
দেশের শিক্ষাবিষয়ক একমাত্র প্রিন্ট জাতীয় পত্রিকা ‘দৈনিক আমাদের বার্তা’ এবং ডিজিটাল অনলাইন পত্রিকা ‘দৈনিক শিক্ষাডটকম’ এর লিড নিউজ হিসেবে সম্প্রতি একটি স্পর্শকাতর সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। শিক্ষার পত্রিকা হিসেবে দেশের সমস্ত শিক্ষকদের এটি স্পর্শ করার কথা।
গত ২৭ এপ্রিল পটুয়াখালীর দশমিনা সরকারি আবদুর রসিদ তালুকদার ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর নূরুল আমিন তালুকদারের সঙ্গে এ এস নুরুল আখতার নিলয় নামে এক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন। জনগুরুত্বপূর্ণ কাজে অধ্যক্ষ তার কক্ষে অবস্থান করছিলেন। সে সময় হঠাৎ তার রুমে দুই তিনজন লোক ঢুকে অধ্যক্ষকে প্রশ্ন করেন, আপনি কে? আপনি এই জায়গায় কেনো? আপনি কেনো এই জায়গায় আছেন?
প্রশাসন ক্যাডারের ফিল্ড পর্যায়ের কর্মকর্তার এ কী আচরণ? তাদের কি কোনো আচরণ শেখানো হয় না? কলেজের একজন অধ্যক্ষ তার রুমে থাকবেন না তো কোথায় থাকবেন?
ম্যাজিস্ট্রেট আরো বলেন, আজকে এই জায়গায় পরীক্ষা চলছে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করছেন আপনি কি জানেন? আপনি কি জানেন আপনাকে আমি ৩০ দিনের জেল দিতে পারি?’
প্রশাসন ক্যাডারের এই হলো ঔদ্ধত্য, এই হচ্ছে তাদের বড়াই! মনে হচ্ছে তারা ছাড়া এদেশের আর কেউ কিছু নয়।। তারা এক আলাদা এনটিটি! তিনি অধ্যক্ষের পরিচয় জেনেও তাকে জিজ্ঞেস করছেন, তিনি কার অনুমতি নিয়ে কলেজে প্রবেশ করেছেন। এর চেয়ে অবাক করা প্রশ্ন, আর ঔদ্ধত্য শিক্ষাক্ষেত্রে আর কি হতে পারে? দেশে হচ্ছেটা কী? একজন অধ্যক্ষ তার কলেজে প্রবেশ করবেন কার অনুমতি নিয়ে?
আমরা সিএসপি পরীক্ষার কথা জানি। সিএসপি পরীক্ষার মাধ্যমে যেসব ঝানু ও মেধাবী কর্মকর্তা নিয়োগ পেতেন তাদের জ্ঞানের বহর, দূরদর্শিতা, আচার-আচরণ সবকিছুই ছিলো পুরো আলাদা। কারণ, দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আচার-আচরণ, পারিবারিক ট্র্যাডিশন ইত্যাদি বিষয়গুলোও দেখা হতো। মানুষ তাদের শ্রদ্ধা করতেন। আর বিসিএস পরীক্ষার আদ্যেপান্ত দেশের মানুষ জানে। বিশেষ করে বিগত পনের-ষোল বছরে কীভাবে এসব পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রশ্নপত্রের ইতিহাস, মৌখিক পরীক্ষা তথাকথিত কোটা ইত্যাদির কথা কারোরই অজানা নয়। ওই ম্যাজিস্ট্রেট কি জানেন না, বাংলাদেশে যাই হোক, যতো নৈতিক অধঃপতনই হোক না কেনো এখনো একজন শিক্ষকের (বিশেষ করে যারা প্রকৃত শিক্ষক) প্রতি এ ধরনের আচরণ শিক্ষার্থী সমাজ মেনে নেন না। উনি যে, ৩০ দিন জেল দেয়ার ভয় দেখালেন উনি কি জানেন না, একজন শিক্ষককে এভাবে হেনস্তা করলে হাজার হাজার শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে আসবেন। তার পরবর্তী পরিস্থিতি যা ঘটে এসব ক্ষেত্রে তার দায়-দায়িত্ব এ ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণকারী কর্মকর্তাদের ওপর বর্তাবে। সেটি কি উনি জানেন না? উনি কাকে কিসের ভয় দেখাচ্ছেন। গ্রেফতার, জেল ও জরিমানার ভয় দেখাচ্ছেন! তিনি এখানে বসে নকল সরবরাহ করছেন, তার পিসি চেক করলেন অথচ কিছুই পেলেন না।
মানুষের মনে এ প্রশ্নও তো আসে? আপনি ওখানে কী করেন? শিক্ষক কিংবা অধ্যক্ষ যারা শিক্ষার্থীদের পড়ান, পরীক্ষা পরিচালনা করেন, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করেন, তাদের ভালবাসেন, রাগ করেন, সোহাগ করেন, শাসনও করেন। আপনি হঠাৎ একদিন এমন কী দায়িত্ব পেয়ে গেলেন, অধ্যক্ষ তার রুমে প্রবেশ করতে পারবেন না, কে তাকে ঢোকার অনুমতি দিলো ইত্যাদি প্রশ্ন তুলছেন। আপনি ওখানে কে? আপনি কিসের জন্য এবং কিসের দায়িত্ব পালন করতে এসেছেন? এটা কি দায়িত্ব পালন করা, না শিক্ষা ও শিক্ষককে অপমান করা? দায়িত্ব তো ওভাবে পালন করে না। পাবলিক পরীক্ষা সঠিকভাবে হতে হলে প্রশাসন, শিক্ষক ও অভিভাবক মিলে সেটি নিশ্চিত করতে হয়, শিক্ষককে অপমান করে নয়।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে আমরা বরিশাল সরকারি বিএম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে গিয়েছি বরিশাল কলেজে। আমাদের কেন্দ্র ছিলো সেটি। বরিশাল কলেজ তখনো বেসরকারি, অর্থাৎ শিক্ষকরা বেসরকারি। সেখানে পরীক্ষা দেখতে সেনা অফিসাররা গেছেন। গাড়ি থেকে হাত উঁচু করে তারা জোর গলায় শিক্ষকদের সালাম দিচ্ছেন। সেই দৃশ্য আমি সারাজীবন মনে রাখবো। আর আমাদের এসব প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কী হয়েছে। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সব প্রশিক্ষণের মধ্যে আচার-আচরণ ভারোভাবে শেখাতে হবে। কারণ, দেশ এখন ব্রিটিশ নয়, পাকিস্তান নয়। এটি বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশ। দেশে এতো পরিবর্তন, এতো বিপ্লব ঘটে গেলো কিন্তু এখানে কোনো পরিবর্তনই হলো না? প্রশাসন ক্যাডারের লোকজন এখনো যেনো ‘ধরাকে সড়া জ্ঞান করছেন’। এটি কোনো ভালো লক্ষণ নয়, এটি দেশের জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলজনক নয়।
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক