ঢাকা মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর ২০২৪ , ৬ কার্তিক ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

আমার শিক্ষক বাবা

মতামত

মোস্তাফিজুর রহমান শামীম

প্রকাশিত: ২২:১৭, ৪ অক্টোবর ২০২৩

সর্বশেষ

আমার শিক্ষক বাবা

জীবনের ৩০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এখনো মনে হয় এইতো সেদিনের ঘটনা। যা আমার চোখের সামনে বারবার আসে। আমি কষ্ট পাই তবুও মাঝেমধ্যে সেই রাতের কথা স্মৃতিচারণ করি। হাই স্কুল শিক্ষক সেলিম উদ্দিন। দুই কন্যা ও এক পুত্র ও স্ত্রীসহ ৫ জনের সংসার। মেয়ে দুটি কলেজে ও ছেলে প্রাইমারি স্কুলে পড়ে। সন্তানদের ভালো স্কুল-কলেজে পড়ানোর জন্য গ্রাম ছেড়ে শহরে ভাড়া বাসায় থাকতেন। তখন হাইস্কুল শিক্ষকরা বেতন পেতেন দুই তিন মাস পর। প্রাইভেট টিউশনি করে কোনোমতে সংসার চলতো। বেতনের জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে হতো মাসের পর মাস। প্রিয় পাঠক, আপনারা ঠিকই ধরেছেন। তিনি আমার বাবা। আমি তার গর্বিত সন্তান। 

সেই সময়ে একদিন তিনি ২০ কিলোমিটার দূরে ব্যাংকে তার বেতন উত্তোলন করতে গেলেন। সকাল থেকে সারাদিন আমরা পথ চেয়ে বসে আছি। আব্বা কখন আসবেন? আজ আব্বা বেতন পাবেন, নিশ্চয় ভালো বাজার করে নিয়ে আসবেন। পরের দিন স্কুলের টিফিনের দুই টাকা খুব সহজেই নেয়া যাবে। নানা কল্পনার জাল বুনতে বুনতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো। সন্ধ্যা হলো। আব্বা আসছেন না!

আম্মা অনেক চিন্তিত, কোথায় গেলো, কী হলো! তখন মোবাইলে ফোনের যুগ ছিলো না। আশেপাশে হাতেগোনা সম্ভ্রান্ত ও বড়লোক পরিবারে টিএন্ডটি ল্যান্ডফোন ছিলো। সে সময় রাত ১০টা অনেক রাত মনে হতো। আম্মা দরজার সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে আব্বার জন্য অপেক্ষা করছেন আর দোয়া দরুদ পড়ছেন। আমরাও আম্মাকে চিন্তিত দেখে ঘুমোতে পারছি না। সবাই চুপচাপ বসে আছি। আমি তখন অনেক ছোট। ক্লাস ফাইভে পড়ি। রাত ১২টা বাজার পরও ঘুম আসে না। আব্বার জন্য আমিও খুব চিন্তিত ছিলাম। আমার বড় বোন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু সবার মনের মধ্যেই চিন্তা, ভয়, আতঙ্ক! আব্বার কী হলো! 

ঠিক এমন সময় আব্বা দরজার কড়া নাড়লেন। আমরা আব্বার গলার আওয়াজ শুনে সবাই লাফ দিয়ে দরজার সামনে গেলাম। সবাই কৌতূহলী দৃষ্টিতে আব্বার দিকে তাকিয়ে। চুপচাপ ও চেহারা মলিন। খুব ভারী গলায় কথা বলছেন। আম্মা রাগ করে বললেন, সারাদিন কোথায় ছিলে? আব্বার মুখে কোনো কথা নেই। আমরাও জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় ছিলেন আব্বা? আম্মা আব্বাকে বললেন, ছেলে-মেয়েরা সারাদিন অপেক্ষায় যে তুমি আজ ভালো বাজার করে আনবে। আর তুমি এখন খালি হাতে এলে? ঠিক আছে কাল সকালে বাজার করো। আব্বা কোনো কথা বলছেন না, তার দুচোখ বেয়ে পানি ঝরছে। আব্বার কান্না দেখে আমার বড় বোনও কিছু না বুঝেই কেঁদে ফেললেন। আব্বা অশ্রুসিক্ত হয়ে কাঁপা গলায় বললেন, ‘ব্যাংক থেকে বেতন উত্তোলন করে বাসে চড়ে বাসায় আসছিলাম। বেতনের সব টাকা পকেটমার হয়েছে। অনেক জায়গায় গিয়েছি কিন্তু শেষ পর্যন্ত টাকাটা উদ্ধার করতে পারিনি। রাতও হয়ে গিয়েছে কারো কাছ থেকে টাকা ধারও চাইতে পারিনি। সকাল হলে একটা ব্যবস্থা হবে নিশ্চয়।’

বাস থেকে নেমে যখন পকেটে হাত দিয়ে দেখেন তার টাকা নেই, তখন দিশেহারা হয়ে চারদিক ছোটাছুটি করেছেন, খুঁজে বেড়িয়েছেন পকেটমারকে। যেখান থেকে বাসে উঠেছেন, সেই জায়গাতে আবার ফিরে গেছেন। থানা-পুলিশ, নেতা, চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছেন। অবশেষে খালি হাতে বাড়ি ফিরেছেন। আব্বার চোখের পানির কষ্ট সেদিন বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারিনি টাকা হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট। বুঝতে পারিনি শিক্ষকদের কষ্ট।  আব্বা সেদিন চোখের পানি ফেলেছিলেন একমাত্র আমাদের জন্য। অনেকদিন ধরে তিনিও প্রতীক্ষায় ছিলেন বেতন পেয়ে আমাদের ভালো-মন্দ কিছু খাওয়াবেন। আমাদের কিছুটা সাধ পূরণ করবেন। আমাদের পোশাক-আশাক কিনে দেবেন। আব্বা কখনো তার নিজের পোশাকের দিকে তাকাতেন না, তার ব্যবহারের স্যান্ডেলটিতে এমন কোনো জায়গা ছিলো না, যেখানে সেলাই করতে বাকি আছে। আমি আব্বার পেশাই বেছে নিয়েছি। আব্বার ইচ্ছা ছিলো না আমি শিক্ষক হই। কারণ, চাননি তার মতো আমিও কষ্ট করি।
আব্বার চাকরির শেষের পাঁচ বছর আগে উচ্চতর বেতনের জন্য বিএজিএড করলেন। এরপরও তিনি তার উচ্চতর বেতন স্কেল বের করতে পারলেন না। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির অসহযোগিতামূলক আচরণ শুরু করলেন। সেই গ্যাঁড়াকলে পড়ে প্রধান শিক্ষকও ব্যর্থ হলেন। এমপিওভুক্ত চাকরি! নানা কায়দা-কানুন দেখিয়ে তারা আমার আব্বাকে বলেছিলেন, আপনাকে আবার নতুন করে এই স্কুলে কৃষি শিক্ষা বিষয়ে নিয়োগ নিতে হবে। উল্লেখ্য, আমার আব্বা একই স্কুলে বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন। তারা বিভিন্ন কায়দায় নিয়োগের ব্যবস্থা করে আমার আব্বার কাছ থেকে বেশ কিছু টাকা হাতিয়ে নিলেন। বাবা নিরুপায় হয়ে কয়েকটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে তাদের টাকা দিয়ে একই স্কুলে নতুন নিয়োগ নিলেন। নতুন স্কেল ধরাতে পারলে চাকরি শেষে অবসরের টাকা দ্বিগুণ পাবেন। এই ভেবে তিনি ধার দেনা করে টাকা জোগাড় করে তাদের হাতে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার নতুন নিয়োগ হওয়ার পরও শিক্ষা ভবন থেকে স্কেল পরিবর্তন করতে পারলেন না। সেখানেও অনেক নাটক। এই মাস না পরের মাস, এভাবে দেড় বছর পার হয়ে গেলো। বাবা তবুও উচ্চতর স্কেলে বেতন পেলেন না।
অবশেষে স্কেল না পেয়েই ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টে চাকরি শেষে অবসরে গেলেন। আমার আব্বা তার স্কুলের প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষক ছিলেন। অথচ তার বিদায় উপলক্ষে সেই সময়ে সৌজন্যমূলক বিদায় অনুষ্ঠানও করেনি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ঘরে একটি বিদায়ী মানপত্র টাঙানোর স্বপ্নও তার  পূরণ হয়নি! আব্বার চাকরি থেকে অবসরের চার মাস আগে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে আমি নিজ এলাকার কলেজে শিক্ষকতায় যোগদান করি। উদ্দেশ্য ছিলো আব্বা-আম্মার সঙ্গে থাকা। শিক্ষকতা পেশাতে থাকার কারণে সেই সুযোগটি সহজভাবে পাচ্ছি। 

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ভেড়ামারা সরকারি কলেজ

জনপ্রিয়