
আজ ১ মে, মহান মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও পালিত হয় মে দিবস। শ্রমিকের শ্রমে আর ঘামে নির্মিত হয় সুরম্য অট্টালিকা। কিন্তু সে অট্রালিকায় শুতে পারেন না শ্রমিক। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, শ্রমিকদের ঘামের ওপর এই সভ্যতা গড়ে উঠেছে। ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দ ৮ কর্মঘণ্টা কাজ করার দাবি নিয়ে আন্দোলনে নেমে শ্রমিকরা রক্তের বিনিময়ে তাদের দাবি প্রতিষ্ঠিত করেছিলো। কিন্তু ২০২৫-এ এসেও শ্রমজীবীরা শোষিত, নিগৃহীত ও বঞ্চিত রয়েই গেলো। এখনো তাদের আট ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হয়। মে দিবস পালনের স্বার্থকতা তখনই আসবে যখন আমরা শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করতে পারবো। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার ও পাওনা থেকে বঞ্চিত রেখে মে দিবস পালনের মাঝে কোনো স্বার্থকতা নেই। শ্রমকে ভিত্তি করে সভ্যতার সূচনা হলেও শুরু থেকে শ্রমিকের মর্যাদা বলে কিছুই ছিলো না। শ্রমজীবী খেটে খাওয়া মানুষের অবস্থা ছিলো খুবই নাজুক। শ্রমিকদের নাম মাত্র মজুরি দিয়ে ইচ্ছে মতো কাজ করাতো মালিকরা। ছিলো না কোনো নির্দিষ্ট কর্ম ঘণ্টা। সেই ঐতিহাসিক ১ মে তে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে করা আন্দোলন সে সময় সফল হলেও তার প্রকৃত বাস্তবায়ন ঘটেনি। অনেক ক্ষেত্রে আজও রয়েছে অসামঞ্জস্যতা। শ্রমিকদের শোষণ করার নীতি যেনো অলিখিতভাবে বিদ্যামান। বাংলাদেশ জেনেভা কনভেনশনের স্বাক্ষরিত একটি দেশ হলেও কিছু ক্ষেত্রে দেখা মেলে ভিন্ন চিত্র। [inside-ad]
বেতন-ভাতা নিয়ে এখনো গার্মেন্টসগুলোতে অসন্তেুাষ দেখা যায়। এখনো শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে মামলা মোকদ্দমা করত হয়। এসব সমস্যার সমাধান খুবই জরুরি। একদিন ঘটা করে মে দিবস পালন করলাম, বক্তব্য দিলাম, মিছিল করলাম, তারপর সারা বছর আর খরব থাকে না, এটা হওয়া উচিত না। প্রতিষ্ঠান বাঁচলে মালিক তার ব্যবসা বাণিজ্য চালিয়ে যেতে পারবে। আর মালিক প্রতিষ্ঠান চালাতে পারলে শ্রমিক বাঁচবে। শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন-২০০৬ এর আওতায় গত বছরের ১৮ নভেম্বর নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য গোষ্ঠী বিমা স্কিম চালু করে সরকার। মে দিবসের অঙ্গীকার হোক সুস্থভাবে কাজ করার নিশ্চয়তা চাই।
১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি ও ৮ ঘণ্টা শ্রম সময় নির্ধারণসহ অন্যান্য দাবিতে এক সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হয়। হে মার্কেটে গণজমায়েতেরও আয়োজন করে। এ সময় শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার এক অবিস্মরণীয় দিন। বিশ্বের সব মেহনতি মানুষের মুক্তি ও অধিকার অর্জনের অফুরন্ত অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এ পহেলা মে। শ্রমিক শোষণ ও নির্যাতন প্রতিরোধে আত্মত্যাগের এক মহান আদর্শে উজ্জীবিত এ দিন। দুঃখজনকভাবে একশ বছর আগেকার সেই সমস্যার সমাধান আজও হয়নি। বরং সেই একই কায়দায় এবং কৌশলে শ্রমিকরা নিগৃহীত শোষিত বঞ্চিত বিশেষ বছর তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশগুলোর শ্রমিকদের অবস্থা সত্যিই নিদারুণ কষ্টের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরও শ্রমিকরা এখনো অর্ধাহারে কিংবা অনাহারে রাত্রি যাপন করে। অনেক দেশে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি দেয়া হয় না।[inside-ad-2]
আমাদের দেশেও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন তাদের মজুরি সংক্রান্ত দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি আমাদের দেশে এখনো শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বাংলাদেশেও প্রতিবছর মহান মে দিবস, পালিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। এই উপলক্ষে থাকে সভা সমাবেশ। এই উপলক্ষে আয়োজিত সভা-সমাবেশে সারগর্ভ বহু বাণী প্রদান করেন জাতীয় পর্যায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা। কিন্তু পরদিন থেকেই আবার গতানুগতিক জীবন স্রোতে ভেসে চলে সবাই। তাই আজও দেশের সরকারি অফিস আদালত প্রতিষ্ঠান আর কলকারখানার উৎপাদনমুখি কর্মকাণ্ডের চেয়ে দিনগত ঝরে যাচ্ছে বহু অমূল্য প্রাণ, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কলকারখানা। অন্যদিকে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য মজুরি পাচ্ছে না। আট ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হচ্ছে। বিভিন্ন গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত উদাহরণ। অন্যদিকে শিশু শ্রমের প্রথা ও প্রচলিত। বিভিন্নক্ষেত্রে নিয়োজিত এ সমস্ত শ্রমিকেরা নানাভাবে শোষিত হচ্ছে। তাদের জীবন হচ্ছে হুমকির সম্মুখীন। তারা অপুষ্টির শিকার, অমানবিক ব্যবহারের শিকার অনেক ক্ষেত্রে বৈষম্যেরও শিকার।
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ অরুচিসম্পন্ন জায়গায় শ্রমিকরা এখানে গতর খাটুনি খাটে। কিন্তু মজুরির বেলায় সে রকম নয়। দেশে এখানো গার্মেন্টস শ্রমিকদের তিন মাসের পারিশ্রমিক বাবদ এক মাসের বেতন ধরিয়ে দেয়ার উদাহরণ। এ ছাড়া গার্মেন্টস পেশায় নিয়োজিত নারী শ্রমিকদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। এখানে শ্রম দিতে এসে নারীরা ধর্ষিত হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে এবং আগুনে পুড়ে, ভবন ধসে প্রাণহানি ঘটে। এই যদি হয় শ্রমিকদের অবস্থা তাহলে মে দিবস পালনের স্বার্থকতা কোথায়। যদিও সরকারিভাবে বারবার বলা হচ্ছে, আইনগতভাবে কারখানা পরিচালনা করার কথা, তবুও পর্যন্ত এই অসংগতিপূর্ণ ব্যবস্থা দূর হয়নি।[inside-ad-3]
শ্রমজীবী মানুষ এখনো পূঁজির শোষণ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। প্রতিবছর তারা মে দিবসে নতুন করে শপথ নেয় তাদের নিজ নিজ দেশে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও এক হও’ এটা নিছক একটা শ্লোগান হয়। আমরাও চাই দুনিয়ার মজদুর ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিশ্ব শান্তি সমৃদ্ধির পথে হোক সহায়ক শক্তি। সাম্যের পতাকাতলে সামিল হোক সবাই ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের জয়গান গেয়ে। মে দিবসে শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়ে থাকে। কোনোভাবে জীবনধারণের মতো জীবিকার সংস্থানই কিন্তু একজন মানুষের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি নয়। এই বিশাল শ্রমজীবী শ্রেণির নৈতিক ও মানসিক উৎকর্ষ সাধনের বাস্তবসম্মত কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। প্রতিদিন রাস্তাঘাটে ও কর্মস্থলে নারী শ্রমিকরা উত্তক্ত্যের শিকার হয়, ইজ্জত-আব্রু হারায়, এমনকি বিপথগামীও হয়। নিপীড়ন ও পাপাচারের এই পঙ্কিল স্রোত বন্ধ করার চেষ্টা করা জরুরি। মে দিবসে শুধু শ্রমিকের অধিকার রক্ষার কথাই বলা হয়। একটি বঞ্চনার অনুভূতি সৃষ্টি করা হয় এবং নেতাদের পক্ষ হতে নির্ধারিত প্রতিপক্ষকে আঘাত করার উসকানি দেয়া হয়।
শ্রমজীবী সমাজের বঞ্চনা যেমন গ্রহণযোগ্য নয়, তেমনি তাদের কারো কারো অন্যায় ও অবিচারও প্রশ্রয়যোগ্য নয়। সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলার স্বার্থেই এই উভয় প্রান্তিকতা বর্জনীয়। শুধু শ্রমজীবী সমাজেরই নয়, সমাজের সব শ্রেণির নারী ও পুরুষের যেমন রয়েছে জীবিকার অধিকার, তেমনি রয়েছে মনুষ্যত্ব অর্জনের অধিকার। সব পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের কর্তব্য অধীনস্তদের মাঝে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটানো। সর্বোপরি মালিক, শ্রমিক ও সরকারের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে কাঙ্ক্ষিত বৈষম্যহীন বাংলা গড়ার লক্ষ্যে।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক