম-কানুন প্রয়োগ করতে হবে।
এখানে ব্যক্তি বিশেষ, রাজনৈতিক কিংবা প্রভাবশালী কেউ যাতে বিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তের ওপর হস্তক্ষেপ করতে না পারে সেটি অভিভাবক, সমাজ এবং শিক্ষা বিভাগকে নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষকে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা প্রদান করতে হবে এবং সেখানে কেউ যাতে অযাচিত হস্তক্ষেপ করতে না পারে সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই আমরা একটি ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষা পরিক্রমা প্রত্যক্ষ করতে পারবো।
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক