ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

nogod
nogod
bkash
bkash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
nogod
nogod
bkash
bkash

বিদায় বন্ধু

মতামত

মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশিত: ১৯:১২, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

আপডেট: ১৯:৩৬, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

সর্বশেষ

বিদায় বন্ধু

মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী

৫০ বছরের বেশি সময় ধরে আমার আর মোছলেম উদ্দিন আহমেদের বন্ধুত্ব। সেই প্রিয় বন্ধু..চলার পথের বিশ্বস্ত সাথী আজ অনন্তলোকে। পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। যেখানে গেলে কেউ আর কখনো ফেরে না !

চট্টগ্রাম শহরে একই সঙ্গে রাজনীতি,মহান মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিয়েছি। আমার বাড়ি দামপাড়ার রাস্তার ওপারেই লালখান বাজার এলাকায় তাঁর বাড়ি। আমরা দুজনেই স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম তৎকালীন চট্টগ্রাম পৌরসভা(বর্তমানে সিটি কর্পোরেশন)নির্বাচনে কমিশনার নির্বাচিত হই। আমি বাগমনিরাম ওয়ার্ড থেকে সে লালখান বাজার ওয়ার্ডে। দলীয় সহকর্মীর সম্পর্কটি দীর্ঘ পাঁচ দশকের পরিক্রমায় আমাদের পারিবারিক সম্পর্কে পৌঁছেছে। আমার বড় ভাই মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শহীদ, সিটি কলেজ ছাত্র-সংসদের তৎকালীন এজিএস শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরীরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ছোট বেলার সাথী ছিলেন মোছলেম। সেই সুত্রেও আমাদের বাড়িতে তিনি নিয়মিত আসতেন।

মুক্তিযুদ্ধের আগে গণজাগরণের উত্তাল দিনে সেসহ অন্য ছাত্রনেতাদের আনাগোনায় আমাদের বাড়ি মুখরিত থাকতো। ১৯৭০ দশকের শুরুতেই মোটামুটি বাঙালি জাতি বুঝতে পেরেছিলো-পাকিস্তানীদের থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ পেতে হলে সংগ্রামের বিকল্প নেই। আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মরহুম জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরী চট্টগ্রামে থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় স্বাধীনতা আন্দোলন ও সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন..সে সময় থেকেই একজন মুক্তিপাগল বাঙালির সন্তান হিসেবে ছাত্রনেতা মোছলেম উদ্দিন দেশের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন।মোছলেম উদ্দিন আহমদ

দেশমাতৃকার বীর সন্তান মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে চট্টগ্রামের কাজীর দেউরী নেভাল এভিনিউতে পাকিস্তানী নৌ-সেনাদের হাতে গ্রেফতার হন চট্টগ্রামের বীর সন্তান মরহুম এ.বি.এম. মহিউদ্দিন চৌধুরী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা  মোহাম্মদ ইউনুস। তাঁরা মুলতঃ যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই বিছিন্নভাবে বিভিন্ন গেরিলা অপারেশনের প্রস্তুতি ও বাঙালি যুবকদের উদ্বুদ্ধ, প্রশিক্ষণে কাজ করছিলেন। ধরা পড়ার পর নিশ্চিত মৃত্যু তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো! - পরে কারাগারে থাকা অবস্থায় গাড়ির ময়লা শরীরে মাখিয়ে পাগলের অভিনয় করে মোছলেম উদ্দিন, মহিউদ্দিন চৌধুরী ও ইউনুস জেল থেকে বের হয়ে যান। নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বেঁচেও মোছলেম উদ্দিন নিরাপদে না থেকে পুনরায় সম্মুখ যুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন।

মোছলেম উদ্দিন একজন আপাদমস্তক দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ, ত্যাগী আওয়ামীলীগ নেতা। তিনি তৃণমূল থেকে উঠে আসা রাজনৈতিককর্মী - স্কুল জীবন থেকে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত দেশ, দলের জন্য দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, পরবর্তীতে চট্টগ্রাম জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ছিলেন বন্ধু মোছলেম উদ্দিন। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর খুনি সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে মরহুম মৌলভী সৈয়দ, মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, মরহুম এম.এ মান্নান, মরহুম এ.বি.এম মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ অন্যান্যদের সাথে প্রতিবাদ প্রতিরোধ সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠা ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে চট্টগ্রামের এই কৃতি সন্তান ১৫ আগস্টের পর থেকে অনেকবার কারাবরণ, জুলুম, নির্যাতনের শিকার হন। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের প্রায় তিন  দশকেরও বেশী সময় ধরে সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি। মহান আল্লাহ তার মনের আশা শেষ সময়ে পূর্ণ করেন। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে তার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হওয়ারও সুযোগ পেয়ে যান। গত দুই বছর আগে আওয়ামীলীগের টিকেটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার মৃত্যুতে চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশ হারালো দেশপ্রেমিক সন্তান, আদর্শবান রাজনীতিবিদকে।

মোছলেম উদ্দিন কখনো প্রিয় মাতৃভূমি ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রশ্নে আপস করেননি। তার মৃত্যুর পর প্রতিটি মুহূর্ত আমার কেটেছে পুরানো দিনের সংগ্রামী স্মৃতিগুলোর কথা ভেবে.. অপেক্ষায় ছিলাম কখন ঢাকা থেকে তার মরদেহ আসবে প্রিয় চট্টগ্রামে। বোয়ালখালীতে প্রথম জানাজার পর তার দ্বিতীয় জানাজা হলো আমার বাড়ির পাশে দামপাড়া জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদ মাঠে। তার প্রতি মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা দেখে আমি অভিভূত। সাধারণত জানাজার পর বাসায় চলে যাওয়ার কথা থাকলেও.. মন মানছিলো না-ইচ্ছে করছিলো না বন্ধুকে বিদায় জানাতে। তাই তার শবদেহবাহী গাড়ির সঙ্গে  আমাদের চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামীলীগের সংগ্রামী সাধারণ সম্পাদক , সাবেক মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিনকে  নিয়ে ছুটে চললাম তার চিরনিদ্রার শেষ ঠিকানা হযরত গরীব উল্লাহ্ শাহ (রঃ) মাজার সংলগ্ন কবরস্থানে। সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেই তাকে মাটি দেয়া হলো। আমরা সবাই তার কবরে ফাতেহা পাঠ, ফুলেল সম্মান জানালাম। অনন্তকালের নিদ্রায় শায়িত থাকবে বন্ধু তুমি.. এই পবিত্র মাটিতে, যে মাটিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য তুমি করেছো বীরের মতো লড়াই। আর তো বন্ধু থাকার সুযোগ নেই। এবার আমার বাড়ি ফেরার পালা। বিদায় বেলায় বলবো.. বন্ধু আজ যদিও শেষ দেখা হলো, তবুও বলবো না চির-বিদায়.. এ দেশ,মা টি তোমাকে অনন্তকাল মনে রাখবে- এ জাতি তোমার কাছে চিরঋণী।

বিদায় বেলায় মনকে কোনোভাবে বোঝাতে পারছি না। অবুঝ মনকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের.. ‘যেতে নাহি দিবো’ কবিতার কয়েকটি লাইন মনে মনে আওড়াতে লাগলাম।

 

এ অনন্ত চরাচরে, স্বৰ্গমর্ত্য ছেয়ে

সবচেয়ে পুরাতন কথা

সবচেয়ে গভীর ক্রন্দন

যেতে নাহি দিব হায়

তবু যেতে দিতে হয়

তবুও চলে যায়!

 

মরহুম জননেতা মোছলেম উদ্দিনের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি, মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুন। আমিন।

 

লেখকঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ।

জনপ্রিয়