
ছাত্র-জনতার অভুত্থানে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নানা দাবিতে আন্দোলনে নামেন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। নিয়মের বেড়াজালে যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি-দাওয়া তোলারও সাহস পাননি এতদিন, তারাও কথায় কথায় আন্দোলনে নামছেন। কর্তৃপক্ষের চাপিয়ে দেওয়া একপাক্ষিক সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ হয়ে তারা কখনো ছুটছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি), আবার কেউ কেউ সচিবালয়ের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ-সমাবেশ করছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বেশকিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি, স্থায়ী ক্যাম্পাস, শ্রেণিকক্ষ সংকট, নিজস্ব পরিবহন সুবিধাসহ নানা দাবিতে আন্দোলন করতে দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের। তাদের আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের মতো ঘটনাও ঘটেছে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নানা অনিয়মের মধ্য দিয়ে চলছে। নেই নিজস্ব স্থায়ী ক্যাম্পাস। যার ফলে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বারবার বলার পরও কর্তৃপক্ষ আমাদের কথা শুনছে না। তাই বাধ্য হয়ে আন্দোলনে নামতে হচ্ছে।
কষ্টার্জিত অর্থে সন্তানকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানো অভিভাবকরা বলছেন, আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সেশনজট বাড়ছে। এতে খরচের পাল্লা ভারী হচ্ছে। পাশাপাশি সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা।
এ জন্য শিক্ষাবিদরা দায়ী করছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি)। তাদের মতে, গণঅভ্যুত্থানের পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দখলদারমুক্ত করতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষার নামে বাণিজ্য চলছে, তাতে লাগাম টানতে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপও নেই। অযাচিত নিয়ন্ত্রণে সেখানে শিক্ষার্থীদের ‘দমবন্ধ’ হওয়ার দশা। অভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে শিক্ষার্থীরা সাহসী হয়ে উঠেছেন। এখন তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে দখল-নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলনের পথে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছেন।
তদারক সংস্থা ইউজিসির তথ্যমতে, দেশে এখন অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৬টি। অবশ্য এরমধ্যে কয়েকটিতে এখনো শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়নি। আরও কয়েকটিতে স্থগিত রয়েছে। দেশে সবশেষ অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয় ‘গ্রামীণ ইউনিভার্সিটি’।
৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তত দুই ডজন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে দাবি-দাওয়া আদায়ে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। চলতি বছরের শুরুর দিক থেকে এ আন্দোলনের প্রবণতা বেড়েছে। ক্রমেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। সামনে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ইউআইইউ বন্ধ
শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবির আন্দোলন এড়াতে গত ২৬ এপ্রিল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ)। এতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। অতি মুনাফামুখী এই বেসরকারি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমন অনিদির্ষ্টতায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরাও কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা নিয়ে সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছেন। তাই দ্রুত বিশ্ববিদ্যায় খুলে দিয়ে যথাযথ উপায়ে অমীমাংসিত বিষয়গুলো সমাধানের আশা করছেন তারা।
সাত দাবিতে আন্দোলনে বিইউএফটি শিক্ষার্থীরা
অতিরিক্ত চার্জ বাতিল, খাবারের মান উন্নত করা, ছাত্রীদের হোস্টেলের সমস্যার সমাধানসহ সাত দফা দাবিতে গত সপ্তাহে আন্দোলনে নেমেছেন বেসরকারি বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউএফটি) শিক্ষার্থীরা। গত ২৬ এপ্রিল থেকে তারা কয়েক দফা বিক্ষোভ করেছেন। এরপর দাবি-দাওয়া আদায়ে এক সপ্তাহের আলটিমেটাম দিয়েছেন। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে দাবি না মানলে কঠোর কর্মসূচিতে নামার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
বিইউএফটি শিক্ষার্থীরা জানান, ৫ আগস্টের পরও তাদের বিশ্ববিদ্যালয় একটি গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি। তারা শিক্ষার্থীদের ওপর অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে ব্যস্ত। শিক্ষার্থীদের কল্যাণে তারা কাজ করছেন না। এজন্য সাত দফা দাবি নিয়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছেন। তারা শুধু মৌখিক আশ্বাসে ক্লাসে ফিরবেন না। দাবি বাস্তবায়নের রূপরেখা লিখিতভাবে ঘোষণা করতে হবে। খোলা মাঠে আলোচনার মাধ্যমে সেই রূপরেখা ঠিক করতে হবে।
প্রাইম এশিয়ার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে
টানা এক সপ্তাহ আন্দোলন করেন প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। স্থায়ী ক্যাম্পাস, ট্রাস্টি বোর্ড চেয়ারম্যানের পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন, ইউজিসি অভিমুখে লং মার্চসহ বিভিন্ন কর্মসূচির পর ৭ জানুয়ারি সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। সে সময় পুলিশ তাদের ওপর লাঠিপেটা করে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হন। তাদের সেই দাবি-দাওয়া পূরণ হয়নি। ফলে এখনো ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। যেকোনো সময় আবার তারা আন্দোলনে নামতে পারেন বলে জানিয়েছেন।
এর আগে গত বছরের ২১ ডিসেম্বর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. শুভময় দত্ত পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পদত্যাগপত্রে উপাচার্য উল্লেখ করেন, ‘শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি নিলাম।’
স্টামফোর্ডেও অস্থিরতা
বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা কয়েক দিন ধরে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টির পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করেন। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে তারা দাবি তোলেন। এর পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ আগস্ট বোর্ড অব ট্রাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ফাতিনাজ ফিরোজ পদত্যাগ করেন। এ কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। যদিও পরে স্বপদে বহাল হন ফাতিনাজ ফিরোজ। দ্রুত খুলে দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ও।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, পদত্যাগের নাটক এবং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে আন্দোলন দমিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বিষয়টির স্থায়ী সমাধান হয়নি। এ নিয়ে তারা আবারও কর্মসূচি দেবেন।
আইআইইউসিতে শিক্ষার্থী অসন্তোষ
চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (আইআইইউসি) কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের দোসরদের পুনর্বাসনের অভিযোগ উঠে। এছাড়া শ্রেণিকক্ষ সংকট, পরিবহন ও ক্যাফেটেরিয়ার সমস্যা সমাধান এবং জুলাই আন্দোলন চলাকালীন হামলায় অংশ নেওয়া ছাত্রদের বিচারসহ ১৩ দফা দাবিতে গত ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা।[inside-ad-1]
তখন তারা জানান, জুলাই অভ্যুত্থানের পর ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১১ আগস্ট ক্যাম্পাস খোলার প্রথম দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নতুন প্রশাসনের কাছে ১৩ দফা দাবি তুলে ধরেন। কিন্তু তাদের একটি দাবিও পূরণ করা হয়নি।
এ নিয়ে কয়েক দফা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। দাবি-দাওয়া পূরণে অগ্রগতি না হলে আবার আন্দোলনের নামার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। প্রয়োজনে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করবেন শিক্ষার্থীরা।
ইউল্যাবেও বাড়ছে ক্ষোভ
পাঁচ দফা দাবিতে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি আন্দোলনে নামেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) শিক্ষার্থীরা। টানা তিনদিন আন্দোলনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আব্দুল হান্নান মাসউদের মধ্যস্থতায় ছয়টি শর্তে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন স্থগিত করেন। কিন্তু অধিকাংশ দাবিই পুরণ হয়নি অদ্যাবধি, এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।
তারা জানান, সেসময় তাদের আশ্বাস দিয়ে আন্দোলন নস্যাৎ করা হয়েছে। প্রশাসন, ট্রাস্টি বোর্ড কোথাও কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। যারা জুলাই আন্দোলনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন, তারাও চেয়ারে বহাল। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। যেকোনো সময় তারা ফের কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলনে নামবেন।
প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়েও আন্দোলনের ঢেউ
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে চলতি বছরের ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন চট্টগ্রামের বেসরকারি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ। প্রায় চার মাস উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যশূন্য থাকার পর গত ১৬ এপ্রিল নতুন উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে সেখানে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় নানামুখী সমস্যা বিদ্যমান। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে।
আশ্বাসেও অসন্তোষ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে
উপাচার্যের পদত্যাগ, প্রক্টরিয়াল বডি পুনর্গঠনসহ ১৪ দফা দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। পরে উপাচার্য পদত্যাগ করলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। তবে নিজস্ব পরিবহন চালুসহ শিক্ষার্থীদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট অনেক দাবি উপেক্ষিত। এ নিয়ে শিক্ষার্থীরা পুনরায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছেন সে সময় আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা।
এসব অস্থিরতার বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করা হলে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা ও অচলাবস্থা সৃষ্টির নেপথ্যের কারণ চিহ্নিত করা হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইনের নানা ফাঁক-ফোকর দিয়ে ট্রাস্টি বোর্ড নিজেদের দখলে রাখেন অনেকে। বাবা অথবা মা চেয়ারম্যান; তো মেয়ে কিংবা ছেলে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। তাদের অবর্তমানে অলিখিত চেয়ারম্যান হয়ে ওঠেন ওই সন্তানরা। জিম্মিদশা যে আছে, এটা অস্বীকার করার সুযোগ তো নেই। অতিরিক্ত ফি আদায় নিয়েও অনেক অভিযোগ আসে আমাদের কাছে। কিন্তু আমরা আইনের বাইরে গিয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ করতেও চাই না। আইনের মধ্যে থেকে কী কী করা যায়, সেটা অবশ্যই করবো। আর যেগুলো আমাদের এখতিয়ার-বর্হিভূত, সেগুলো করতে সরকারকে পরামর্শ দেবো।