ঢাকা রোববার, ১১ মে ২০২৫ , ২৭ বৈশাখ ১৪৩২ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

হজরত ইবরাহীম (আ.)-এর স্মৃতিবিজড়িত হজ

মতামত

মাওলানা শামসুদ্দীন সাদী

প্রকাশিত: ১৯:৫০, ১০ মে ২০২৫

সর্বশেষ

হজরত ইবরাহীম (আ.)-এর স্মৃতিবিজড়িত হজ

ছবি : সংগৃহীত

হজ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ। ইসলামের মৌলিক ভিত্তি। আল্লাহ তায়ালা সামর্থ্যবান মুসলমানদের ওপর হজ ফরজ করেছেন। যারা হজে গমন করার আর্থিক ও শারীরিক শক্তি রাখে এবং কোনো বাধা বিপত্তির সম্মুখীন না হয় তারা পবিত্র নগরীতে উপস্থিত হয়ে আল্লাহর ঘর কাবা শরিফ তাওয়াফ, উকুফে আরাফা, মীনায় কংকর নিক্ষেপ ইত্যাদির মাধ্যমে হজ সম্পন্ন করবে।

হজ ও মক্কা নগরীর সাথে জড়িয়ে আছে আল্লাহপ্রেমের এক অনাবিল ইতিহাস। অ¤øান বদনে আল্লাহর নির্দেশ শিরোধার্য করার এক অতুলনীয় উপাখ্যান।

আল্লাহ তায়ালা হজরত ইবরাহীম ও হজরত ইসমাঈল (আ.)-কে কিছু পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন। যার উদ্দেশ্য ছিল তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করা এবং তাঁদেরকে কেন্দ্র করে পৃথিবীতে তাওহিদ ও একত্ববাদের ভিত্তি সুদৃঢ় করা। হজরত ইবরাহীম (আ.)-এর জন্য একটি বড় পরীক্ষা ছিল বহু কাক্সিক্ষত সন্তান শিশুপুত্র ইসমাঈল ও তার মা হাজেরাকে বিরান পাহাড় পরিবেষ্টিত উত্তপ্ত মরুপ্রান্তর মক্কায় রেখে আসা। মক্কা ও তার আশপাশে শত শত মাইলজুড়ে তখন কোনো পশু-পাখি, লোকালয় বা জনমানুষের চিহ্নও ছিল না। প্রচÐ রোদ ও পাথুরে পাহাড় ব্যতীত আর কিছু ছিল না সেখানে। গাছ ও গাছের ছায়াও ছিল না। ছিল না পানীয় বা খাদ্যের কোনো ব্যবস্থা। কিন্তু আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে হজরত ইবরাহীম (আ.) এমন সংকটময় স্থানে কলিজার টুকরা সন্তান শিশু ইসমাঈল ও তার মা হাজেরাকে রেখে ফিরে যান সিরিয়ায়।

খাদ্য পানীয় ও জীবন ধারনের ন্যূনতম উপকরণহীন মরুপ্রান্তরে মা-পুত্রকে অবস্থান করার নির্দেশটি আল্লাহর অপার মহিমা ও নিগুঢ় রহস্যে আবৃত। যার মাধ্যমে একত্ববাদী চেতনায় সমর্পিত জাতির উত্থান ঘটাবেন আল্লাহ তাঁর দৃঢ়তা, অবিচলতা ও আত্মসমর্পণের পরীক্ষা নিবেন না, তা কি হয়? আল্লাহ তায়ালার অভিপ্রায় ছিল হজরত ইবরাহীম, হজরত ইসমাঈল ও বিবি হাজেরাকে মানবজাতির জন্য আদর্শ ও চির স্মরণীয় করে রাখবেন।

বিবি হাজেরা ও শিশুপুত্র ইসমাঈল মরুপ্রান্তরেই বসবাস করতে শুরু করলেন। একসময় খাদ্য ও পানীয় শেষ হয়ে গেল। তীব্র খাদ্য সংকটে মা-পুত্র অনেকটা মৃত্যুমুখে পতিত। হজরত হাজেরা ক্ষুধার্ত সন্তানের কলিজাফাটা কান্না সহ্য করতে পারলেন না। দৌড়ে গেলেন সামনের সাফা পাহাড়ে। হন্ন হয়ে খুঁজলেন চারিদিকে, কোথাও কোনো মানুষ বা খাদ্যের সন্ধান পেলেন না। আবার দৌড়ে গেলেন মারওয়া পাহাড়ে, এবারও পেলেন না কিছুই। ক্ষুধা পিপাসায় নিজের কলিজা ছিড়ে যাচ্ছিল, সামনে মরণোন্মুখ সন্তান। দৌড়ে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এলেন সন্তানের কাছে।

ছবি : সংগৃহীত

এমন কঠিন মুহূর্তে মরুর বুক চিরে কুদরতী পানির ঝর্না খুলে গেল। শিশুপুত্রের পদাঘাতে সৃষ্টি হলো মরুঝর্না জমজম। উতলে উঠল স্বচ্ছ টলমলে পানি। বিবি হাজেরা পান করলেন আঁজল ভরে। কলিজা শীতল করলেন। সন্তানের মুখেও তুলে দিলেন কয়েক ফোঁটা। মা-পুত্র যেন নতুন জীবন লাভ করলেন। আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন মা-পুত্র।

আল্লাহ তায়ালা মা ও পুত্রের এই স্মৃতিকে কেয়মাত পর্যন্ত ধরে রাখার জন্য হজ ও উমরার মধ্যে সাফা মারওয়ায় সায়ি করাকে আবশ্যক করে দিয়েছেন।

এই কুদরতী ঝর্নাকে কেন্দ্র করে পশুপাখির আনাগোনা শুরু হয়। গড়ে উঠে জনবসতি। বনু জুরহাম গোত্রের কিছু লোক এসে হজরত হাজেরার অনুমতি নিয়ে আবাস গড়ে এখানে। ধীরে ধীরে মক্কা হয়ে উঠে বিশাল জনগোষ্ঠীর জনপদ।

শিশু ইসমাঈল বড় হতে থাকলেন। হাঁটিহাঁটি পা পা করে তার বয়স হয়ে গেল ১৩। এখন তিনি বালক। অনেক কিছু বুঝেন। মায়ের কাজে সহযোগিতা করেন। পিতার কাজে সহযোগিতা করেন। পিতার সাথে এখানে ওখানে যান। এমন বয়সে সন্তানের প্রতি মা বাবার আস্থা ভরসা মায়া-মমতা চ‚ড়ান্ত পর্যায়ে বাড়তে থাকে। তাঁরা আগামী প্রজন্ম নিয়ে স্বপ্ন দেখে। এমন সময়ে আল্লাহ তায়ালা হজরত ইবরাহীম ও হজরত ইসমাঈলকে দ্বিতীয় পরীক্ষার সম্মুখীন করলেন। স্বপ্নের মাধ্যমে আল্লাহ নির্দেশ দিলেন হজরত ইবরাহীম যেন টগবগে বালক ইসমাঈলকে আল্লাহর জন্য কোরবানি করেন। কত কঠিন নির্দেশ! যে বালককে ঘিরে বৃদ্ধ পিতা আগামীর স্বপ্ন বুনছেন তাকেই জবাই করে দিতে হবে! আল্লাহু আকবার!

হজরত ইবরাহীম (আ.) আল্লাহর আদেশ মেনে নিলেন। পুত্রকে ডেকে তার মতামত জানতে চাইলেন। আল্লাহ তাআলা কুরআনে সেই ঘটনা উল্লেখ করে বলেন : অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল তখন ইবরাহীম তাকে বলল, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে জবেহ করছি, এখন তোমার অভিমত কি দেখ। সে বলল, পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন। (সুরা সাফফাত : ১০২)

পিতা যেমন আল্লাহর আদেশ বিনা বাক্যে মেনে নিলেন সন্তান তার চেয়ে অগ্রগামী হয়ে উত্তর দিলেন। পিতা বলেছেন স্বপ্নের কথা, সন্তান স্বপ্নের বিষয়কে উড়িয়ে দিতে পারতেন বা অন্য কোনো ব্যাখ্যা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি কোনো ব্যাখ্যা না করে স্বপ্নকে সরাসরি আল্লাহর আদেশ হিসেবে গ্রহণ করে তা পূর্ণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন।

আল্লাহর হুকুমের সামনে জীবন উৎসর্গ করে পিতাপুত্র যে অমর ইতিহাস রচনা করলেন আল্লাহ তায়ালা কেয়ামত পর্যন্ত সেই স্মৃতি ধরে রাখার জন্য কোরবানি আবশ্যক করে দিয়েছেন।

আল্লাহর অভিপ্রায় ছিল হজরত ইসমাঈল (আ.)-এর মাধ্যমে এমন এক জাতির উদ্ভব করবেন যারা পৃথিবীতে তাওহিদ ও আল্লাহর একত্ববাদের ধারক বাহক হবে। যারা আল্লাহর আদেশের সামনে বিনা বাক্যে মাথা নত করবে। যারা কেয়ামত পর্যন্ত কাবা শরিফ আবাদ রাখবে।

নানা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পরে হজরত ইবরাহীম ও হজরত ইসমাঈল (আ.) মিলে আল্লাহর হুকুমে পবিত্র কাবা নির্মাণ করেন। কাবা নির্মিত হওয়ার পরে আল্লাহ তাআলা হজরত ইবরাহীম (আ.)-কে আদেশ করলেন তুমি মানুষকে হজের দিকে আহ্বান কর। সেই ঘটনা উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা বলেন, যখন আমি ইবরাহীমকে বায়তুল্লাহর স্থান ঠিক করে দিয়ে বলেছিলাম যে, আমার সাথে কাউকে শরিক করো না এবং আমার গৃহকে পবিত্র রাখ তাওয়াফকারীদের জন্যে, নামাজে দণ্ডায়মানদের জন্যে এবং রুকু সেজদাকারীদের জন্যে। এবং মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা প্রচার কর। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর দূরান্ত থেকে। (সুরা হজ : ২৬-২৭)

হাজার হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও তাওহিদ ও একত্ববাদে বিশ্বাসীগণ ইবরাহীম আ.এর হজের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আজও জড়ো হয় পবিত্র মক্কা নগরীতে, খানায়ে কাবার চত্বরে; সাদা কাপড়ের শুভ্রতায় হাজির হয় আরাফার ময়দানে, মীনার প্রান্তরে, হযরত ইবরাহীম আ.এর স্মৃতি বুকে ধারণ করে। আল্লাহ তাআলা সকলকে হজ করার তাওফিক দান করুন।

শিক্ষক, জামিয়া আম্বরশাহ আল ইসলামিয়, কাওরান বাজার, ঢাকা

জনপ্রিয়