
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের দিক থেকে দিনাজপুর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। দিনাজপুর শহরটি পৌরাণিক নদী পুনর্ভবার তীরে অবস্থিত। পাল রাজবংশের সময়ে দিনাজপুর গোটা রাজশাহী বিভাগ ও ঢাকা জেলার অনেকটা বিস্তৃত ছিলো। শুধু পাল আমলের নয়, সেন রাজত্বকালে নির্মিত অসংখ্য প্রত্নবস্তুর সন্ধান মিলেছে দিনাজপুরসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায়। তবে অযত্ন-অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে এ অঞ্চলের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা। হারিয়ে যেতে বসা স্থাপনাগুলোর মধ্যে শতাব্দী প্রাচীন রাজবাড়িটি অন্যতম। প্রায় ১৬ দশমিক ৪১ একর ভূমিজুড়ে অবস্থিত ঔপনিবেশিক ও প্রাক্-ঔপনিবেশিক যুগের রাজবাড়িটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
অযত্ন আর অবহেলায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রাজবংশের শেষ নিদর্শন দিনাজপুরের রাজবাড়ি দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। কালক্রমে রাজপ্রাসাদে থাকা মূল্যবান ও দুর্লভ জিনিসপত্র চুরি হয়ে যাচ্ছে। রাত হলেই রাজবাড়িতে বসে মাদকসেবীদের আড্ডা। দেখতে এসে দর্শনার্থী ও পর্যটকরা হতাশ হয়ে ফিরে যান। সচেতন মহলের দাবি, প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হলে এটি হতে পারতো পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান। দেশের ঐতিহ্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাটি রক্ষায় সরকারের নজর দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। দিনাজপুর শহর থেকে ৪ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে নিরিবিলি মনোরম এক গ্রাম্য পরিবেশে হিন্দু, মুসলিম ও ইংরেজ-এ তিন যুগের স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যের চিত্রসংবলিত রাজবাড়িটি অবস্থিত।
ইতিহাস থেকে জানা গেছে, রাজবাড়িতে ছিলো-আয়না মহল, রানি মহল ও ঠাকুরবাড়ি মহল। এছাড়াও ফুলবাগ, হীরাবাগ, সবজিবাগ, পিলবাগ, দাতব্য চিকিৎসা, অতিথি ভবন, প্রশাসনিক ভবন, কর্মচারীদের আবাসিক এলাকাসহ প্রাসাদের মধ্যে কয়েকটি বিরাট দিঘি রয়েছে। দ্বিতল আয়না মহলের নিচে-ওপরে মিলে ২২টি করে ৪৪টি কক্ষ রয়েছে। এছাড়াও রাজপ্রাসাদ এলাকায় জলসাগর, তোশাখানা ও পাঠাগার প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভবন এ মহলে অবস্থিত। আয়না মহলের উত্তরে রানির দেউড়ি পেরিয়ে রানি মহল অবস্থিত। রাজপরিবারের ইতিহাস নিয়ে জনমুখে রয়েছে নানা কাহিনী। যতদূর জানা যায়, দিনাজ রাজা অথবা দিনরাজ রাজা রাজবাড়ি তথা রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। তার নামানুসারেই দিনাজপুর জেলার নামকরণ করা হয়েছে।
জানা গেছে, ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ বিভাগের পর জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে তৎকালীন মহারাজা জগদীশচন্দ্র নাথ সপরিবারে ভারতে চলে যান। এরপর এটি পাকিস্তান সরকার পরিত্যক্ত ঘোষণা করে ইপিআরদের একটি ব্যাটালিয়ানের অফিস করা হয়। ইপিআর হেড কোয়ার্টার হওয়ার পর তারা চলে যায়। পরবর্তী সময় তৎকালীন সরকার সেখানে পিডিবি (পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড) স্থাপন করে। নিজস্ব ভবন হওয়ার পর ৬৬/৬৭-এর দিকে তারাও চলে গেলে এ বাড়িটি সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। এরপর থেকেই এ প্রাসাদে থাকা মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি হতে থাকে।
দিনাজপুরের রাজবাড়ি একদিকে যেমন জেলার একটি ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থান, অন্যদিকে এটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য পুণ্যস্থান। রাজবাড়ির মন্দিরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই সেখানে পূজা-অর্চনা ও কীর্তন হয়ে থাকে। দিনাজপুরের রাজবাড়িতে কান্তজিউ আসার পর থেকে প্রতিদিনই এখানে ভোগ দেয়া হয়। এছাড়াও এ প্রাসাদের ভিতরে দুর্গাদেবীর মন্দির রয়েছে। এ মন্দিরে দুর্গাপূজার সময় হাজার হাজার ভক্তের সমাগম হয়ে থাকে। এর বাইরে বিশাল মেলা বসে। এ মেলায় শুধু হিন্দুরা নয়, অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজনেরও সমাগম ঘটে। আরো জানা গেছে, রাজপ্রাসাদের ভিতরের ঘরগুলো বর্তমানে জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে-এমন আশঙ্কায় কেউ ভিতরে প্রবেশ করে না। তবে এর ভিতরের দৃশ্য অত্যন্ত সুন্দর ও মনোরম। প্রাসাদের রুমগুলোতে কেউ বসবাস না করায় সেগুলোতে বিভিন্ন লতাপাতা ও গাছ জন্মেছে। রুমগুলো তৈরি করতে যে লোহার প্রয়োজন হয়েছিলো সেগুলোও বর্তমানে চুরি হয়ে যাচ্ছে। আয়না মহল, রানি মহলের মূল্যবান মার্বেল পাথর, অসংখ্য স্টিলের বিশাল বিশাল বিমগুলো দিনের পর দিন অপরাধীচক্র পাচার করে আসছে। কোটি কোটি টাকার মালামাল সেখান থেকে চুরি হয়ে গেছে।
দিনাজপুর রাজবাড়ির সর্বশেষ জমিদার জগদীশনাথ ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। বর্তমানে এই রাজবাড়িটি কালের সাক্ষী হিসাবে টিকে আছে।
দিনাজপুর রাজবাড়ির বিভিন্ন স্থাপনার মধ্যে রয়েছে কুমার মহল, আয়না মহল, রাণী মহল, আটচালা ঘর, লক্ষ্মী ঘর, ঠাকুর বাড়ি, কালীয়া জিউ মন্দির, রাণী পুকুর, আতুর ঘর, চাঁপা তলার দিঘী ইত্যাদি। এছাড়াও এই জমিদার বাড়ি হতে প্রাপ্ত রাজবংশের ব্যবহৃত বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন ঢাকাস্থ জাতীয় জাদুঘর এবং দিনাজপুর মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রতন জানান, রাজবাড়ী বর্তমানে ধংসের দারপ্রান্তে এসে দাড়িয়েছে। তাই এটাকে রক্ষা করার জন্য সরকারের দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। ইতোমধ্যে কিছু ভূমিদস্যু জায়গা দখল করে নিয়েছে। তাদের উচ্ছেদ করে সরকারি উদ্যোগ গ্রহন করে হেরিটেজ এর আওতায় নিয়ে এসে রাজবাড়ীকে নতুন করে সাজিয়ে ইতিহাস ঐতিহ্য ধরে রাখা একান্ত প্রয়োজন বলে দিনাজপুরের অভিজ্ঞ মহল মনে করছে।
এটি বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক স্বীকৃত না হওয়ায় অযত্নে অবহেলায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বর্তমানে জনগণ এটিকে অনেকটা ভাগাড় হিসেবে ব্যবহার করায় বিদ্যামান অংশও ধ্বংসপ্রায়। অবিলম্বে স্থাপনাটি সংরক্ষণ না করা হলে হয়তো কালের গর্ভে বিলিন হয়ে যাবে রাজবাড়ির গোরবদীপ্ত ইতিহাস।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ফটোজার্নালিস্ট এসোসিয়েশন