ঢাকা রোববার, ২৫ মে ২০২৫ , ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

যুগের চাহিদা শিক্ষা টিভি

মতামত

আশেকুল হক

প্রকাশিত: ০৭:৩০, ২৫ মে ২০২৫

সর্বশেষ

যুগের চাহিদা শিক্ষা টিভি

অনেকেই শিক্ষা টিভি বলতে এমন একটি চ্যানেলকে কল্পনা করেন যেখানে শ্রেণিকার্যক্রমের ন্যায় পাঠদান প্রচার করা হবে। অন্তত কোভিড-১৯ এর আক্রমণকালে ‘সংসদ টেলিভিশন’এ প্রচারিত পাঠদান কার্যক্রম থেকে এমনটি মনে হওয়াই স্বাভাবিক।

মনে রাখা যেতে পারে তখন এমন একটি ভিন্ন ও বিরূপ পরিস্থিতি ছিলো যখন কারিকুলাম অনুযায়ী সিলেবাস শেষ করে শিক্ষার্থীকে মূল্যায়নের জন্য প্রস্তুত করাই ছিলো মূখ্য। কিন্তু ভবিষ্যৎ শিক্ষা টিভির কাম্য মূখ্য উদ্দেশ্য কোনোভাবেই এমনটি হবে না। টেলিভিশনের গতানুগতিক ধারার বাইরে এসে শিক্ষা টিভিকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) এর আগামী সময়ে পাঠদানের জন্য আদৌ কোনো শ্রেণিকক্ষ বা প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো থাকবে কি না যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে এখনই শহুরে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই অপেক্ষা ইন্টারনেট, গুগল, চ্যাটজিপিটি, ইউটিউব, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। কিন্তু এসব মাধ্যম থেকে তারা যা শিখছে তা আদৌ সঠিক তথ্যনির্ভর কিংবা মানসম্মত কিনা তা যাচাই করতে পারছে না।

শিক্ষা টিভি হবে এমন একটি টিভি চ্যানেল যেখানে প্রাথমিক পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সব ধারার সঠিক তথ্যনির্ভর, ভেরিফায়েড ও মানসম্মত শিক্ষামূলক কনটেন্ট থাকবে। শুধু তাই না এখানে প্রযুক্তি, কর্মমুখী শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা, পেশা উপযোগী প্রশিক্ষণ ও বৈশ্বিক পরিবর্তিত চাহিদাভিত্তিক দক্ষ জনশক্তি তৈরির কনটেন্ট সম্প্রচার করতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও রেমিটেন্স যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণেও এ চ্যানেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

তা ছাড়া দেশে বিদেশে উচ্চশিক্ষা, উচ্চতর গবেষণা, জার্নাল, প্রকাশনা ইত্যাদি সম্পর্কে এখানে তথ্য ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক কনটেন্ট রাখা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সংস্কৃতি বিনিময় এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার অধিক্ষেত্র হিসেবেও শিক্ষা টিভি ভূমিকা রাখতে পারে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এ যুগে পৃথিবীতে দ্রুত পেশার পরিবর্তন হচ্ছে, বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

ধারণা করা হয় আগামী কয়েক দশকে এমন সব পেশার আবির্ভাব পৃথিবীতে ঘটতে পারে যেগুলো সম্পর্কে এখনো অনুমান করা যায় না। তরুণ প্রজন্মকে পরিবর্তিত এসব পেশার সাথে পরিচিতি ও কাঠামোবদ্ধভাবে প্রস্তুত করার জন্য শিক্ষা টিভি একটি কমন প্ল্যাটফরম হতে পারে। তবে এখনই এটিকে শ্রেণিকার্যক্রমের বিকল্প হিসেবে প্রতিস্থাপনের সুযোগ নেই।

দেশের অধিকাংশ শ্রেণিপেশার মানুষ এখন বাস্তব জগতের তুলনায় ভার্চ্যুয়াল জগতে বিচরণ করতে বেশি পছন্দ করে। তাই শিক্ষা টিভিকে একটি বিশ্বস্ত ও গ্রহণযোগ্য শিক্ষাউপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে ভার্চ্যুয়াল প্ল্যাটফর্মে শিক্ষা দেয়া সহজতর হবে। স্বাভাবিকভাবেই একটি পাঠ্য বই-এ শিখন উপযোগী সব বিষয় বিস্তারিত বিবরণ ও উপমাসহ উপস্থাপন করা সম্ভব হয় না।

শিক্ষা টিভি এ অসম্পূর্ণতাকে বহুলাংশে হ্রাস করতে পারে। সিলেবাসের গণ্ডিতে আটকে রেখে শিখন ফল অর্জনে শুধুমাত্র লেকচার পদ্ধতি নির্ভর শিক্ষা টিভি অংশীজনদের মনোযোগ আকর্ষণে ব্যর্থ হবে। কার্টুন, নাটক, সিনেমা, গান, কুইজ, সংবাদ, রিয়েলিটি শো, ডকুমেন্টারি, ভ্রমণ ব্লগ, বিতর্ক, আবৃত্তি, ধারাবাহিক গল্পবলা, উপস্থিত বক্তৃতা, অভিনয় এবং অনুরূপ বিভিন্ন মাধ্যমকে ব্যবহার করে শিখন ফল অর্জনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কনটেন্টগুলো অবশ্যই সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত সংবলিত, আকর্ষণীয় ও মানসম্মত, যুগোপযোগী ও নির্ভরযোগ্য হতে হবে। তাহলেই কেবল অংশীজনরা এগুলো দেখার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করবে।

দেশে প্রাথমিক পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার, যার মধ্যে প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার প্রাথমিক পর্যায়ের। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার ধরন, মালিকানা, মান, মাধ্যম, পরিচালনা পদ্ধতি ও কারিকুলামেও ভিন্নতা আছে। আবার অবস্থানগত কারণেও প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন ধারার এ শিক্ষাব্যবস্থাকে একমুখী করার অনেক চেষ্টা ইতোমধ্যে যুক্তিসংগত কারণেই সফল হয়নি।

আবার কেউ কেউ মনে করছেন শিক্ষার্থীরা যেখানে বিনোদনমূলক টিভিই দেখছে না, সেখানে তাকে টেলিভিশনের পর্দায় কীভাবে আটকে রাখা সম্ভব। বাস্তবতা হচ্ছে আমরা শিক্ষার্থীদের কাছে মানসম্মত শিক্ষা উপকরণই দিতে পারিনি, শিক্ষা টিভি তো অনেক দূরের বিষয়। শিক্ষার্থীদের জন্য এমন একটি প্ল্যাটফর্ম অত্যাবশ্যক, যা একজন শিক্ষার্থীর বহুমুখী চাহিদা পূরণে সক্ষম। আর এ বাস্তবতার প্রেক্ষাপটেই শিক্ষাবিষয়ক একটি টেলিভিশন চ্যানেলের গুরুত্ব প্রতিভাত হয়।

বর্তমান সময়ে দেশে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রাচুর্য থাকলেও সরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বলতে প্রধানত বিটিভি বা বাংলাদেশ টেলিভিশনকে বোঝায়। পাকিস্তান টিভি করপোরেশনের একটি অংশ হিসেবে ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে এটি চালু হয়।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের মোট দুটি কেন্দ্র (ঢাকা, চট্টগ্রাম) এবং ১৪টি উপকেন্দ্র রয়েছে। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘বিটিভি ওয়ার্ল্ড’ (বর্তমানে ‘বিটিভি নিউজ’), ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ‘বিটিভি চট্টগ্রাম’ ও ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে ‘সংসদ টেলিভিশন’ সম্প্রচার শুরু করে। এ চ্যানেলগুলো বিটিভির সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে অঙ্গসংগঠন হিসেবে পরিচালিত হয়। আবার ৪৫টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল অনুমোদন পেলেও বর্তমানে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে ৩৫টি চ্যানেল।

এদের মধ্যে বিশেষায়িত চ্যানেলের সংখ্যা একেবারে হাতেগোনা। সংবাদ ও বিনোদনভিত্তিক যে ক’টি বিশেষায়িত চ্যানেল রয়েছে তাদের অধিকাংশের মানও দর্শকনন্দিত নয়। বিদ্যমান অবস্থায় একটি কাম্যমানের শিক্ষাভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল এখন শিক্ষক শিক্ষার্থী ও শিক্ষাচিন্তকদের কাছে যুগের চাহিদা।

শিক্ষা টিভিতে সরাসরি এবং ধারণকৃত কনটেন্ট সম্প্রচারের পাশাপশি অ্যাপের মাধ্যমে এগুলো সংরক্ষণ করে সুবিধাজনক সময়ে দেখার ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ অ্যাপে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ লিংক, পরিসংখ্যান, প্রচারণা অর্ন্তভুক্ত রাখা যায়।

রাষ্ট্রের জরুরি আপৎকালীন শিক্ষা প্রদান, শিক্ষা সংক্রান্ত জরিপ, বিশেষ কোনো শিক্ষাপদ্ধতি প্রবর্তনের জন্যও এ টিভিকে ব্যবহার করা যায়। সরকারি একক কোনো সংস্থার পক্ষে এটি যথাযথ বাস্তবায়ন ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলে একাধিক মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা সংস্থার যৌথ উদ্যোগে অথবা বেসরকারিভাবে অথবা ‘পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপ’ (পিপিপি)র মাধ্যমেও এটি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

পৃথিবীর উন্নত, অনুন্নত, উন্নয়নশীল বহু দেশেই শিক্ষা টিভির প্রচলন রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, চিলি, কোরিয়া, ভারত, পাকিস্তান, মরক্কো বিভিন্ন দেশে এক বা একাধিক জাতীয় কিংবা স্থানীয় শিক্ষামূলক টিভি চ্যানেল বা টিভি প্রোগ্রাম রয়েছে। বাংলাদেশে শিক্ষা টিভি চালুর ক্ষেত্রে এসব দেশের অভিজ্ঞতা বিবেচনা করা যায়, অনুকরণ নয়। কারণ, ওইসব দেশ তাদের নিজস্ব সম্পদ ও সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠান সম্প্রপ্রচার করছে। অতীতেও বিদেশি শিক্ষাব্যবস্থার অনুকরণ ও বাস্তবায়ন বাংলাদেশে সুখকর হয়নি। একটি মৌলিক শিক্ষাভিত্তিক টিভি দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন যুগের সুচনা করতে পারে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, কবি ও কলাম লেখক

 

জনপ্রিয়