
আওয়ামী লীগ আমলের ষড়যন্ত্রের ‘যেই লাউ সেই কদু’ নিয়ে চলছে বিপর্যস্ত প্রাথমিক শিক্ষা। বৈষম্য নিরসনের প্রত্যয়ে যাত্রা শরু করার কথা ছিলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। অথচ সে কার্যক্রম মোটেই দৃশ্যমান নয়।
একই সঙ্গে দৃশ্যমান হচ্ছে আওয়ামী আমলের প্রাথমিক শিক্ষা সংকুচিত তথা ধ্বংসের কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়নের জোর প্রচেষ্টা। আওয়ামী আমলের সে প্রস্তাবগুলো বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার তার সরকারের কার্যক্রম বলে বেড়াচ্ছেন। বিষয়টি দুঃখজনক।
সহকারী শিক্ষদের প্রস্তাবিত ১২তম গ্রেড, সহকারী প্রধান শিক্ষক পদ সৃষ্টি, ৮ম শ্রেণিতে উন্নীত প্রাথামিক বিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দেয়ার চক্রান্ত, সর্বপোরি বিদ্যালয়ের কর্মঘণ্টা বৃদ্ধির নামে শনিবার খোলা রাখা তথা ছুটি কমানোর প্রচেষ্টাসহ বিগত সরকারে এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে প্রাথমিক শিক্ষাকে বিপর্যস্ত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের কার্যক্রম নিয়ে বিছু বিষয় আলোকপাত করছি।
শিক্ষার্থী সংকটে বিপর্যস্ত করা হয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কয়েক ধরনের শিশু শিক্ষা আমাদের দেশে রয়েছে। তার মধ্যে কিন্ডারগার্টেন, বেসরকারি-সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখা, ইবতেদায়ি মাদরাসা এবং এনজিও পরিচালিত শিশু শিক্ষা রয়েছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যতিরেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সময়সূচি শিশুবান্ধব। তাদের শিক্ষার কার্যক্রম শেষ হয় দুপুর ১২টা থেকে দুপুর ২টার মধ্যে। অপরদিকে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচি সকাল ৯টা থেকে শুরু হয়ে চলে বিকাল ৪টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কার্যক্রম ৯টা থেকে দুপুর ১টা ১৫ মিনিটে পর্যন্ত। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির কার্যক্রম ৯টা থেকে ৩টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত। বাকি ৪৫ মিনিট দুর্বল শিক্ষার্থীর পাঠদান।
প্রাথমিক বিদ্যালয় এ দীর্ঘসময় শিক্ষার্থীর বিদ্যালয়ে অবস্থান শিশুবান্ধব নয়, যার ফলে আওয়ামী লীগ শাসন আমলে অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরিয়ে নিয়েছে। পাশাপাশি যত্র-তত্র কিন্ডারগার্টেন, ইবতেদায়ি মাদরাসা, বেসরকারি হাইস্কুলে প্রাথমিক শাখা খোলা, সরকারি হাইস্কুলের প্রাথমিক শাখাসহ বেসরকারি শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার মাধ্যমে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে।
অপরদিকে, ভৌত অবকাঠামো সমৃদ্ধ হলেও শিক্ষক সংকটের বেহাল অবস্থা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, যেখানে শিশুশিক্ষা হাইস্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদান কাজের চেয়েও কঠিন, সেখানে তৃণমূলের মানুষের সন্তানদের একনাগাড়ে দীর্ঘসময় নিতে আটকে রেখে পাঠদানের নামে মহাবিপ্লব কাম্য নয়।
এ অচল অবস্থা দূর করার কোনো চিন্তা-ভাবনা না করে, শনিবারেও শিক্ষার কার্যক্রম চালানোর পাঁয়তারা চালানো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যারয়ের অস্তিত্ব বিলীন করার এক মহাষড়যন্ত্র বলেই মনে হচ্ছে।
বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংকট দূর করার জন্য সব শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এক ও অভিন্ন শিশুবান্ধব সময়সূচি প্রয়োজন। যেহেতু বর্তমান প্রাথমিক শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত, শিশুশিক্ষায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবলের সমাহার।
সেহেতু সরকারি-বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখা বন্ধ করা জরুরি। সেসব প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষিত শিক্ষকমণ্ডলী থাকলেও শিশুশিক্ষায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবল মোটেই নেই। শিশুর শারীরিক-মানসিক বিকাশ সাধনে শিশুশিক্ষায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক অপরিহার্য। অন্যদিকে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিকটস্থ সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা প্রয়োজন। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সংকটসহ এর সঙ্গে জড়িত সবার জবাবদিহিতাই পারে অস্তিত্ব সংকট দূর করতে।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ অনুযায়ী কার্যক্রমের সব প্রাথমিক বিদ্যালয় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করা প্রয়োজন। এতে সাধারণ মানুষের সন্তানদের অবতৈনিক শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারিত হবে। অথচ বিগত আওয়ামী সরকার ৭২৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উন্নীত করে সব ধরনের সরকারি সহযোগিতার কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছিলো। তারা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবতৈনিক শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরনের সুযোগ খুঁজছিলেন। অথচ প্রাথমিক শিক্ষা সংস্কারের নামে এনজিও তথা কনসালটেশন কমিটি ৭২৯টি বিদ্যালয় বন্ধ করা সুপারিশ করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সে সুপারিশ বাস্তবায়নের দিকে চলেছেন। এই হলো সম্প্রসারণ অবতৈনিক শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীরণের সরাসরি ষড়যন্ত্র।
বিগত আওয়ামী লীগের সরকারের আমল থেকেই শিক্ষকরা তাদের থার্ড ক্লাস মর্যাদা থেকে বের হয়ে, অন্যান্য সমযোগ্যতা সম্পন্ন সরকারি কর্মচারীদের মতো ১০ম গ্রেড প্রাপ্তির লক্ষ্যে আন্দোলন করে আসছিলেন। প্রধান শিক্ষকদের আদালতের রায়ের আলোকে ১০ম গ্রেড দেয়া ও সহকারী শিক্ষকদের বঞ্চিত করার লক্ষ্যে খুবই নগণ্য সংখ্যক বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে সৃষ্টি করে। উক্ত পদ ১১তম গ্রেড প্রদানের সুপারিশ করা হয়। সহকারী শিক্ষকদের প্রস্তাব করা ১২তম গ্রেড।
এ কার্যক্রমগুলো সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন ও সচিব ফরিদ আহমেদ কর্তৃক যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনপ্রাপ্ত। বিগত সরকারের অনুমোদনপ্রাপ্ত সিদ্ধান্তগুলো কনসালটেশন কমিটি তাদের হুবহু পরামর্শ দিয়েছেন। বিপর্যস্ত প্রাথমিক শিক্ষা মানসম্মত করার লক্ষ্যে বিগত সরকারের প্রেসক্রিপশন পরিহার করে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: শিক্ষাবিদ