
বালুচিস্তানের মানুষের স্বাধীনতা ও সম্মানের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। প্রকৃতিগতভাবে সাহসী, স্বাধীনচেতা এবং যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত এই অঞ্চলের মানুষ বৃটিশদের কাছ থেকেও সম্মান আদায় করে নিয়েছিল।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বালুচরা তাদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তা ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে আসছে। তবে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ক্রমাগত নিপীড়ন ও শোষণ তাদের এই আকাঙ্ক্ষাকে আরও তীব্র করে তুলেছে।
ঐতিহাসিকভাবে বালুচিস্তানের একটি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিচিতি ছিল। বৃটিশ শাসনামলে বালুচিস্তান একটি আধা-স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে মর্যাদা পেত।
কিন্তু দেশভাগের পর এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্তি পাকিস্তানের সাথে হয়। যা বালুচদের মধ্যে অসন্তোষের জন্ম দেয়। তাদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তা, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অবজ্ঞা এবং প্রাকৃতিক সম্পদের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ বালুচদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী চেতনাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
১৯৪৭ সাল থেকে বালুচিস্তান বেশ কয়েকবার নিজেদের স্বাধীনতার দাবি জানিয়েছে। ১৯৬০-এর দশক থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে সশস্ত্র বিদ্রোহ দেখা গেছে। বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) সহ বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের মূল দাবি হলো একটি স্বাধীন বালুচিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
বালুচিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইরানের সাথে দীর্ঘ সীমান্ত থাকলেও ধর্মীয় ভিন্নতা এবং আফগানিস্তানের সাথে সীমান্ত থাকলেও জাতিগত অমিল বালুচদের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই দুটি দেশের সমর্থন পাওয়া কঠিন করে তুলেছে। ঐতিহাসিকভাবে ইরান ও আফগানিস্তানের সাথে বালুচদের সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত কিছু যোগসূত্র থাকলেও, জাতীয় স্বার্থের ভিন্নতার কারণে তারা বালুচদের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি তেমন কোনো সহানুভূতি দেখায়নি।
অন্যদিকে, পাকিস্তানের জন্মশত্রু ভারতের কাছ থেকে বালুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনে মদদ পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ভারত বরাবরই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি অনুসরণ করে আসছে। তবে, কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, পাকিস্তানের দুর্বল মুহূর্তে বালুচদের স্বাধীনতা আন্দোলন ভারতের জন্য একটি সুযোগ তৈরি করতে পারে।
যদিও ভারত সরাসরি কোনো সশস্ত্র সমর্থন জুগিয়েছে এমন কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই। তবে বালুচদের অভিযোগ অনুযোগগুলো এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলি আন্তর্জাতিক স্তরে তুলে ধরতে ভারত সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছে।
বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বালুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য একটি নতুন সুযোগ এনে দিতে পারে। ভারত যখন পাকিস্তানের সাথে সীমান্ত নিয়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে রয়েছে, তখন পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমাঞ্চলে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে বাধ্য।
এই পরিস্থিতিতে বালুচিস্তানে সক্রিয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো তাদের কার্যক্রম জোরদার করতে পারে। পাকিস্তানের দুর্বল সামরিক উপস্থিতি তাদের জন্য নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করার একটি সুযোগ তৈরি করতে পারে।
তবে, বালুচদের স্বাধীনতা আন্দোলন বহুধা বিভক্ত। বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্ন লক্ষ্য ও কৌশল নিয়ে কাজ করছে। এই অভ্যন্তরীণ বিভেদ আন্দোলনের দুর্বলতা হিসেবে কাজ করতে পারে। অন্যদিকে, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী অত্যন্ত শক্তিশালী এবং তারা যেকোনো মূল্যে বালুচিস্তানের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর।
বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের মতে, বালুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের ভবিষ্যৎ বহুলাংশে নির্ভর করে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সমীকরণের উপর। যদি ভারত ও আফগানিস্তানের মতো দেশগুলো বালুচদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন প্রদান করে, তবে তাদের আন্দোলন একটি নতুন গতি পেতে পারে।
একইসাথে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো যদি বালুচিস্তানে পাকিস্তানের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো জোরালোভাবে তুলে ধরে, তবে পাকিস্তানের উপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি হতে পারে।
কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বালুচিস্তানের কৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনা করে চীনও এই অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বালুচিস্তানের মধ্য দিয়ে গেছে। এই কারণে, বালুচিস্তানের স্থিতিশীলতা চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যদি বালুচিস্তানের পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যায়, তবে চীন পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে যাতে তারা বালুচদের রাজনৈতিক অধিকারের প্রতি সম্মান দেখায়। ন্যায্যতা দিয়ে যেন একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে অগ্রসর হয়।
তবে, বাস্তবতা হলো বালুচিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রাম একটি দীর্ঘ ও কঠিন পথ। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কখনোই বালুচিস্তানের স্বাধীনতা মেনে নেবে না। তারা কঠোর হাতে এই অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমন করার চেষ্টা চালিয়ে যাবে।
অন্যদিকে, বালুচদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির অভাব এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সুস্পষ্ট সমর্থনের অভাব তাদের লক্ষ্য অর্জনে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
চলমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে বালুচরা সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারবে কি-না, তা সময়ই বলবে।
তবে, তাদের দীর্ঘদিনের স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষা এবং আত্মত্যাগের ইতিহাস তাদের সংগ্রামকে বাঁচিয়ে রাখবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত বালুচিস্তানের জনগণের রাজনৈতিক অধিকার ও মানবাধিকারের প্রতি মনোযোগ দেওয়া। একটি শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক সমাধানের জন্য পাকিস্তানকে উৎসাহিত করা। অন্যথায়, এই অঞ্চলের সংঘাত আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে। ফলস্বরূপ আঞ্চলিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেতে পারে।
‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’
এই তত্ত্বে কি ভারতের কাছ থেকে কোন সুবিধা বাগিয়ে নিতে পারবে বালুচরা। তাই এখনে দেখার বিষয়। যদিও ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বালুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি কোনো সরাসরি সমর্থন জানায়নি। তবে ভারতের বালুচদের স্বাধীনতা আন্দোলনে মদদ দেওয়ার পেছনে একাধিক কৌশলগত উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
কিছু বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষক মনে করেন যে ভারতের নীতি পরোক্ষভাবে বালুচদের স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষাকে উৎসাহিত করতে পারে। এর সম্ভাব্য কয়েকটি কারণ হলো:
১. পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করা: বালুচিস্তানে অস্থিরতা তৈরি করে ভারত পাকিস্তানকে তার অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানে মনোযোগ দিতে বাধ্য করতে পারে, যা কাশ্মীর থেকে তার মনোযোগ কিছুটা হলেও কমাতে পারে।
২. আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার: বালুচিস্তানের কৌশলগত অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চলের দীর্ঘ উপকূলরেখা এবং খনিজ সম্পদ এটিকে ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। একটি স্বাধীন বালুচিস্তান ভারতের জন্য ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি)-এর বিরোধিতা করে ভারত বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন করতে পারে। কারণ সিপিইসি-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বালুচিস্তানের মধ্য দিয়ে গেছে।
৩. কৌশলগত মিত্রতা তৈরি: বালুচরা দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা নিপীড়িত। ভারত যদি তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে নৈতিক বা কূটনৈতিক সমর্থন প্রদান করে, তবে ভবিষ্যতে একটি স্বাধীন বালুচিস্তানের সাথে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হতে পারে। যা আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারতের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করবে।
৪. মানবাধিকারের উদ্বেগ: পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা বালুচদের উপর নিপীড়ন, গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ আন্তর্জাতিক মহলে দীর্ঘদিন ধরেই উত্থাপন করেছে ভারত। বালুচদের স্বাধীনতা আন্দোলনে সমর্থন দেওয়া ভারতের মানবাধিকার নীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে।
৫. ১৯৭১ সালের পুনরাবৃত্তি: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা একটি অনন্য উদাহরন তৈরি করেছে। যদিও বালুচিস্তানের পরিস্থিতি বাংলাদেশের মতো নয়। তবুও কিছু ভারতীয় নীতিনির্ধারক মনে করেন পাকিস্তানের দুর্বল মুহূর্তে বালুচদের সমর্থন করে পাকিস্তানকে দুর্বল করা সম্ভব।
তবে, ভারতের এই ধরনের পদক্ষেপের কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সরাসরি হস্তক্ষেপ আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত হতে পারে। ফলে আঞ্চলিক অস্থিরতা আরও বাড়তে পারে। পাকিস্তানও ভারতের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নিতে পারে। যা উভয় দেশের মধ্যে সংঘাতের তীব্রতা বৃদ্ধি করা ছাড়া হ্রাসের কোন পথ খোলা রাখবে না।
বর্তমানে, ভারত সম্ভবত একটি সতর্ক নীতি অনুসরণ করছে। তারা সরাসরি কোনো সামরিক বা আর্থিক সাহায্য না করে আন্তর্জাতিক ফোরামে বালুচদের মানবাধিকারের বিষয়টি তুলে ধরছে মাত্র। যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের উপর কূটনৈতিক চাপ বজায় রাখছে। চলমান ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার মধ্যে বালুচরা যদি তাদের স্বাধীনতা আন্দোলন জোরদার করে তবে ভারত নিশ্চয় কৌশলগত অবস্থানেই থাকবে।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের মূল লক্ষ্য সম্ভবত পাকিস্তান ভেঙে দেওয়া নয়। পাকিস্তানকে দুর্বল করে আঞ্চলিক রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করা। জঙ্গীগোষ্টির তৎপড়তা বন্ধে পাকিস্তানকে বাধ্য করা। বালুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ভারত একটি কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, বালুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন একটি জটিল ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণের অংশ।
অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা – এই সবকিছুই বালুচদের ভবিষ্যতের উপর প্রভাব ফেলবে।
চলমান পরিস্থিতিতে বালুচরা কোনো তাৎক্ষণিক সুবিধা নিতে পারবে কি-না, তা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। তবে তাদের দীর্ঘদিনের লড়াই এবং আত্মত্যাগ হয়তো একদিন তাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ করতে সহায়ক হবে।
লেখক: আবু সাঈদ, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।