
উন্নয়ন ও একাডেমিক কাজে অনিয়মের কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদ শিরোনাম হওয়া নতুন কিছু নয়। কিন্তু, দেশের দুই সহস্রাধিক সরকারি-বেসরকারি কলেজের দায়িত্বে থাকা এই উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ অসাধু কর্তাদের স্বেচ্চাচারীতায় পুরোপুরি লাগাম পরানো সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) অধীন শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আরো কিছু অনিয়ম ও আর্থিক ক্ষতির কথা বলা হয়েছে।
এগুলোর মধ্যে তিনটি ভবন নির্মাণে অনিয়ম পেয়েছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর। ১৬০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে এসব ভবন নির্মাণে কোনো প্রকল্প করা হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্রও নেওয়া হয়নি। খরচ করা হয়েছে কর্তৃপক্ষের ‘ইচ্ছেমতো’। নিরীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, সব মিলিয়ে দুই অর্থবছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০টি অনিয়মে সরকারের আর্থিক ক্ষতি ৩৮৩ কোটি ৫০ লাখ টাকারও বেশি।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব সম্পর্কিত ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরের এই অডিট ইন্সপেকশন রিপোর্ট সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পাঠানো হয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে ২০২২-২৩ অর্থবছরে। নির্মাণে অনিয়ম পাওয়া ভবনগুলো হলো- সিনেট অ্যান্ড আইসিটি ভবন, ডরমিটরি ভবন, স্টাফ কোয়ার্টার অ্যান্ড অফিসার্স কোয়ার্টার ভবন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বলেছে, সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়ম অনুযায়ী অডিট আপত্তির জবাব দেবে। এরপর বিধি অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত কোনো প্রতিষ্ঠানে ভবন বা বড় আকারের নির্মাণকাজ করতে হলে তা উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হয়। প্রকল্পের ছাড়পত্র নিতে হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিনেট অ্যান্ড আইসিটি ভবন, ডরমিটরি ভবন, স্টাফ কোয়ার্টার অ্যান্ড অফিসার্স কোয়ার্টার ভবন নির্মাণে এ নিয়ম মানেনি। অর্থাৎ উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) করা হয়নি এবং অর্থ বিভাগের ছাড়পত্রও নেওয়া হয়নি। এই তিন ভবন নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে ১৬০ কোটি ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৪৫৮ টাকা। নিরীক্ষার সময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অসহযোগিতা করেছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিজস্ব প্রকৌশল বিভাগ থাকলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তার তিনটি আঞ্চলিক কার্যালয় স্থাপনের কাজ দেয় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরকে (ইইডি)। এতে খরচ হয়েছে ৮০ কোটি ২৭ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরের পর্যাপ্ত সক্ষমতা না থাকলে দপ্তরটির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন জাগে এবং নিজস্ব অর্থায়নে পূর্তকাজ পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করানোর কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় বহুগুণ বেড়েছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ৩০ কোটি টাকার বেশি পূর্তকাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কমিটি এবং ৫০ কোটি টাকার বেশি কাজের জন্য মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মন্ত্রিপরিষদ কমিটি ও প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই বিভিন্ন ভবন নির্মাণ করেছে। এতে মোট ব্যয় হয়েছে ১০১ কোটি ৪৯ লাখ ৪৭ হাজার ৭৯০ টাকা।
বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা ছাড়াই বিভিন্ন পণ্য ও সংশ্লিষ্ট সেবার জন্য ৩ কোটি ৩৭ লাখ ২৮ হাজার ৭২৮ টাকা অনিয়মিতভাবে খরচ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এর বাইরে ৭ কোটি টাকার পূর্তকাজের দলিলাদি এবং অগ্রগতি প্রতিবেদন নিরীক্ষায় উপস্থাপন করা হয়নি।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, ভ্যাট ও রাজস্ব টিকিট বাবদ অর্থ আদায় না করায় ৫৪ লাখ ৯ হাজার ৭৪ টাকা সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এসব অর্থ আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করেছে নিরীক্ষা দল।
এ ছাড়া পণ্য ও সংশ্লিষ্ট সেবা কেনায় সরকারি বিধি মানা হয়নি বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, পছন্দের ঠিকাদারকে সরাসরি ক্রয়সীমার বেশি কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। এতে অনিয়মিতভাবে ব্যয় হয়েছে ৪৪ কোটি ৬৬ হাজার ৪৬ টাকা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দেনাদারদের কাছে পাবে ৩০ কোটি ৩১ লাখ ৭৩ হাজার ৫২১ টাকা। এই টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দেওয়ার সুপারিশ করেছে নিরীক্ষা দল।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৯২ অনুযায়ী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে রেগুলেশনের মাধ্যমে বিধি প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নিরীক্ষার সময় দেখা গেছে, রেগুলেশন দিয়ে বিধি প্রণয়ন না করে অনিয়মিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে।
এদিকে গত ১৫ বছরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে সত্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। বেশ কিছু অডিট আপত্তিও তাঁদের নজরে এসেছে বলে জানিয়েছে দায়িত্বশীল সূত্র। এগুলো যাচাই- বাছাই করে পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় মূলত কলেজগুলোর উচ্চশিক্ষা দেখভাল করে। এর কার্যক্রম অনেকটা শিক্ষা বোর্ডের মতো। মূল কাজ অধিভুক্ত কলেজগুলোর পরীক্ষা নেওয়া। এর অধিভুক্ত কলেজগুলোতে শিক্ষার্থী রয়েছেন ২৯ লাখের বেশি। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (পাস), স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ডিগ্রি দেওয়া হয়। আছে পেশাগত কোর্সও।
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।