
দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করা একটি অমীমাংসিত বিষয়। বিষয়টি নিয়ে আন্দোলন চলছে সেই সত্তর দশক থেকে। এর মধ্যে অনেক সরকার বদল হয়েছে, দেশের পরিস্থিতি ও অর্থনীতি সবই অনেক পাল্টেছে কিন্তু পাল্টায়নি বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা, বেসরকারি শিক্ষকদের চাকরি রাষ্ট্রের হাতে নেয়া।
শিক্ষকরা বলছেন, মাধ্যমিক শিক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্বে নিয়ে শিক্ষার মান বাড়বে, শিক্ষকদের আর্থিক অবস্থা ও সমাজিক অবস্থান উন্নত হবে, শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে এবং সরকারি ও বেসরকারি যে পাহাড়সম বৈষম্য বিদ্যমান সেটিও দূর হবে।
জাতীয়করণ হলে শিক্ষার মান বাড়বে কি না সেটি নিয়ে সব সরকারই সন্দেহ পোষণ করেছে, তারা উদাহরণ হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষাকে সামনে নিয়ে এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষার জাতীয়করণ করা হয়েছে কিন্তু শিক্ষার মান তলানিতে। মাধ্যমিকেও যদি সেই অবস্থা হয় তাহলে টোটাল শিক্ষা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
এটি কোন শক্ত যুক্তি নয়। শিক্ষকদেরকে যদি শিক্ষাদানে নির্বিঘ্ন মনোযোগ দিতে হয়, প্রতিষ্ঠানে যথেষ্ট সময় দিতে হয় তাহলে তাদের পেটে শান্তি ও পকেটে অর্থ থাকতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে একটি দেশে মুষ্টি কয়েকটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় (৬৯১টি) রাষ্ট্রের পুরো দায়িত্বে থাকবে আর বাকি ৯৭ শতাংশ পরিচালিত হবে বেসরকারি খাতে এবং সেটিও সুযোগ-সুবিধা, অর্থনৈতিক প্রণোদনা দিক দিয়ে বিশাল বৈষম্য বজায় রেখে, এটি মেনে নেয়া যায় না।
এজন্য কার্যকরী একটি পদ্ধতি বের করতে হবে। সেটি আজ অবধি হয়নি। তাই বেসরকারি শিক্ষকরা ‘এমপিও নামক’ একটি ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন যার স্থায়ী সমাধান স্বাধীনতরার ৫৩ বছরেও হয়নি। তখন থেকে তাদের আন্দোলন চলছে।
এরই অংশ হিসেবে ১৮ মে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষক-কর্মচারীরা মাধ্যমিক ও উচচশিক্ষা অধিদপ্তর ঘেরাও করেন। তাদের দাবি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মাধ্যমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের ঘোষণা দিতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান বৈষম্য দূর করে একটি সমতাভিত্তিক কাঠামে নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া আর্থিক সুবিধার ক্ষেত্রে সব ধরনের বৈষম্য দূর করে প্রয়োজনীয় প্রজ্ঞাপন জারির দাবি জানানো হয়।
গত ২০ মে আন্দোলনরত শিক্ষকদেরকে সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ডাকা হয়। সেখানে শিক্ষা উপদেষ্টা ও সচিব না থাকায় অতিরিক্ত সচিব হুমায়ন কবিরের সঙ্গে তাদের বৈঠক হয়। তারা জানান, শতভাগ উৎসব ভাতার প্রজ্ঞাপন এবং বাড়িভাড়া ও চিকিৎসাভাতা বৃদ্ধির ব্যাপারে স্পষ্ট ঘোষণা দেয়া হলে তারা আন্দোলন ছেড়ে চলে যাবেন।
কিন্তু এ সময় হুমায়ন কবির তাদের জানান, যথাসময়ে ব্রিফ করা হবে। তিনি শিক্ষকদের আন্দোলন না করার আহ্বান জানান। শিক্ষকরা এ আশ্বাসে রাজি না হয়ে আন্দোলন চালানোর ঘোষণা দেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মবিরতি চালানোরও ঘোষণা দেন।
গত ২১ মে জাতীয়করণের দাবিতে লং মার্চে অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষকরা রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে জড়ো হতে থাকেন। কর্মসূচির শুরু হওয়ার আগে মঞ্চে বক্তব্য দিচ্ছিলেন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যক্ষ শেখ কাওছার। তবে সকাল সাড়ে দশটার দিকে শিক্ষকদের একটি অংশ শ্লোগান দিতে শুরু করেন ‘আওয়ামী লীগের দোসররা হুঁশিয়ার সাবধান’।
এক পর্যাযে তারা অধ্যক্ষ কাওছারের ওপর হামলা চালান। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে অধ্যক্ষকে পুলিশ হেফজতে নেয়া হয়। শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আহমদকে আটক নাকি হেফাজতে নেয়া হয়েছে তা পুলিশ জানাতে পারেনি।
ঝামেলা হয়েছে বলে পুলিশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে একজনকে থানায় নিয়ে গেছে। বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অপর একটি সংগঠনের সদস্যরা হামলা চালিয়ে কর্মসূচি পণ্ড করে দিয়েছে। শিক্ষকদের মধ্যে এ ধরনের দলাদলি একদিকে যেমন তাদের দাবি দাওয়া আদায়ের পথে বিঘ্ন করে অন্যদিকে এটি একটি জঘন্য উদাহরণ। তারা নিজেরাই যদি এভাবে মারামারি করেন তাহলে তারা শিক্ষার্থীদের কি শিক্ষা দেবেন? শিক্ষার্থী তথা জাতির সামনে এ কেমন উদাহরণ সৃষ্টি করা হলো?
শিক্ষকরা বলেন, ‘আমরা গত চার দিন ধরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছি। কিন্ত কোনো আশ্বাস না পেয়ে সচিবালয় অভিমুখে লং মার্চের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ কর্মসূচি বাতিল করতেই এই হামলা। এ ধরনের হামলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। শিক্ষকরা সেখানে কোনো দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে হাজির হননি। সবার দাবি ছিলো পেশাগত।
সেখানে হামলার শিকার হওয়া দুঃখজনক। শিক্ষকদের মধ্যে মতাদর্শ ও মতানৈক্য থাকবে, কিন্ত তাই বলে সেটির প্রকাশ এভাবে ঘটবে? একজন শিক্ষক অন্য একজন শিক্ষকের গায়ে কীভাবে হাত দেন এটি আমরা বুঝতে পারি না। আমরা এ ধরনের ঘটনায় ব্যথিত ও দুঃখিত। আমরা চাই, শিক্ষকরা তাদের প্রাপ্য রাষ্ট্র থেকে যাতে সঠিকভাবে পেয়ে যান, আমরা চাই তারা যাতে জাতীর মহান কার্যে নিজেদের সঠিকভাবে নিয়োজিত করতে পারেন কিন্তু তারা যাতে কোনোভাবেই এ অগ্রহণযোগ্য এবং দুঃখজনক উদাহরণ সৃষ্টি না করেন। শিক্ষকদের দাবি গোটা শিক্ষক সমাজের দাবি, শিক্ষকদের দাবি পুরো শিক্ষাব্যবস্থার দাবি। এখানে ব্যক্তিগত কারোর মতামত কিংবা আদর্শ যাতে বেসরকারি শিক্ষকদের মহৎ লক্ষ্য অর্জনে বাধাগ্রস্ত না হয় সেজন্য সব পক্ষকে ধৈর্য ধারণের অনুরোধ করছি।
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক