ঢাকা মঙ্গলবার, ০৬ মে ২০২৫ , ২২ বৈশাখ ১৪৩২ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

অর্থনীতির সুষ্ঠু সংস্কার জরুরি

মতামত

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০৮:৩০, ৬ মে ২০২৫

সর্বশেষ

অর্থনীতির সুষ্ঠু সংস্কার জরুরি

দেশে নতুন বিনিয়োগ প্রায় স্থবির। বিনিয়োগের অন্যতম উপাদান মূলধনী যন্ত্রপাতি। গত তিন অর্থবছর ধরে এর আমদানি কমছে। তাতে অনুমান করা যায়, এর ফলে নতুন শিল্প স্থাপন এবং কর্মসংস্থান কম হচ্ছে।

চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) প্রথম আট মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতির জন্য খোলা ঋণপত্রের (এলসি) পরিমাণ ৩০ শতাংশ কমে গেছে। একই সময়ে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিও ৬ দশমিক ৮২ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গত ২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। 

উদ্যোক্তাদের মতে, এ ধরনের অবস্থা দেশের অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক। শিল্প খাতের অগ্রগতির জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানির তথ্য গুরুত্বপূর্ণ সূচক। কিন্তু গত তিন বছর ধরে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কমে যাওয়ার ফলে শিল্প স্থাপন ও সম্প্রসারণও ধীরে এগোচ্ছে।

২০২১-২২ অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি খোলার পরিমাণ ছিলো প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু চলতি অর্থবছরে তা কমে ১ বিলিয়ন ডলারের আশপাশে নেমে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য খোলা এলসি ছিলো মাত্র ১১৫ কোটি ৩৯ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময়ে ছিলো ১৬৫ কোটি ডলারের ওপরে। এর মানে, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণ গত এক বছরে ৩০ শতাংশ কমে গেছে।

কমছে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি-বিনিয়োগ কমায় দেশের বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে নিচে নেমে এসেছে।

চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেসরকারি খাতের খাণ প্রবৃদ্ধি ছিলো মাত্র ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ, যা ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের পর সবচেয়ে কম। 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যেকোনো শিল্প স্থাপনের জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি দরকার হয়। আর বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা এ ধরনের যন্ত্রপাতি আমদানি করেন। আমদানি কমে যাওয়ায় বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির হারও ৭ শতাংশের নিচে নেমে গেছে।

বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে দেশের শ্রমশক্তির ৪ শতাংশ চাকরি হারিয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মজুরি বৃদ্ধি না পেয়ে স্বল্প দক্ষশ্রমিকদের মজুরি ২ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে ভালো দক্ষ কর্মীদের মজুরি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে।

এর ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষ নতুন চাকরি পাচ্ছেন না এবং বর্তমান চাকরি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, গত দুই বছরে প্রতি পাঁচটি পরিবারের মধ্যে অন্তত তিনটি পরিবার সঞ্চয় ভেঙে জীবিকা নির্বাহ করেছে। এর মধ্যে রেমিট্যান্স আসা পরিবারগুলো কিছুটা সুরক্ষিত ছিলো।

তবে, সবচেয়ে ভাবনার বিষয় হলো, এ পরিস্থিতিতে ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে চরম দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা এই সংকটের কারণ হিসেবে কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হচ্ছে-১. দেশের ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার। অর্থাৎ ব্যাংক ঋণের সুদহার প্রায় ১৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা।

২. দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা অস্থির, যার কারণে উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না। ৩. বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে ডলার সংকট এবং মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করেছে।

এই প্রসঙ্গে ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, এখনো দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল নয়। অনেক ব্যবসায়ী সুদহার বৃদ্ধির কারণে বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়েছেন। তবে জ্বালানির সংকটও বড় বাধা হয়ে আছে বিনিয়োগের জন্য।

বিশ্বের অর্থনীতির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনের পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে চলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চীনা পণ্যে ১৪৫ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনও ১২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করছে। চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এমন বাণিজ্যযুদ্ধ বাংলাদেশসহ প্রতিযোগী দেশগুলোর জন্য সামনে নতুন সুযোগ নিয়ে আসতে পারে।

উচ্চ শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অধিকাংশ পণ্যে চীনের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা থাকবে না। ফলে চীন থেকে মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ক্রয়াদেশ সরাবে। সঙ্গে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগও স্থানান্তরিত হবে। চীনের ব্যবসা নিতে হলে বাংলাদেশের দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ লাগবে।

ব্যবসা সহজীকরণেও সরকারকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য-ঘাটতি কমাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক (রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ) আরোপ করেন।

এ ছাড়া ৫৭ দেশের ওপর বিভিন্ন হারে বাড়তি পাল্টা শুল্ক বসানো হয়, যদিও পাল্টা শুল্ক ৯০ দিনের স্থগিত করেছেন ট্রাম্প। তবে ন্যূনতম ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক সব দেশের পণ্যের ওপর বহাল রয়েছে।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধের মাত্রা বেড়ে চলেছে। শুরুতে ২ এপ্রিল চীনের পণ্যের ওপর ৩৪ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। পরে তা বেড়ে হয়েছে ১৪৫ শতাংশ। 

বিপরীতে চীনে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর শুল্ক বেড়ে হয়েছে ১২৫ শতাংশ। চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে পণ্যবাণিজ্য ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে বলে জানিয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)। এটি মোট বৈশ্বিক বাণিজ্যের তিন শতাংশ। চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে বিশ্ব অর্থনীতির বড় ক্ষতি হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের সেনসাস ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ৫৮২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়। তার মধ্যে চীন থেকে দেশটিতে ৪৩৮ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৪৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে চীন। চীনের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য খুবই নগণ্য।

যুক্তরাষ্ট্রের সেনসাস ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, গত বছর উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য হয়েছে ১০ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে আমদানি করেছে ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। দেশটি থেকে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। পাল্টা শুল্ক আরোপের কারণে তৈরি পোশাক, চামড়া পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের রপ্তানিকারকেরা মার্কিন ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ক্রয়াদেশ স্থগিতাদেশ পেতে শুরু করেছিলেন। এখন সেগুলো আবার ফিরছে।

পাশাপাশি তৈরি পোশাকের নতুন ক্রয়াদেশের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। আমাদের রপ্তানিকারকেরা ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের কাছে থেকে বেশ কিছু ই-মেইল পেয়েছেন। তারা চীন থেকে ক্রয়াদেশ সরাতে চায়। কারণ, দেশটির ওপর যে হারে শুল্ক বসেছে, তাতে মার্কিন ব্র্যান্ডগুলো চীন থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করে ব্যবসা করতে পারবে না।

উচ্চ শুল্ক আরোপের পর চীনের তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ স্থগিত করতে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। চীন থেকে বর্তমানে জাহাজে করে যেসব পণ্য যাচ্ছে, সেগুলোও বাতিল করে দিচ্ছে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান। চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্ক আরোপকে বাংলাদেশের জন্য বড় সুযোগ মনে করা যেতে পারে। চীনের ব্যবসা নিতে আমাদের প্রতিযোগী দেশও চেষ্টা করবে। তবে আমাদের অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে, যা অনেকের নেই।

ঠিকমতো কাজ করতে পারলে আগামী ১০ বছরের জন্য সম্ভাবনা খুলে যাবে আমাদের। চীনের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকেরা এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারে নজর দিচ্ছে। তারা অনেক কম দাম প্রস্তাব করছে, কারণ দেশটির সরকার প্রচুর ভর্তুকি দিচ্ছে। ফলে আমাদের যেসব প্রতিষ্ঠান শুধু ইইউ বাজারে পণ্য রপ্তানি করে, তাদের প্রতিযোগিতা বেড়ে যেতে পারে।

ইউএন কমট্রেড, চীনের কাস্টমস ও ইউনাইটেড স্টেটস ইন্টারন্যাশনাল কমিশনের (ইউএসআইটিসি) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় ইলেকট্রনিকস পণ্য।

তারপর রয়েছে হোম অ্যাপ্লায়েন্স, তৈরি পোশাক, চিকিৎসা পণ্য, কাঠের পণ্য, নির্মাণযন্ত্র, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, ব্যাটারি, রাসায়নিক দ্রব্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, যাতায়াতের সরঞ্জাম, সেমিকন্ডাক্টর ইত্যাদি। অন্যদিকে, বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হওয়া পণ্যের মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক, ক্যাপ, চামড়ার জুতা, হোম টেক্সটাইল, পরচুলা ও চামড়ার পণ্য।

বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। এর প্রভাবে ডলার সংকট কিছুটা কমেছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে মানে ধরে নিতে হবে এটি অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইতিবাচক। সরকারের আমদানি নীতি কিছুটা উদার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনীতির সঠিক সংস্কার এবং সুষম বিনিয়োগের মাধ্যমে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

 

জনপ্রিয়