
বর্তমান যুগকে বলা হয়ে থাকে তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। এই যুগে সবার হাতে হাতে প্রযুক্তি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আধুনিক জীবনব্যবস্থার সবচেয়ে বড়ো আশীর্বাদ হলো বর্তমান প্রযুক্তি। প্রযুক্তির কল্যাণেই মানুষের সঙ্গে মানুষের সবরকম নিত্যনতুন যোগাযোগব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে, চর্চা হচ্ছে শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের।
চিকিৎসা, উৎপাদন, বিপণনসহ এমনকিছু নেই, যার মধ্যে প্রযুক্তির ব্যবহার যুক্ত হচ্ছে না। বর্তমান সময়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির এই যুগে সব কিছুই প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। প্রযুক্তি ছাড়া এখন মানুষ একেবারেই অচল। যুগ যুগ ধরে বিবর্তনের ফলে একবিংশ শতাব্দীতে এসে প্রকৃতিতে যে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে, তার অন্যতম কারণ হলো কম্পিউটার, মোবাইল, ফ্যাক্স, ইমেইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটারসহ নানাবিধ ডিজিটাল ডিভাইসের আবিষ্কার। বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল যুগ। প্রযুক্তির কল্যাণ কাজে লাগিয়ে সমগ্র বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয় এসেছে। পরিণত হয়েছে ছোট একটি গ্রাম বা ভিলেজে।
আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে দেশ, দেশ থেকে বিদেশে। ইন্টারনেটের কল্যাণে আজ ভৌগোলিক সীমারেখা যেনো মুহূর্তের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। প্রযুক্তির বদৌলতে সহজে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন সহজ হয়েছে।
তা ছাড়া চিকিৎসা ক্ষেত্রেও ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে এসেছে এক অভাবনীয় সাফল্য। ডিজিটাল প্রযুক্তির অভাবনীয় এই সাফল্যের পরেও কোথাও যেনো তার ব্যর্থতা রয়েই গেছে। অসাধ্য সাধনকারী এ আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ঘটছে এখন অপপ্রয়োগ। প্রযুক্তির আবিষ্কার মানুষের দৈনন্দিন জীবনে গতি এনেছে। তেমনি অপরদিকে সৃষ্টি করেছে হাজারো বিড়ম্বনাও। প্রতিটি জিনিসের যেমন ভালো দিক থাকে তেমনি তার একটি খারাপ দিকও থাকে।
বিজ্ঞানি আলফ্রেড বার্নাড নোবেল যখন ডিনামাইট আবিষ্কার করেছিলেন তখন তিনি এর খারাপ দিকটি ব্যবহারের কথা চিন্তাও করেননি। তিনি ভেবেছিলেন মানবজাতির উপকারের কথা। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে আজ এই ডিনামাইট ব্যবহার হচ্ছে প্রতিশোধপরায়ণ কাজে ও ধ্বংসাত্মক তাণ্ডবলীলায়। একইভাবে বিশ্বকে আধুনিক বিশ্বে রূপায়িত করতে যেসব ডিজিটাল ডিভাইস আবিষ্কার করা হয়েছে তারও এখন ঘটছে অপপ্রয়োগ। চলতি শতাব্দীকে বলা হয় বিজ্ঞানের শতাব্দী।
গত শতাব্দী থেকে বর্তমান বিজ্ঞান তার ৯৯ শতাংশ আবিষ্কার করেছে। পূর্বে যা আবিষ্কৃত হয়েছে, সেসব খুবই সাধারণ জিনিসপত্র ছিলো। কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞানের উদ্ভাবনগুলো এতোটাই উন্নত যে অতীতে এইসব মানুষের কল্পনা এবং ক্ষেত্রবিশেষে কল্পনার বাইরে ছিল। আজকের প্রযুক্তির এ যুগে যে জাতি প্রযুক্তিতে যতো বেশি দক্ষ সে জাতি ততো উন্নত। বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন আগামীতে যুদ্ধ হলে তা হবে ‘প্রযুক্তি যুদ্ধ’। বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির এই যুদ্ধে মানুষের অংশগ্রহণের তেমন প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। যুদ্ধ করবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট কিংবা যুদ্ধাস্ত্র।
উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে মানুষের সদিচ্ছা প্রবল হলেও দিন দিন প্রযুক্তির ‘ইভিল জিনিয়াস’ বা ক্ষতিকর বুদ্ধিও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তির এ দুর্দান্ত প্রতাপ কিন্তু সবসময়ই মানুষের জন্য মঙ্গল বয়ে আনেনি। প্রযুক্তির কোনোটি যেমন আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়েছে আবার কোনোটি আমাদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রযুক্তির ইতিবাচক প্রভাবে সভ্যতার যেমন উন্নতি হয়েছে, আবার কোনো কোনো প্রযুক্তি বস্তুর অপব্যবহার হুমকিস্বরূপ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
প্রযুক্তিনির্ভর যুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা যায় বিগত সাড়ে পাঁচ হাজার বছরে পৃথিবীর বুকে মোট যুদ্ধ হয়েছে ১৪ হাজার ৫০০টি, প্রাণ হারিয়েছে ৪০০ কোটি মানুষ। বর্তমান শতাব্দীর যুদ্ধের অন্যতম হাতিয়ার হলো চালকবিহীন বিমান বা ড্রোন। গত শতাব্দী থেকেই সামরিক পরাশক্তিরা যুদ্ধে মনুষ্যবিহীন যুদ্ধ এবং সেনাদের আরো নিরাপদে রাখার তাগিদে নানা ধরনের নতুন প্রযুক্তির দ্বারস্থ হতে শুরু করে।
প্রযুক্তির অগ্রসরতা মানুষ কখনোই অস্বীকার করে না এবং করার উপায়ও নেই। তবে এর আবিষ্কার ও অগ্রসরতার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিকর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের আবশ্যকতা রয়েছে। এটা না হলে প্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে মানবসভ্যতায় বিপর্যয় নেমে আসবে। ইতোমধ্যে এই ধারণা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এ ক্ষতিকর দিক বিবেচনায় বিশ্বে প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে বিভিন্ন আইন রয়েছে। এ আইনের সহায়তায়ও প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন আইন করা যেতে পারে। আইনের যথাযথ ব্যবহার যেমন প্রত্যাশিত, তেমনি আইনের অপপ্রয়োগও নিন্দনীয়। তবে দেশ, সম্পদ ও জাতির জন্য ক্ষতিকর তথা ধ্বংসাত্মক তৎপরতাকে উৎসাহিত করে এমন যেকোনো উদ্যোগ ও প্রয়োগকে অবশ্যই নিরুৎসাহিত করা অত্যাবশ্যক। প্রতিনিয়ত প্রযুক্তির অসীম জগত সম্পর্কে জ্ঞান রাখা এবং এর পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার মতো দক্ষ লোকবল তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে।
মানবতাকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য অস্ত্র ব্যবস্থায় নয়, বরং মানুষের কল্যাণে কৃষি-চিকিৎসা, মহাকাশ অন্বেষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ মানবজাতির সুবিধার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপকারী প্রয়োগের ওপর গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। আজকের বিশ্ব বিজ্ঞানের বিশ্ব। বিজ্ঞানের কল্যাণে সুদূর অতীত থেকে নানা কিছু আবিষ্কার হচ্ছে। বিদ্যুৎ, কম্পিউটার, মোবাইল প্রভৃতি বিজ্ঞানের যুগান্তকারী আবিষ্কার। এসব আবিষ্কার প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। এখন কোয়ান্টাম কম্পিউটার আবিষ্কারের পথে বিজ্ঞানীরা। প্রযুক্তির মাধ্যমে পৃথিবীকে এগিয়ে নিতে হবে। মানুষের কল্যাণে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হবে।
লেখক: নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান, জবি
(মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন)