ঢাকা মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪ , ২৯ আশ্বিন ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

শিক্ষা সনদ ও পরিচয়পত্রে নাম ভুল প্রসঙ্গে

মতামত

মো. রহমত উল্লাহ্

প্রকাশিত: ০০:২০, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩

সর্বশেষ

শিক্ষা সনদ ও পরিচয়পত্রে নাম ভুল প্রসঙ্গে

জন্ম নিবন্ধনের সময় শিশুর নিজের নাম, পিতার নাম ও মাতার নাম লিখতে হয়। নিবন্ধন সনদে লিখিত এই তিনটি নামই শিশুর পারিবারিক পরিচিতির বাহন। পরবর্তীকালে এই নামেই তৈরি হয় তার জীবনের সকল সনদ। তাই এই তিনটি নাম ও নামের বানান সঠিক হওয়া অত্যন্ত জরুরি। কেনোনা, এই নিবন্ধন সনদ অনুসারেই শিশুদের নিজের নাম, পিতার নাম ও মাতার নাম লেখা হয় তার স্কুলের খাতায়। এই নামেই তৈরি হয় তার দেশে-বিদেশে সকল পরীক্ষা পাসের, প্রশিক্ষণ লাভের ও কৃতিত্ব অর্জনের সনদ। এই নামেই তৈরি হয় জাতীয় পরিচয়পত্র, নিয়োজিত হন কর্মে, আবদ্ধ হন বিবাহ বন্ধনে, অর্জন করেন সম্পত্তির মালিকানা, গ্রহণ করেন সরকারি সুযোগ-সুবিধা, প্রয়োজনে পাড়ি জমান বিদেশে। ভবিষ্যতে তার সন্তানের পরিচয়ের জন্যও ব্যবহৃত হয় এই নাম। অর্থাৎ জন্ম নিবন্ধন সনদে কারো নাম ভুল থাকলে এর জন্য দীর্ঘ ভোগান্তিতে পড়তে হয় নিজেকে ও তার উত্তরাধিকারদের।
আমাদের দেশে বর্তমানে জন্ম নিবন্ধন সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্রে যে ধরনের ভুল বেশি পরিলক্ষিত হয়ে থাকে সেগুলো হচ্ছে প্রচলিত ভুল। যেমন-প্রায় সব শিশুর, শিশুর পিতার ও মাতার নামের আগেই ‘মোহাম্মদ’কে ‘মোঃ/মো:’ বা ‘মোহাঃ/মো:’, ‘মুহাম্মদ’কে ‘মুঃ’ বা ‘মুহাঃ’, ‘মোসাম্মৎ’কে ‘মোসাঃ’ ইত্যাদি লেখা হয়। এভাবে বিসর্গ (ঃ)/ কোলন (:) দিয়ে শব্দ সংক্ষেপ সঠিক নয়। বিসর্গ যতিচিহ্ন নয়, বর্ণ। বিসর্গের (ঃ) আছে উচ্চারণ ধ্বনি। আছে সঠিক ব্যবহারের নিয়মকানুন। 

অথচ আমরা অনেকেই না জেনে, না বুঝে এই বিসর্গ (ঃ) ধ্বনিকে ব্যবহার করছি যতিচিহ্ন হিসেবে। শব্দ সংক্ষেপ করার জন্য ব্যবহার করতে হবে যতিচিহ্ন। কোলন (:) যতিচিহ্ন। তবে এটি সংক্ষিপ্তকরণ চিহ্ন নয়। একমাত্র দাঁড়ি (।) ব্যতীত অন্যান্য যতিচিহ্ন আমরা ব্যবহার করছি ইংরেজি ভাষার রীতি অনুসারে। সে মতে শব্দ সংক্ষেপ করার জন্য ব্যবহৃত হবে ডট (.)। বাংলায় আমরা এর নাম দিয়েছি একবিন্দু (.) বা শব্দ সংক্ষেপণ চিহ্ন। তাই উল্লিখিত শব্দগুলো সংক্ষেপে লিখতে চাইলে ‘মোহাম্মদ’কে ‘মো.’ বা ‘মোহা.’, ‘মুহাম্মদ’কে ‘মু.’ বা ‘মুহা.’, ‘মোসাম্মৎ’কে ‘মোসা.’ এভাবে লিখতে হবে। তবে এভাবে সংক্ষিপ্ত না লিখে প্রতিটি নামের অন্তর্গত সব শব্দের পূর্ণরূপ লেখাই উত্তম।
এ ছাড়া, অনেক শিশুর জন্ম নিবন্ধন সনদে তার পিতার ও মাতার (জাতীয় পরিচয়পত্রেও) নামের আগে/পরে মৃত, হাজি, আলহাজ, ডক্টর, ডাক্তার, মাওলানা, মৌলভি, পণ্ডিত, অ্যাডভোকেট, অধ্যক্ষ/অধ্যক্ষা, আধ্যাপক/অধ্যাপিকা, বিএ, এমএ, বিএসসি, এমএসসি ইত্যাদি লেখা হয়। যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অশুদ্ধ। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সচেতন করার জন্য আমি আগেও লেখালেখি করেছি। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সনদে এসব অবাঞ্ছিত শব্দ লেখা নিষিদ্ধ করে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড ঢাকা-এর বিদ্যালয় পরিদর্শক গত ১৪ জানুয়ারি আদেশ জারি করেছেন। তা ছাড়া অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের অনলাইন রেজিস্ট্রেশন এর জন্য শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক জারিকৃত বিজ্ঞপ্তিতে বার বার বলা হয়,  ‘শিক্ষার্থীর নামের পূর্বে মিস্টার, মিসেস, মিস, শ্রী, শ্রীমতি ইত্যাদি ধরনের শব্দ ব্যবহার করা যাবে না।’ ঢাকা শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক গত ২৮ আগস্ট জারিকৃত বিজ্ঞপ্তিতেও এ কথা বলা হয়েছে। 

উল্লিখিত অযৌক্তিক ও অশুদ্ধ শব্দ/চিহ্ন শিক্ষার্থীর এবং তার পিতা-মাতার নামের সঙ্গে যুক্ত করার প্রবণতা আগের তুলনায় কমলেও কিছু কিছু জন্ম নিবন্ধন সনদে বা জাতীয় পরিচয়পত্রে তা এখনো লক্ষ্য করা যায়। তাই শিক্ষাবোর্ডের আদেশ অনুসারে সেসব শিক্ষার্থীর নাম রেজিস্ট্রেশন করতে গেলে জন্ম নিবন্ধন সনদ অনুসারে গরমিল দেখা দেয়। অথচ অভিভাবকরা তাদের শিশুর জন্ম নিবন্ধন সনদ ও তাদের জাতীয় পরিচয় পত্র অনুসারেই নাম রেজিস্ট্রেশন করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে থাকেন। ফলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে বিপত্তিতে পড়তে হয়। অভিভাবকরা এ দু’টি সনদ সংশোধন করতে চান না। তারা বুঝতে চান না যে, ‘মৃত/ হাজি/ ডাক্তার/ পণ্ডিত’, ‘স্মর্গীয়/ শ্রী/ শ্রী শ্রী/ শ্রীযুক্ত’ ইত্যাদি তাদের নামের অংশ নয়। তিনি নিজে জন্ম গ্রহণের পর পর যে নাম রাখা হয়েছিল সেটিই তার নাম। তখন তিন ‘মৃত/ হাজি/ ডাক্তার/ পণ্ডিত’, ‘স্মর্গীয়/ শ্রী/ শ্রী শ্রী/ শ্রীযুক্ত’ ইত্যাদি ছিলেন না। সুতরাং এসব তার নামের অংশ হতে পারে না। অভিভাবক সংশোধনে সম্মত হতে বাধ্য হলেও সংশোধন কাজটি সংশ্লিষ্টদের সময়, শ্রম ও অর্থের অপচয় ঘটায়। 

বাস্তবতা হচ্ছে, জন্ম নিবন্ধন সনদ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে অজ্ঞ ও উদাসীন। এই কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ অফিস, ওয়ার্ড কাউন্সিল অফিস, পৌরসভা অফিস ও সিটি করপোরেশন অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের আলোচিত বিষয়ে আরো দক্ষ ও মনোযোগী হওয়া অত্যাবশ্যক। তাদেরকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এ সব ভুলের অধিকাংশ অটো সংশোধনের ক্ষেত্রে এবং সব নাগরিকের জন্ম নিবন্ধন সনদ একই রকম ডিজাইন, কালার ও ফন্টে প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো সফটওয়্যার প্রয়োগ করা যায় কিনা তাও গুরুত্ব সহকারে ভেবে দেখতে হবে। আবার দেখা যায়, বাংলায় ইস্যুকৃত জন্ম নিবন্ধন সনদে সব তথ্য বাংলায় লেখা থাকে এবং ইংরেজিতে ইস্যুকৃত জন্ম নিবন্ধন সনদে সব তথ্য ইংরেজিতে লেখা থাকে। এমনও দেখা যায় যে, বার্থ রেজিস্ট্রেশন রেকর্ড ভেরিফিকেশন ফর্মে একই শিক্ষার্থীর ও তার পিতা-মাতার নাম বাংলায় এক রকম এবং ইংরেজিতে অন্যরকম লেখা থাকে! আবার একই শিক্ষার্থীর ভিন্ন তথ্যসম্বলিত একাধিক জন্ম নিবন্ধন সনদও পাওয়া যায় কখনো কখনো। অপরদিকে জাতীয় পরিচয়পত্রে নিজের নাম বাংলায় ও ইংরেজিতে লেখা থাকলেও পিতা-মাতার নাম শুধুমাত্র বাংলায় লেখা থাকে। এ সব কারণেও শিক্ষার্থীদের নাম রেজিস্ট্রেশন করাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম সমস্যা তৈরি হয়। কেনোনা জাতীয় পরিচয় পত্রের বহুমুখী ব্যবহার বিদ্যমান। তাই একই জন্ম নিবন্ধন সনদে শিক্ষার্থীর ও তার পিতা-মাতার নাম ও অন্যান্য তথ্য বাংলা-ইংরেজি উভয় ভাষায় লেখা থাকা আবশ্যক এবং সকল নাগরিকের জাতীয় পরিচয়পত্রে নিজের নাম ও পিতা-মাতার নামসহ সব তথ্য বাংলা-ইংরেজি উভয় ভাষায় লেখা থাকা আবশ্যক। 

তা ছাড়া, কোনো শিক্ষক, ডাক্তার, অফিসার ও জনপ্রতিনিধি যখন কারো জন্ম নিবন্ধনের আবেদন ফরম ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রণয়নের আবেদন ফরম সত্যায়ন করেন; তখন তাদেরও আরো জেনে, বুঝে, সতর্ক হয়ে এই কাজটি করা উচিত। যাতে আলোচিত ভুলগুলো না থাকে। সংশ্লিষ্ট সবাই জেনে, বুঝে, সচেতন ও দায়িত্ববান হয়ে সমন্বিত পদক্ষেপ নিয়ে কাজ করলে সহজেই বেরিয়ে আসা সম্ভব এব ভুলের বেড়াজাল থেকে এবং তা এখনই করা অত্যন্ত জরুরি।

লেখক : অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা

জনপ্রিয়