
শিক্ষার উন্নয়ন ব্যতিরেকে জাতীয় উন্নয়নের স্বপ্ন দেখা মূর্খতা। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক, মন্ত্রী, উপদেষ্টা শিক্ষা ব্যবস্থাকে সংকোচন করে জাতির উন্নতির বুলি আওড়ানো নিছক প্রতারণা। এ প্রতারণা থেকে শিক্ষা ব্যবস্থাকে মুক্ত করা দরকার।
এ জন্য শিক্ষার বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এবারে বাজেটে বরাদ্দ প্রত্যাশা রইলো। প্রাথমিক শিক্ষকদের ১০ম, প্রধান শিক্ষকদের ৯ম গ্রেড, শতভাগ পদোন্নতিসহ শিক্ষা সংকোচন বিষয়টি যথাযথ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা দরকার। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের ০৯/০৩/২০১৪ হতে ২য় শ্রেণির মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল।
অথচ বেতন স্কেল দেওয়া হয়েছিল ১১তম গ্রেড। ২য় শ্রেণির মর্যাদাসহ ১০ম গ্রেড প্রাপ্তির লক্ষে মহামান্য সুপ্রীমকোর্ট কর্তৃক রায় প্রদান করা হয়। রায়টি সময়ক্ষেপণ না করে বাস্তবায়ন প্রত্যাশা রইল। বিগত সরকারের ধ্যানে মগ্ন থেকে সহকারী শিক্ষকদের যৌক্তিক প্রত্যাশা ১০ম গ্রেডকে পাশ কাটিয়ে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে পুরো শিক্ষক সমাজ হতাশ ও মর্মাহত।
সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ যোগ্যতা, স্নাতক সমমান (২য় বিভাগ) বেতন গ্রেড ১৩, থার্ড ক্লাস মর্যাদা। একই সমমানের যোগ্যতায় অন্যান্য সরকারি দপ্তরে বেতন গ্রেড ১০ম, ২য় শ্রেণি মর্যাদা, পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর, মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদ, সচিব নিয়োগের যোগ্যতা স্নাতক সমমান, (২য় বিভাগ) বেতন গ্রেড ১০ম, মর্যাদা ২য় শ্রেণি। নার্সদের নিয়োগের যোগ্যতা, এইচ.এস.সি (ডিপ্লোমা ইন নার্সিং), উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নিয়োগের যোগ্যতা এস.এস.সি (৪ বছরের কৃষি ডিপ্লোমা) বেতন গ্রেড ১০ম, ২য় শ্রেণির মর্যাদা।
এছাড়া সমযোগ্যতা ও একই কাজে কর্মরত আছেন পি.টি.আই পরীক্ষণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো তাদের কাজের ব্যাপকতা নেই। তাদেরও বেতন স্কেল ১০ম গ্রেড ও মর্যাদা ২য় শ্রেণি।
অথচ কলঙ্কিত থার্ড ক্লাস মর্যাদা ও ১০ম বেতন স্কেল প্রাপ্তির লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পর্যন্ত আন্দোলন করে যাচ্ছেন প্রাথমিক শিক্ষক সমাজ। অথচ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিগত সরকারের প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষতিকর কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়নের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন। প্রাথমিক শিক্ষার সংস্কারের জন্য গঠিত কনসালটেশন কমিটি স্টেক হোল্ডারদের পরামর্শ আমলে না এনে অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা সম্প্রসারণের পরিবর্তে বাণিজ্যিক শিশু শিক্ষা সুপারিশ করেছেন।
সহকারী শিক্ষকদের যৌক্তিক বৈষম্য আমলে না এনে বেতন বৈষম্য নিরসনের গলার কাটা জুনিয়র-সিনিয়র ও স্বল্প সংখ্যক সহকারী প্রধান শিক্ষক পদ সৃষ্টি করে প্রাথমিক শিক্ষকদের পদোন্নতি নামে প্রহসর সৃষ্টি করেছেন। বর্তমানে প্রায় ৪০ হাজার প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য। দীর্ঘসময় হতে এ শূন্যতা প্রাথমিক শিক্ষা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সর্বমহল প্রাথমিকের এ বেহাল অবস্থার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমালোচনায় মুখর।
আওয়ামী লীগ সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতি- ২০১০ মোতাবেক সকল প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ক্রমে- ২০১৮ সালের মধ্যে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত চালু করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। অথচ ২০১৪ সালের মধ্যে মাত্র ৭২৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৮ম শ্রেণি চালু করেছিল। পরবর্তী ১০ বছর শুধু বিদ্যালয়সমূহ জন্য কোন বাড়তি বরাদ্দ না দিয়ে বন্ধ করার মহড়া মন্ত্রী, সচিব, নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তাদের বক্তৃতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটি, সাধারণ মানুষের অবৈতনিক শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালিয়ে যান।
বিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামোগত সুবিধা, যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক থাকায় সারাদেশের প্রায় সকল বিদ্যালয় অবৈতনিক মানসম্মত শিক্ষা প্রদান করে যাচ্ছেন। কনসালটেশন কমিটি আহ্বায়কসহ বেশীরভাগ সদস্য এন.জি.ও বা ব্র্যাকের। তারা তৃণমূলের গরীব মানুষের অবৈতনিক শিক্ষা সম্প্রসারণ হোক, এ মানসিকতা তাদের মাঝে মোটেই দৃশ্যমান ছিল না। তারা ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত ৭২৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ করার পরামর্শ দেন। পাশাপাশি শিশু শিক্ষায় ট্রেনিংবিহীন প্যারা শিক্ষক সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের সুপারিশ, শিশু শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে প্রাথমিক শিক্ষাকে বেসরকারিকরণের গভীর ষড়যন্ত্র।
শিশু শিক্ষাকে সমৃদ্ধ করার জন্য প্রয়োজন অভিজ্ঞ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত জনবল। এ জন্য প্রয়োজন তৃণমূলের সহকারী শিক্ষকদের নিয়োগ দিয়ে শতভাগ পদোন্নতি দিয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। তাদের সুপারিশগুলো প্রাথমিক শিক্ষাকে মানহীন করে, জাতীয়করণকৃত শিশু শিক্ষার সুনাম বিনষ্ট, পূর্বের মত ব্র্যাকের কাছে ন্যস্ত করার ষড়যন্ত্র।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বৈষম্য নিরসন তথা থার্ড ক্লাস মর্যাদা থেকে অব্যহতি দেওয়ার লক্ষ্যে সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড, প্রধান শিক্ষকদের ৯ম গ্রেড যৌক্তিক যা সর্বমহলের প্রত্যাশা। জুনিয়র-সিনিয়র তথা স্বল্প সংখ্যক সহকারী প্রধান শিক্ষক সৃষ্টির তালবাহানা না করে সহকারী শিক্ষকদের ৪০ হাজার প্রধান শিক্ষক পদে শীঘ্র পদোন্নতি কাম্য। ৭২৯টি ৮ম শ্রেণি উন্নীত প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ পরামর্শ গরীব মানুষের অবৈতনিক শিক্ষা পথ রুদ্ধ করা। এটা প্রাথমিক শিক্ষার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র। এর বিরুদ্ধে শিক্ষক, অভিভাবক, সচেতন মহলকে রুখে দাঁড়াতে হবে। সরকারি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোন অবস্থায় প্রশিক্ষণবিহীন প্যারা শিক্ষক কাম্য নয়।
প্রাথমিকের যৌক্তিক সমস্যা সময়ক্ষেপণ না করে অবিলম্বে দূর করার প্রত্যাশা রইল।
লেখক-শিক্ষাবিদ