
কারিগরি শিক্ষা বলতে বিভিন্ন ট্রেডভিত্তিক নির্দিষ্ট শিল্প প্রতিষ্ঠানের উপযোগী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকে বোঝায়। তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক কার্যক্রমের মাধ্যমে এই শিক্ষা অর্জন করতে হয়। কোনো দেশে দক্ষ কর্মী তৈরি করতে কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
আগামী দিনে যে নতুন প্রযুক্তিগত বিপ্লব আসছে, তার জন্য কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারিগরি দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ও নারীদের অংশগ্রহণ জরুরি। বর্তমান কর্মসংস্থানের তীব্র সংকটে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত বেকার জন্ম নিচ্ছে প্রতিবছর।
তারা সমাজে ও পরিবারের বোঝা হয়ে আছে। তাদের কর্মস্থান নেই, মর্যাদা নেই, না পরিবারে না সমাজে। কর্মসংস্থান থাকলেও শিক্ষা অনুযায়ী পদে কাজ নেই। এতে হতাশা নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে।
অন্যদিকে কারিগরি প্রশিক্ষণ পেশাভিত্তিক শিক্ষা যা কায়িকশ্রম ভিত্তিক শিক্ষা। কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে একজন টেকনেশিয়ান, প্লাম্বার, মেকানিক, ইলেক্ট্রিশিয়ান, অটোমোবাইল মেকানিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত হচ্ছে। কারিগরি কোর্স সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থানে প্রবেশ করে পরিবারের হাল ধরে অনেকে দিব্যি সুখে শান্তিতে সংসার করছে।
সমাজ তাদের উপার্জনে নানাভাবে উপকার পাচ্ছে। উপার্জনকারী হিসেবে দেশ গঠনে বিশেষ অবদান রেখেই চলছে। শুধু তাই নয় বিদেশে গিয়েও বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে দেশে পাঠাচ্ছে।
বর্তমানে দেশে কারিগরি শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার ১৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের অধীনে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীর এনরোলমেন্ট ৩০ শতাংশ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে গেছেন ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩ শ্রমিক।
এর মধ্যে মাত্র ১৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ দক্ষ বাকি ৮২ দশমিক ২৪ শতাংশই অদক্ষ। বাংলাদেশ থেকে স্বল্প দক্ষ কর্মী অভিবাসনের হার গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রায় ২৩ শতাংশ কমে ৬ লাখ ২৬ হাজারে দাঁড়িয়েছে। বিএমইটির তথ্য অনুসারে, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ রেকর্ড ১২ লাখ কর্মী বিদেশে পাঠিয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে কতোজন প্রশিক্ষণ পেয়ে ওই বছরেই বিদেশে গেছেন, তা জানে না কর্তৃপক্ষ। ‘যারা ট্রেনিং নেয়, তাদের অনেকে বছর খানেক দেশে কাজ করেন। তারপর সুযোগ বুঝে বিদেশে যায়।
তবে তারা কতোজন বিদেশে গেলো, এই তথ্য আমাদের কাছে থাকে না।’ শিক্ষাবিদরা বলছেন, বিদেশে কাজের ক্ষেত্রে এই ঘাটতি কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমেই দূর করা সম্ভব। কিন্তু জোড়াতালি দিয়ে চললে কারিগরি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কোনোভাবেই পূরণ হবে না। ‘অর্থায়ন করা মানেই সব দায়িত্ব শেষ নয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘সহজ কথায় ‘ডিজিটাল রেভল্যুশন’ বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝি, সেটাই চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। আর সেটি কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমেই আমরা লাভ করতে পারি। ‘আমাদের কারিগরি শিক্ষা নানা সমস্যায় জর্জরিত। বলা যায়, অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। তা ছাড়া শুধু দক্ষতার ঘাটতির কারণে আমাদের প্রবাসী শ্রমিকেরা কম বেতন পান।
এ ঘাটতি কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমেই পূরণ করা সম্ভব।’ এই শিক্ষাবিদ কারিগরি শিক্ষার বিভিন্ন সমস্যা দ্রুত নিরসনের পাশাপাশি পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি যুগোপযোগী করার তাগিদ দেন। বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীকে দক্ষ জনসম্পদে পরিণত করতে পারলেই তারা হবে দেশের উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি।
দেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষক ও প্রশিক্ষক সংকট অনেক। ল্যাব বা গবেষণাগারও অপর্যাপ্ত। অনেক প্রতিষ্ঠানে ল্যাব থাকলেও যন্ত্রপাতি নেই। দেশের সরকারি-বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ ল্যাবে নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। কিছু ল্যাবের সব যন্ত্রপাতিই অকার্যকর। আবার যেসব প্রতিষ্ঠানে ল্যাব ও যন্ত্রপাতি আছে, সেখানে শিক্ষক সংকটের কারণে হাতে-কলমে শিক্ষা দেয়া সম্ভবপর হচ্ছে না। ল্যাব ও যন্ত্রপাতি না থাকার কারণে ডেমো ক্লাস নেন শিক্ষকরা।
শিক্ষকদের অভিযোগ, কারিগরি শিক্ষার সিলেবাস যুগোপযোগী করা হচ্ছে না। এতে চাকরির বাজারের জন্য যোগ্য হতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মনোযোগ বেশি সার্টিফিকেট বাণিজ্যে। ‘প্রতিনিয়ত টেকনোলজির পরিবর্তন হচ্ছে।
কিন্তু আমরা সেই পথে নেই। আগের সিলেবাসকেই আঁকড়ে আছি। একাডেমির সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রির যোগসূত্রেও আমাদের গুরুতর ঘাটতি রয়েছে। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে দেশে চার বছর মেয়াদি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ বা শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, এগ্রিকালচার, ফিশারিজ, ফরেস্ট্রি, লাইভস্টক, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি, ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং (নেভাল), ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং (আর্মি) ও ডিপ্লোমা ইন মেডিক্যাল টেকনোলজিতে ডিপ্লোমা কোর্স পরিচালিত হচ্ছে। এ ছাড়া ‘জাতীয় দক্ষতামান’ (বেসিক ৩৬০ ঘণ্টা) নিয়েও তিন থেকে ছয় মাস মেয়াদি শিক্ষাক্রম পরিচালনা করছে।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো ৮১ শতাংশের বেশি শিক্ষকের পদ শূন্য রেখেই শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রশাসন শাখা বলছে, দেশের সরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ১৫ হাজার ৫৯৭টি পদের মধ্যে কর্মরত আছে মাত্র ২ হাজার ৮৯৩ জন শিক্ষক। বাকি ১২ হাজার ৭০৩টি পদই শূন্য। এ ছাড়া ৬ হাজার ৭০টি কর্মচারী পদও ফাঁকা।
কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় কিছু অভ্যন্তরীণ সমস্যা সার্বিকভাবে শিক্ষার্থীদের অনাগ্রহী করে তুলছে। যেমন-এসএসসি ও এইচএসসির যৌথ যোগ্যতা। ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং চার বছরের সার্টিফিকেশন কোর্স হলেও এই শিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে যেমন- কারিগরি শিক্ষা সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত নেতিবাচক ধারণা সম্পর্কে সরকার অবগত হলেও দুঃখের বিষয়, এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো উদ্যোগ নেই; মর্যাদাবান কর্ম ক্ষেত্রের অভাব; মানসম্পন্ন কাজের পরিবেশ না থাকা; নিম্ন বেতন; ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের অতি দীর্ঘ কর্ম ঘণ্টা; ওয়ার্ক লাইফে ব্যালান্সহীনতা; বিদেশে দক্ষ শ্রম বাজার খোঁজায় সরকার ও প্রশাসনের ব্যর্থতা; পশ্চাৎপদ শিক্ষাদান পদ্ধতি, মানহীন শিক্ষক, প্রশ্ন ও উত্তর পত্র মূল্যায়নে অনিয়ম; ল্যাব ফ্যাসিলিটির স্বল্পতা, আর্থিক বরাদ্দ প্রভৃতি বহুমাত্রিক সংকট; মন্ত্রণালয়ের মনোযোগের স্বল্পতা; প্রাকটিক্যাল উপকরণের অধিকাংশই ব্যবহার অনুপযোগী। কোনো কোনোস্থানে ল্যাব থাকলেও নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ, প্রাকটিক্যালের জন্য নেই কোনো ভারী, মূল্যবান ও অতি প্রয়োজনীয় উপকরণ।
রাজধানীর বাইরে পলিটেকনিক্যালে শিক্ষার্থীরা না পায় ভালো মানের শিক্ষক না পায় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের উপকরণ, এটাকে টাকা দিয়ে সার্টিফিকেট কেনা বললেও খুব একটা ভুল বলা হবে না। কারিগরি শিক্ষা সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক ধারণা, অভিভাবকদের অসচেতনতা, প্রচার-প্রচারণার অভাব, আন্তরিকতার ঘাটতি, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ দেয়া হলেও তার ফলোআপ না করা, উদ্যোক্তাদের পুঁজির অভাব, সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ না পাওয়া, বাজার অনুযায়ী ট্রেড গঠন না করা, কারিকুলাম আধুনিকায়নের অভাব, বাজেটে বরাদ্দ কম ইত্যাদি বিষয়গুলো অন্যতম।
সার্বিকভাবে কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন। সংস্কার এমন হতে হবে যাতে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব উপযোগী মানবসম্পদ উৎপাদনে নেতৃত্ব দিতে পারে। এই সুদীর্ঘ যাত্রায় নেতৃত্ব, সরকার, প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান সবার সৎ, দায়িত্বশীল, জ্ঞান ও প্রজ্ঞাবোধে তাড়িত হয়ে সঠিক ও কার্যকর ভূমিকা রাখা দরকার। এজন্য প্রয়োজন একটি ভবিষ্যৎমুখী ও কার্যকর স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এবং এর যথাযথ বাস্তবায়ন। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের বহু স্বল্পমেয়াদি কারিগরি কোর্স এ খাতে আসবে।
তবে কোর্সে কনটেন্ট, শিক্ষাদান পদ্ধতি, হাতে কলমে প্রশিক্ষণের উপকরণ, শিক্ষকের মান প্রভৃতি নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় যেসব সংস্কার প্রয়োজন তা হলো-কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার কোর্সসমূহকে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারগুলোর চাহিদামাফিক উন্নীত করা; দেশীয় শিল্প উৎপাদন ও কারিগরি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক সমস্যাগুলোর সমাধান করা; পর্যাপ্ত অবকাঠামো, ল্যাবরেটরি সুবিধা, শিক্ষা উপকরণ, মানসম্পন্ন শিক্ষক ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চাহিদা অনুযায়ী মানসম্পন্ন কারিগরি শিক্ষা কোর্স চালু করা; বিদেশি শ্রমবাজারের পাশাপাশি বাংলাদেশি শিল্প-কারখানা চাহিদা অনুযায়ী কোর্স কারিকুলাম প্রণয়ন; কারিগরি প্রতিষ্ঠানসমূহের অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং ল্যাব সুবিধা নিশ্চিতকরণ; সব প্রতিষ্ঠানের যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণ, পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে সমতা আনায়ন; বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দক্ষতার আলোকে সাজানো; বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত বিভিন্ন ধরনের এবং মেয়াদের প্রশিক্ষণ কোর্সগুলো যাতে সার্টিফিকেট সর্বস্ব না হয়ে শ্রমবাজারের চাহিদামাফিক হয় তার ব্যবস্থা করা; কারিগরি শিক্ষার চাহিদার তুলনায় শিক্ষা বাজেট, বিভিন্ন প্রণোদনা নিশ্চিতসহ এই শিক্ষায় কেন্দ্রীয় মনোযোগ বাড়ানো; কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং এ বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিত করা।
দক্ষ কর্মী তৈরিতে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক কর্মকাণ্ড কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় আনা জরুরি। কারিগরি শিক্ষার প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত করা, বাজেট বাড়ানো, শিক্ষকদের আধুনিকায়ন ও বহুমুখী শিক্ষায় দক্ষতা বাড়ানো দরকার। কারিগরি ও একাডেমিক উভয় শিক্ষারই ভাল ও মন্দ দিক রয়েছে। আজকাল অনেক কারিগরি প্রতিষ্ঠান উচ্চশিক্ষা প্রদান করে থাকে। যেসব স্নাতকরা ডিপ্লোমা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে বের হন তাদের কাজ পেতে কোনো সমস্যা হয় না। স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য ও কর্মসংস্থান নিশ্চিতের জন্য লেখাপড়ার পাশাপাশি কারিগরি প্রশিক্ষণের দিকে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। দেশের কারিগরি শিক্ষাকে আরো মানসম্মত করে গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের সঙ্গে বেসরকারি উদ্যোগ জরুরি। চীন, তাইয়ান, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য উৎপাদনমুখী দেশের নীতিকে অনুসরণ করে কারিগরি শিক্ষাকেও উৎপাদনমুখী করার পদক্ষেপ নিলে দেশে বেকারত্বের হার কমে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
কারিগরি শিক্ষাকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে সরকারিভাবে কার্যকর স্বীকৃতি দেয়া, স্বল্পমেয়াদি কোর্সের চাইতে দীর্ঘমেয়াদি এবং কর্ম চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোর্সের ওপর জোর দেয়া, চলমান পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত শিক্ষা বাজার উপযোগিতার সঙ্গে সমন্বয় করা, দক্ষ জনবল নিয়োগ, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি হাতে কলমে শিক্ষার ওপর জোর দেয়া, শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ ও পাঠদানে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, নারীদের জন্য কারিগরি শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি, পুঁজিহীন উদ্যোক্তাদের সনদকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণ সরবরাহ করা, কারিগরি শিক্ষা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে তৈরি হওয়া ধারণা বদলানো, সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো, দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষার সুযোগ তৈরিতে পর্যটন ও কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে উদ্যোগ নেয়া, চাকরিতে কারিগরি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করাসহ নানা উদ্যোগ নিলে জনশক্তি সম্পদে পরিণত হবে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ জনবল সৃষ্টি করতে হবে। এজন্য কারিগরি শিক্ষার ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার উন্নয়নে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কাজে লাগানো, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে, বিপুল সম্ভাবনা তৈরি, ঝুঁকি দূর করা, অদক্ষ-স্বল্পদক্ষ জনশক্তিকে ক্রমাগতভাবে বাজার চাহিদাকেন্দ্রিক দক্ষতায় রূপান্তর করতে শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন।
দেশের প্রকৃত মেধাবীদের দিয়ে তৈরি একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষা সংস্কার পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন। আমরা চাই মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান বাস্তবায়নের একটি কার্যকর মাস্টারপ্ল্যান। এমতাবস্থায় কর্মসংস্থান ও শিক্ষা সংস্কার প্রস্তুতির পাশাপাশি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, মানবিক ভবিষ্যৎ তৈরি করার জন্য সরকার, প্রশাসন, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা ও শিল্প গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিক সমাজের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। বাংলাদেশের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রস্তুতি সময়ের সঙ্গে পাল্টা দিয়ে অগ্রসর হোক। অবকাঠামোগত, কর্মসংস্থান ও পরিবেশগতভাবে উন্নত হোক। বাংলাদেশ দূরদর্শী ও টেকসইভাবে উন্নতির স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করবে একদিন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: সাবেক মহাপরিচালক, নায়েম