
সৃষ্টি কুলের সর্দার নবী রাহমাতুল্লিল আল-আমীনের দরবারে। যাঁর পবিত্র শুভাগমন ঘটে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার মা আমেনা ও হযরত আব্দুল্লাহর কোলে। যিনি সমস্ত সৃষ্টির জন্য রহমত হিসেবে এ ধরাবুকে আগমন করেছেন বলে এই মাস ও দিন অত্যন্ত গুরুত্ববহ, ফজিলতময়। এই কারণেই প্রিয় নবীর পবিত্র আগমন শরীফে আনন্দ ও খুশি সমগ্র সৃষ্টিকূল। বিশেষ করে বিশ্ব মুমিন মুসলিম।
এ মাস ও দিনে জশনে জুলুসসহ শোভাযাত্রা, মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার শান-মান সর্ম্পর্কীয় আলোচনা সভা, সেমিনার, দান-সাদকাহ, খয়রাত এবং জাক-জমকপূর্ণ আয়োজন করে দরূদ শরীফ পাঠ, দোয়া-মুনাজাত, হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার শুভাগমনের সময়কার অলৌকিক ঘটনাবলি ও কল্যাণদির ছড়াছড়ির বিবরণ দেয়া, প্রিয় নবীর হকিকত ও মর্যাদা, আদর্শ এবং বরকতময় জীবনী আলোচনা ইত্যাদির মাধ্যমে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন করা হয়। বস্তুত এই ধরনের আয়োজনের পক্ষে পবিত্র কুরআন, হাদিস, সাহাবায়ে কেরাম (রা.), পূর্ববর্তী ইমামগণ এবং বিজ্ঞ আলেম সামজের রয়েছে পূর্ণ সমর্থন। নির্ভরযোগ্য দলিলাদির ভিত্তিতে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপনের তাৎপর্য আলোকপাত করার প্রয়াস পাচ্ছি।
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ নির্দেশনা ও নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন ইরশাদ করেছেন, হে নবী আপনি বলে দিন, আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতের উপর খুশি পালন কর; যা তোমাদের সমস্ত ধন-দৌলত অপেক্ষা শ্রেয়। এই আয়াতে আল্লাহ মুসলমানগণকে তাঁর ফজল ও রহমত প্রাপ্তির ওপর খুশি পালন করার হুকুম বা নির্দেশ দিয়েছেন। (সূরা-ইউনুস, আয়াত নং-৫৮)
অন্য আয়াতে এরশাদ করেছেন, এবং যদি তোমাদের উপর আল্লাহর রহমত ও দয়া না হতো তাহলে তোমাদের মুষ্টিমেয় ছাড়া অন্যরা সবাই শয়তানের অনুসরণ করতে। (সূরা নিসা, আয়াত- ৮৩) তাফসীরের ইমাম তথা মুফাসসিরিনে কেরাম এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, এ আয়াতে আল্লাহর রহমত এবং দয়া এক সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। এখানে রহমত দ্বারা মূলত হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বোঝানো হয়েছে। আর মুসলমানদেরকে আল্লাহ পাক সম্বোধন করে এরশাদ করেছেন, ‘যদি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন না হতো, তাহলে তোমাদের অধিকাংশই গোমরাহ হয়ে যেতে। ফলে তারা শয়তানের অনুগত হয়ে ধ্বংস হয়ে যেত।
নবীজি রহমত হওয়া সম্পর্কে কোরআনে পাকের ঘোষণা, হে নবী আমি আপনাকে সমগ্র জাহানের জন্য একমাত্র রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি। (সূরা- আম্বিয়া, আয়াত নং- ১০৭)
আর আল্লাহ পাক তার রহমত ও দয়া প্রাপ্তিতে শুকরিয়া করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন, তোমরা আমাকে স্মরণ করো আমি তোমাদের স্মরণ কররো আর আমার (নেয়ামতের) শুকরিয়া আদায় কবো এবং আমার নেয়ামতের অস্বীকার কর না। (সূরা-বাকারা, আয়াত নং- ১৫২)
তাই আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতের জন্য যারা আনন্দ প্রকাশ করেন আল্লাহ ঈমানদারদের শ্রমফল বিনষ্ট করেন না। তা ছাড়া সামান্য নেয়ামত লাভ করলেও তার জন্য ঈদ বা আনন্দোৎসব করার দৃষ্টান্ত আমরা কোরআনে দেখতে পাই। যেমন এরশাদ হচ্ছে, ‘ঈসা ইবনে মরিয়াম আলাইহিস সালাম বললেন, হে আল্লাহ, হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের জন্য আকাশ থেকে খাদ্য ভর্তি খাঞ্ছা নাযিল করুন, যা আমাদের পূর্ববর্তী ও আমাদের পরবর্তী সকলের জন্য ঈদ তথা আনন্দ (উৎসবের কারণ) হবে। আর আপনার পক্ষ থেকে অন্যতম নিদর্শন এবং আপনিতো সর্বোত্তম জীবিকা দাতা। (সূরা- মায়েদা-১১৪)
এই আয়াতে পাক হতে প্রতীয়মান হয় যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের যুগে আল্লাহর পক্ষ থেকে খাঞ্ছা ভরা আসমান থেকে খাদ্য আসলে, তা যদি হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের ভাষায় সৃষ্টির আদি হতে অন্ত পর্যন্ত সকলের জন্য ঈদ তথা আনন্দ উৎসবের উসিলা ও আল্লাহর নিদর্শন হয়। তাহলে আকা মাওলা রাহমাতুল্লীল আল-আমীনের মতো মহান নেয়ামতের শুভাগমনের দিন-মাস কতোই না মর্যাদাপূর্ণ, গুরুত্ববহ ও আনন্দ উৎসবের দিন।
ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করা সুন্নাত ইলাহী। আল্লাহ তাআলা যেদিন হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেছিলেন, সেদিন নবীকে পেয়ে সৃষ্টি জগতের সকলেই খুশি-আনন্দিত হয়েছিলেন। তবে ইবলিসের দল ব্যতীত। বর্তমানেও বহু হিংসুক মুসলমান নামধারী ইবলিসের অনুসারী আমার দেখতে পায়। যারা মিলাদুন্নবীর বিরোধিতা করেন। আল্লাহ তাদেরকে বোঝার তাওফীক দান করুক।
হুজুর করীম (দ.) এর শুভাগমন উপলক্ষে শরীয়ত সম্মত উপায়ে আনন্দ ও খুশি উদ্যাপনের বৈধতার পক্ষে হাদিসে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বহু প্রমাণ বিদ্যমান। যেমন হাদিস শাস্ত্রের প্রখ্যাত ইমাম আবু ঈসা মুহাম্মদ তিরমিযী (র.) তাঁর সংকলিত ‘সুনানে তিরমিযী শরীফে ‘মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শিরোনামে একটি অধ্যায় প্রণয়ন করেছেন এবং বর্ণনা করেছেন, তিনি (ক্বায়স ইবনে মাখযমা) বলেন, ‘আমি এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আমুল ফীল’ অর্থাৎ বাদশাহ আব্রাহার হস্তী বাহিনীর ওপর গজব নাযিল হওয়ার বছর জন্ম গ্রহণ করেছি।’ আর হযরত ওসমান ইবনে আফ্ফান (রা.) বনী ইয়া’মর ইবনে লাইস-এর ভাই কুবাস ইবনে আশ্ইয়ামকে বললেন, ‘আপনি বড়, না রসুলুল্লাহ তাআলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম? তখন তিনি বললেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমার চেয়ে অনেক বড়; (অর্থাৎ মর্যাদায়) আর আমি জন্ম সূত্রে হুযুরের আগে মাত্র। (তিরমিযী শরীফ: ২য় খন্ড, পৃষ্ট- ২২৪-২২৫)
উক্ত কিতাবে তিনি আরো উল্লেখ করেছেন, হযরত ওরওয়া ইবনে যোবায়ের (রা.) বলেন, সুয়াইবাহ আবু লাহাবের দাসী ছিলেন। আবু লাহাব হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার বেলাদত তথা দুনিয়াতে শুভাগমন হয়েছে এই সুসংবাদ দেয়ার কারণে (আনন্দিত হয়ে)-দাসী সুয়াইবাহকে মুক্ত করে দিয়েছিণের। অতঃপর সেই সুয়াইবাহ হুযুরকে (দ.) দুধ পানও করিয়েছিলেন। আবু লাহাবের মৃত্যুর এক বছর পর তার ঘনিষ্ঠদের কেউ (হযরত আব্বাস) তাকে স্বপ্নে শোচনীয় অবস্থায় দেখে তার উদ্দেশে বললেন, ‘তোমার অবস্থা কেমন?’ তখন আবু লাহাব তদুত্তরে বললেন, ‘তোমাদের নিকট থেকে আসার পর থেকে আমি কোনো প্রকার শান্তি পাইনি, কেবল আমি যে, আল্লাহর হাবীবের জন্ম-সংবাদ বা মিলাদ শরীফের খুশিতে আমার নিজের বাদী সুয়াইবাহকে (আমার তর্জনী ও মধ্যমা এ দু’টি আঙ্গুলের ইশারায়) আযাদ করেছিলাম, ওই কারণে (প্রতি সোমবার আঙ্গুল দু’টির মধ্যে কিছু পানি জমে থাকে) যখন পিপাসাত্ব হই তখন আমি ওই পানি চুষে থাকি ও এ কারণে প্রতি সোমবার আমার উপর আযাবকে হাল্কা বোধ করে থাকি। (সহীহ বোখারী শরীফ: ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৭৬৪)
এই হাদিসের পাদটীকায় বর্ণিত আছে-সুয়াইবাহ আবু লাহাবকে হুযুর (দ.) এর জন্মের সুসংবাদ দেয়ার কারণে আবু লাহাব তাকে আযাদ করে দিয়েছিল। অতঃপর এ আযাদ করাটা (পরকালে) আবু লাহাবের উপকারে এসেছে। এ কাজ তার উপকারে আসার অর্থ হলো-তার এ কর্ম অবশিষ্ট ছিলো, অন্যান্য কাজের ন্যায় বিনষ্ট হয়ে যায়নি। তাও হুযুর (দ,) এরই বরকতে।
সুতরাং কেউ যদি এর অপব্যখ্যা দিয়ে বলেন যে ‘আবূ লাহাবের পরকালীন শান্তি পাওয়া সুয়াইবাহকে আযাদ করার কারণে ছিলো, নবী করীম (দ.) এর জন্মে খুশি হওয়ার কারণে নয়। এর উত্তর হচ্ছে, কাফির ও মুশরিক কোনো ভালো কাজ করলে তা পরকালে তাদের কোনো উপকারে আসে না। এর বিনিময় তারা দুনিয়াতেও পেয়ে যায়।
সহীহ্ বুখারী শরীফে উল্লেখ রয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হুযুর রসুল (দ.) মদিনায় তাশরীফ আনলেন। অতঃপর ইহুদিদেরকে আশুরার দিন রোজা রাখতে দেখলেন। তখন তিনি বললেন, এটা কী? অর্থাৎ এ রোজা কী কারণে? তখন তারা বললেন, ‘এটা এমন একটি দিন, যেদিন আল্লাহর ঈসা (আ.) কে নাজাত দান করেছেন এবং এদিনে ফিরাউনকে নীল নদে ডুবিয়ে মেরেছেন। সুতরাং হযরত মূসা (আ.) শোকরিয়া স্বরূপ এদিন রোজা পালন করেছেন। তখন হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, ‘আমরা মূসা (আ.) এর বিষয়ে তোমাদের তুলনায় বেশি হকদার। অতঃপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওইদিন রোজা রাখলেন এবং ওইদিনে সাহাবায়ে কেরামকে রোজা রাখার নির্দেশ দান করলেন।
আলোচ্য হাদিসে উল্লেখ রয়েছে যে, আলোচ্য হাদিস শরীফ দ্বারা নির্দিষ্ট দিনে, সুনির্দিষ্ট কারণে নির্দিষ্ট ইবাদত পালনের পক্ষের আলিমরা দলিল পেশ করেছেন। যেমন ওফাত দিবসে মৃতদের জন্য সদাকাহ, খয়রাত করা। অন্য দিকে, হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আশুরার দিনকে রোজার জন্য নির্দিষ্ট করেছেন। আর সোমবারকেও একইভাবে। কারণ, ওইদিন তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঠিক শুভাগমন করেছেন এবং ওইদিনে তাঁর প্রতি ওহি অবতীর্ণ হয়েছে। এই ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (দ.) নিজেই এরশাদ করেছেন, হযরত আবু ক্বাতাদাহ্ (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রসূল করীম (দ.) এর মহান দরবারে সোমবার রোজা পালন সম্পর্কে আরজ করা হলো। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে ইরশাদ করলেন, ওইদিন আমি শুভাগমন করেছি এবং ওইদিন আমার ওপর পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে।
আলোচ্য হাদিস দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার পবিত্র মিলাদের দিবস অর্থাৎ প্রতি সোমবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। এতে আরো প্রমাণিত হয়, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং প্রতি সোমবার মিলাদে পাকের শোকরিয়া স্বরূপ পালন করতেন। আর মুমিন মুসলমানগণ তো বছরে একবার ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ উদযাপন করছে পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসে। আর আলোচ্য হাদিস তো প্রতি সোমবার মিলাদুন্নবী উপলক্ষে রোজা পালন করা, দান-সদকাহ সুন্নাত প্রমাণ করছে।
খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে পবিত্র ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ কি ছিলো? এ প্রসঙ্গে আল্লামা শাহাবুদ্দীন ইবনে হাজর হায়তামী (রহ.) তার কিতাবে উল্লেখ করেছেন, খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগেও ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ পালন করার রীতি প্রচলন ছিলো। যেমন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) আনহু বলেছেন, যে ব্যক্তি ‘মিলাদুন্নবী’ পাঠ করার জন্য এক দিরহাম অর্থ খরচ করবে, সে ব্যক্তি বেহেশেতে আমার সঙ্গী হবে’। হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ‘মিলাদুন্নবী’র ইবাদত করে এবং সম্মান করে, আল্লাহ তাকে শান্তি দান করেন, তিনি ইসলামকে বাঁচিয়ে রাখেন।’ হজরত উসমান বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিলাদুন্নবী পাঠে এক দিরহাম ব্যয় করে, আল্লাহ তাকে শান্তি দান করেন। যেন তিনি বদর ও হোনাইনের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।’ হযরত আলী বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিলাদুন্নবীকে সম্মান করবে এবং মিলাদুন্নবী পালন করার উদ্যোক্তা হবে, সে দুনিয়া থেকে (তওবার মাধ্যমে) ঈমানের সঙ্গে বিদায় হবে এবং বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।
ইমাম ও ফকীহগণের মতে, ঈদে মিলাদুন্নবী উদ্যাপন: বিশিষ্ট ইমামুশ শরিয়ত ওয়াত তরীক্বত, যিনি শতাধিক সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম উনাদের সাক্ষাত মুবারক লাভ করেছিলেন, সেই বিখ্যাত ইমাম হযরত হাসান বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘আমার একান্ত ইচ্ছা হয় যে, আমার যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ থাকতো তাহলে তা পবিত্র মিলাদুন্নবী উপলক্ষে ব্যয় করতাম।’ ইমাম হযরত ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘যে ব্যক্তি পবিত্র মিলাদুন্নবী উদযাপন উপলক্ষে লোকজন একত্রিত করলো, খাদ্য তৈরি করলো, জায়গা নির্দিষ্ট করলো এবং এ জন্য উত্তমভাবে তথা সুন্নাহ ভিত্তিক আমল করলো তাহলে উক্ত ব্যক্তিকে আল্লাহ পাক হাশরের দিন ছিদ্দীক্ব, শহীদ সালিহীনগণের সাথে উঠাবেন এবং উনার ঠিকানা হবে জান্নাতে নায়ীমে।’
সাইয়্যিদুৎ ত্বায়িফাহ হযরত জুনাইদ বাগদাদী ক্বাদ্দাসাল্লাহু সিররাহু রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘যে ব্যক্তি পবিত্র মিলাদু্ন্নবী আয়োজনে উপস্থিত হবে এবং উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করবে সে বেহেশতি হবে।’
এ ব্যাপারে যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী বলেন, আমি ইতোপূর্বে মক্কা শরীফের রাসুলে পাকের বেলাদতের তারিখে মিলাদুন্নবীর মাহফিলে উপস্থিত ছিলাম, মক্কাবাসীরা নবীর ওপর দরূদ শরীফ পাঠ করেছে, তাঁর শুভাগমনের পবিত্র মুহূর্তে সংগঠিত আলৌকিক ঘটনাবলি বয়ান করতেন। ওই মাহফিলে আমি নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার নূরকে দেখতে পেয়েছি।
বিশ্ববিখ্যাত ইমাম আল্লামা জালাল উদ্দিন সূয়ুতী (র.) এর কাছে জানতে চাওয়া হয়, মিলাদ মুস্তাফা এর শরীয়তের বিধান কি? তিনি উত্তরে বলেন, আমার নিকট এর জবাব হচ্ছে, ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলো প্রিয়নবী (দ.) এর ভূ-পৃষ্ঠে শুভাগমনের প্রাথমিক অবস্থাদির বর্ণনা সম্বলিত হাদীস সমূহ ও হুযুরের পবিত্র বেলাদত শরীফের সময় যেসব অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিলো সেগুলো আলোচনা করা, মাহফিলে আগত মেহেমানদের মধ্যে লম্বা দস্তরখানা বিছিয়ে খাদ্য পরিবেশন করা এবং তাতে অপচয় পরিহার করা। এমনই ভাল কাজের যে আয়োজন করে সে সাওয়াব পাবে। কারণ, তাতে নবী করীমের দুনিয়াতে পবিত্র শুভাগমনকে উদ্দেশে করে খুশি প্রকাশ করা হয়।
পক্ষান্তরে রবিউল আউয়াল মাসে সিরাতুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন করা, ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অস্বীকার করার নামান্তর। সিরাত শব্দটি কেনো, কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে সে জ্ঞানও বিরোধিতা কারীরা রাখেন না। তারা শুধুমাত্র ঈদে মিলাদুন্নবীর প্রতি বিদ্ধেষ পোষণ করে বিরোধিতা করতে সিরাতুন্নবী পালন করেন। কিন্তু সিরাতুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পালনের নামে তারা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়ায়। যা গর্হিত ও ঈমান বিধ্বংসী। প্রকৃত অর্থে যারা পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবীতে খুশি হতে পারেন না, বিরোধীতা করেন তারা মূলত শয়তানের অনুসারী, উত্তরসূরী। কারণ, ইবলিশ শয়তান তার জীবনে চার বার খুব বেশি কেঁদেছে বা আফসোস করেছে। তাহলো- ১. আল্লাহ যখন তাকে অভিশপ্ত হিসেবে ঘোষণা দিলেন ২. যখন তাকে বেহেশত থেকে বিতাড়িত করা হলো ৩. নূর নবীজীর দুনিয়াতে আগমনের সময় এবং ৪. সূরা ফাতিহা নাজিল হবার সময়।
আসুন মিথ্যা ভ্রান্ত সমালোচনা বর্জন করে, অপরের শোনা কথায় পরোচিত না হয়ে, শুধু শুধু বিরোধিতা না করে প্রত্যেকে নবীপ্রেমে বিভোর হয়ে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুভাগমনের দিন জশনে জুলুসসহ শোভাযাত্রা, মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্ম্পর্কীয় আলোচনা সভা ও সেমিনার, দান-সাদকাহ, খয়রাত এবং জাক-জমকপূর্ণ আয়োজন করে দরূদ শরীফ পাঠ, মাহফিল ও দোয়া মুনাজাত, হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুভাগমনের সময়কার অলৌকিক ঘটনাবলি ও কল্যাণদির ছড়াছড়ির বিবরণ দেয়া এবং প্রিয় নবীর আদর্শ জীবনী আলোচনা ইত্যাদির মাধ্যমে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদ্যাপন করে তার প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা প্রকাশে প্রয়াসী হই। কেনোনা তা সুন্দরতম আমল, অতীব বরকতময় সমৃদ্ধ এবং পূর্ণময় সাওয়াবের কাজ। এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করার কোনো অবকাশ নেই। আল্লাহ আমাদেরকে বোঝার ও আমল করার তাওফিক দান করুন।
লেখক: মুদাররিস, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মহিলা ফাযিল মাদরাসা, ষোলশহর, চট্টগ্রাম