
আধুনিক প্রযুক্তির চালিকাশক্তি হলো বিরল মৃত্তিকা মৌল বা রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস (Rare Earth Elements - REEs)। স্মার্টফোন থেকে শুরু করে ইলেকট্রিক গাড়ি, উইন্ড টারবাইন থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম– সর্বত্রই এই খনিজ পদার্থগুলোর অপরিহার্য চাহিদা। বিশ্বজুড়ে এই বিরল খনিজ পদার্থের সরবরাহ এবং নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একটি ভূ-রাজনৈতিক টানাপড়েন চলছে, যেখানে প্রধান প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ নতুন সম্ভাবনা নিয়ে উঁকি দিচ্ছে।
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে বিরল খনিজ পদার্থের সন্ধান পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যা একদিকে যেমন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে, তেমনি বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলেও একটি বিকল্প উৎস হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।
বিরল খনিজ পদার্থের গুরুত্ব ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট:
১৭টি রাসায়নিক উপাদানের একটি বিশেষ গোষ্ঠী হলো বিরল মৃত্তিকা মৌল। এদের "বিরল" বলা হলেও, ভূপৃষ্ঠে এদের প্রাচুর্য মোটেও কম নয়। তবে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক ঘনত্বের আকরিকের অভাব এবং নিষ্কাশন প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে এদের বিরল হিসেবে গণ্য করা হয়। এই খনিজ পদার্থগুলোর অনন্য চৌম্বকীয়, আলোকীয় এবং রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা আধুনিক প্রযুক্তির জন্য অপরিহার্য।
বিশ্বের বিরল খনিজ পদার্থের বাজারের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করে চীন। প্রায় ৬০ শতাংশ খনন এবং ৮৫ শতাংশ প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতা চীনের হাতে। এই আধিপত্যের কারণে অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, তাদের সরবরাহ শৃঙ্খলকে বৈচিত্র্যময় করার চেষ্টা করছে।
ইউক্রেন একসময় বিরল খনিজ পদার্থের একটি সম্ভাবনাময় উৎস হিসেবে বিবেচিত হলেও, চলমান ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা সেই সম্ভাবনাকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। এই প্রেক্ষাপটে, নতুন সরবরাহ উৎসের অনুসন্ধান বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
বিভিন্ন দেশের বিরল খনিজ পদার্থের মজুদের একটি আনুমানিক চিত্র হলো (USGS Mineral Commodity Summaries 2023 এবং অন্যান্য সূত্র থেকে নেয়া তথ্য): চীনের কাছে আনুমানিক মজুদের পরিমাণ ৪ কোটি ৪০ লাখ টন। যা মোট বৈশ্বিক মজুদের প্রায় ৩৫ ভাগ। ভিয়েত নামের কাছে ২ কোটি ২০ লাখ টন। ব্রাজিল ও রাশিয়ার কাছে ২ কোটি ১০ লাখ টন করে। ভারতের কাছে ৬৯ লাখ টন। অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৪১ লাখ টন। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ২৩ লাখ টন।
মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ও মাদাগাস্কার কাছে ১৭ লাখ, ১৪ লাখ ও ১২ লাখ টন করে আছে আনুমানিক মজুদ। এই তালিকা থেকে দেখা যায় যে চীন এখনো পর্যন্ত বিরল খনিজ পদার্থের বৃহত্তম মজুদ এবং উৎপাদনকারী দেশ। অন্যান্য দেশগুলো তাদের উৎপাদন এবং মজুদ বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। চীনের একক আধিপত্য এখনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি।
বাংলাদেশে বিরল খনিজ পদার্থের সম্ভাবনা:
সম্প্রতি বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি) দেশের বিভিন্ন স্থানে বিরল খনিজ পদার্থ অনুসন্ধানে আশাব্যঞ্জক ইঙ্গিত পেয়েছে। বিশেষ করে, উপকূলীয় অঞ্চল এবং কিছু পার্বত্য এলাকায় মূল্যবান বিরল মৃত্তিকা মৌলের উপস্থিতি শনাক্ত করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যদিও এখনো পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট মজুদের পরিমাণ নির্ধারণ করা যায়নি, প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রাপ্ত নমুনাগুলোতে যথেষ্ট আশার আলো আছে বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
এই সম্ভাবনা প্রকৃতি থেকে সত্যিকার ভাবে বাংলাদেশের হাতে ধরা দিলে তা হবে নব দিগন্তির উন্মোচন। দেশের জন্য একটি বড় সুযোগ তৈরি হবে বিশ্ব পরিমন্ডলে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জায়গায় এসব বিরল খনিজ পদার্থের উত্তোলন ও প্রক্রিয়াকরণ একটি নতুন শিল্প খাত তৈরি করবে। যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।
এছাড়াও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে উৎপাদিত খনিজ পদার্থ রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হবে। বিভিন্ন মূল্যবান ইলেকট্রনিক্স পন্য তৈরিতে প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে এক লাফে কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে দেশ।
এই খনিজ পদার্থগুলোর ব্যবহার সম্পর্কিত গবেষণা ও উন্নয়নের সুযোগ তৈরি হবে। যা দেশের সামগ্রিক প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। অনেকেই বিশ্বাস করেন আমেরিকার নজর ইউক্রেনে। এর মূল কারণ হলো তাদের বিরল খজিন পদার্থ। যা যুদ্ধের কৌশলে দখল নিতে চায় পরাশক্তি আমেরিকার সরকার। যা নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে সাম্প্রতিক কালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের বাকবিতন্ডাও হয়েছে তুমুল।
ফলে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায়ও বাংলাদেশ অবদান রাখতে পারবে। কথা হলো বাংলাদেশের পরিমান কত হতে পারে? তবে এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। যার মধ্যে রয়েছে ১) সুনির্দিষ্ট মজুদ নির্ধারণ: জিএসবিকে আরও বিস্তারিত ভূতাত্ত্বিক জরিপ পরিচালনা করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিরল খনিজ পদার্থের সুনির্দিষ্ট মজুদ এবং তাদের অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা নির্ধারণ করতে হবে।
২) পরিবেশগত প্রভাব: বিরল খনিজ পদার্থের উত্তোলন ও প্রক্রিয়াকরণ পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। তাই পরিবেশবান্ধব উত্তোলন ও প্রক্রিয়াকরণ প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
৩) প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ: এই খনিজ পদার্থ উত্তোলন ও প্রক্রিয়াকরণের জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা জরুরি।
৪) দক্ষ জনবল: এই খাতের জন্য দক্ষ খনি প্রকৌশলী, ভূতাত্ত্বিক এবং প্রযুক্তিবিদদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
বিরল খনিজ পদার্থের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বাংলাদেশকে একটি সুদূরপ্রসারী কৌশল গ্রহণ করতে হবে।
এই কৌশলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত:
• ব্যাপক ভূতাত্ত্বিক জরিপ: অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশব্যাপী বিরল খনিজ পদার্থের অনুসন্ধানে জোর দেওয়া।
• নীতি ও আইনি কাঠামো: বিরল খনিজ পদার্থের উত্তোলন, প্রক্রিয়াকরণ এবং রপ্তানির জন্য একটি স্পষ্ট ও বিনিয়োগবান্ধব নীতি ও আইনি কাঠামো প্রণয়ন করা।
• আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: প্রযুক্তি ও বিনিয়োগের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার মতো আগ্রহী দেশগুলোর সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
• গবেষণা ও উন্নয়ন: স্থানীয়ভাবে বিরল খনিজ পদার্থের ব্যবহার এবং প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির উন্নয়নে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করা।
• টেকসই উন্নয়ন: পরিবেশের উপর ন্যূনতম প্রভাব ফেলে কিভাবে বিরল খনিজ পদার্থ উত্তোলন ও ব্যবহার করা যায়, সে বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া।
বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিরল খনিজ পদার্থের ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং সরবরাহের অনিশ্চয়তা বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন সুযোগ উন্মোচন করেছে।
যদি জিএসবি'র প্রাথমিক অনুসন্ধান সঠিক প্রমাণিত হয় এবং বাংলাদেশ কার্যকর কৌশল ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে, তবে বিরল খনিজ পদার্থ উত্তোলন ও প্রক্রিয়াকরণ দেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনবে এটা বলতে কোন বিষেশজ্ঞের দরকার হয় না।
একইসাথে, এটি বিশ্বব্যাপী বিরল খনিজ পদার্থের সরবরাহ ব্যবস্থায়ও একটি নতুন ও নির্ভরযোগ্য বিকল্প উৎস হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থানকে সুদৃঢ় করবে। তবে এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য প্রয়োজন সুচিন্তিত পরিকল্পনা। প্রযুক্তিগত দক্ষতা। পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং পরিবেশগত দায়বদ্ধতা। বাংলাদেশ যদি এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে পারে, তবে বিরল খনিজ পদার্থ সত্যিই দেশের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
মো: আবু সাঈদ, লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।