
‘ব্লাডি ম্যাজিস্ট্রেট!’ এই কঠোর উচ্চারণ শেরে বাংলা ফজলুল হক সাহেবের। ক্ষুব্ধ হয়ে এমন উচ্চারণের কারণটার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করেই মূল আলোচনায় ঢুকে পড়বো।
১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের মার্চের ঘটনা। ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে গুর্খা সৈন্যরা গুলি চালালে শহীদ হন ১৯ জন মুসলমান। আহত আরো অনেকে। ঘটনাস্থল ঝালকাঠী জেলার নলছিটির কুলকাঠী ইউনিয়নে। ম্যাজিস্ট্রেটের নাম ই এন ব্লান্ডি।
হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে নলছিটিতে ছুটে যান শেরে বাংলা। ব্লান্ডিকে ব্লাডি বলেন। সরকারের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলায় হেরে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট ব্লান্ডি ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সেই ঘটনার মোটামুটি সারাংশ এমন।
ওই ঘটনার অধিকাংশ তথ্যই আমার জন্মস্থান নলছিটি শহরের মুরুব্বিদের মুখে শোনা। আর কিছু অংশ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং বইয়ে পেয়েছি। এসব শুনতে শুনতে ছেলেবেলায় আমার মনে ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে গুলি ও হতাহতের ঘটনায় ম্যাজিস্ট্রেট সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা স্থান করে নিয়েছিলো। স্বাধীন দেশে আজও কোথাও ম্যাজিস্ট্রেট কাউকে জরিমানা করলে, হুদাই মাতবরির বা হ্যাডমের খবর শুনলেই নিমিষেই সেই ম্যাজিস্ট্রেটের নৃশংতার কাহিনীর গল্প মনে পড়ে।
এবার একজন খাঁটি বাংলাদেশী ম্যাজিস্ট্রেটের মোবাইল কোর্টের নৃশংসতার ঘটনা নিয়ে একটু আলোচনা করেই লেখা শেষ করবো।
এই মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহের ঘটনা। রাজধানী ঢাকায় ইউল্যাব ইউনিভার্সিটির সামনে একজন উচ্চমাধ্যমিক গ্রাজুয়েট ও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিচ্ছুকের সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে পুলিশ কর্তৃক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনার ভিডিয়ো ভাইরাল হয়েছে। প্রতিবাদী শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে কেউ হয়তো প্রশ্ন তুলবেন যে, ফুটপাতে অবৈধভাবে দোকান বসিয়েছেন, আবার ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে চিৎকার করে প্রতিবাদও করেছেন! ওই ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যম ও প্রচারমাধ্যমে খুব একটা হইচই দেখলাম না। প্রতিবাদ দেখলাম না।
না, একেবারে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে নিজ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বিসিএস ম্যাজিস্ট্রেটদের শরীর ভর্তি হেডম’ শিরোনাম দিয়ে। যার ভেতরে লেখা রয়েছে, “ছেলেটাকে কিভাবে কিল ঘুষি দিয়ে পুলিশের গাড়িতে উঠিয়েছে দেখেছেন? হয়ত তার বাবা মাও জীবনে তার গায়ে হাত দেয়নি। এইভাবে কিল ঘুষি মারার রাইট কে দিয়েছে? একটু মানবিক হওয়া যায় না? আমাদের বিসিএস মেজিস্ট্রেটরাও মাশাল্লাহ। পুরো শরীর ভর্তি হেডম।”
পাঠক নিশ্চয়ই ভুলে যাননি ৫ আগস্টের পরে জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা নিজ দপ্তর ছেড়ে পালিয়েছেন জনরোষের ভয়ে। অপর হ্যাডমওয়ালা পুলিশ ক্যাডাররা এখনও জনরোষের মুখেই আছেন বললেও কি ভুল হবে? সহযোগী একটি দৈনিকে গত সপ্তাহে খবর বেরিয়েছে, ডিসির ফিটলিস্ট তৈরির সাক্ষাৎকারে তালিকাভুক্তদের ৪০ শতাংশই অনুপস্থিত। অথচ কয়েকবছর আগেও ডিসি হওয়ার জন্য জন প্রশাসন সচিবের স্ত্রীকে ২৫ লাখ টাকার নেকলেস উপহার দেওয়ার খবর শুনেছি। মাঠ এখনো জনতার। আবার যখন মাঠ ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণে আসবে তখন ডিসির ফিটলিস্ট তৈরির সাক্ষাৎকারে উস্থিতির সংখ্যা শতকরা দুশো ভাগও হতে পারে! এসপির ফিট লিস্টের অবস্থাও এমনই হবে হয়তো।
পাঠক, এবার নলছিটিতে জন্মানো সমাজ সংস্কারক, সংবিধান, কূটনীতি ও আইনআদালতের লেখক প্রয়াত মিজানুর রহমান খানের লেখা “মোবাইল কোর্ট চলুক হাইকোর্টের অধীনে” শিরোনামের লেখার কিছু অংশ তুলে ধরছি। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে লিখিত ও প্রথম আলোতে প্রকাশিত নিবন্ধের কয়েক প্যারা এমন: “মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে বিচার বিভাগ পৃথককরণের এক যুগপূর্তির তারিখ ১ নভেম্বর নীরবে চলে গেল। সংশ্লিষ্টদের সম্ভবত বলার তেমন কিছু ছিল না। আমরা সম্ভবত মেনে নিয়েছি যে বিশ্বের অন্য কোথাও না থাকলেও বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তারা মোবাইল কোর্ট চালাবেন। সুতরাং করণীয় কী?
এক যুগের অভিজ্ঞতায় একটা বাস্তবসম্মত সমাধানসূত্র হাজির করা ছাড়া আর তো গত্যন্তর দেখি না। সে কারণেই কয়েকটি জরুরি কথা পরিষ্কার করে বলা। বিচার বিভাগ পৃথক্করণ নিয়ে এর আগে যত লেখা লিখেছি, তাতে অধস্তন আদালতের প্রায় আঠারো শ বিচারক নিয়েই কথা বলেছি। এবার তা করব না। শুধু জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ে বলব। তাঁরা সংখ্যায় ছয় শর বেশি। গত ১২ বছরে তাঁদের ঘাড়ে মামলা চেপেছে ৮৮ লাখের বেশি। তাঁদের মামলা নিষ্পত্তির হার গড়ে ৯৫ শতাংশের বেশি। জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট একরামুল হক শামীম হিসাব করে বের করেছেন যে ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে ম্যাজিস্ট্রেসির নিষ্পত্তির হার ছিল ৮৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ। পরের ১২ বছরের মধ্যে এমন তিনটি বছর কেটেছে, যখন নিষ্পত্তির হার ১০০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
এই ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোই সিংহভাগ মামলার প্রবেশদ্বার। তাঁরা অনধিক ৫ বছর কারাদণ্ড দিতে পারেন। এই রকম অপরাধের বিচারের পাশাপাশি তাঁরা মামলা গ্রহণ, জামিন, পিটিশন, নারাজি ইত্যাদি শুনানি করেন। আমরা প্রস্তাব দিই, তাঁদের দিয়েই মোবাইল কোর্ট চালানো হোক। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ভ্যান নামিয়েছেন। আমাদের এখানেও নামুক। হাইকোর্টের মোবাইল কোর্ট মানে হাইকোর্ট–নিয়ন্ত্রিত মোবাইল কোর্ট। তাঁরা সপ্তাহের এক–দুই দিন উপজেলা সদরগুলোয় যাবেন। ওই ভ্যানের মধ্যে লিগ্যাল এইডের আইনজীবীরা থাকবেন। যাঁরা আইনজীবী নিয়োগে অপারগ, তাঁরা আইনি সহায়তা পাবেন। সমাজে এ মুহূর্তে সবচেয়ে যা বেশি দরকার তা হলো, ন্যায়বিচারের বোধ। রাষ্ট্রযন্ত্রের যে অঙ্গীকার আছে, সেটা বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে প্রকাশ করা। কিন্তু যাচ্ছি যেন আমরা উল্টো দিকে। ভয় দেখিয়ে ন্যায়বিচার হবে না। ন্যায়বিচার ছাড়া সমাজে শান্তি আসবে না। মোবাইল কোর্টের তাৎক্ষণিক বিচারের দর্শন আসলে ভীতি ছড়ানোর দর্শন। ভয় দেখানোর যন্ত্রগুলো জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা আত্মঘাতী। বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ডের বিধান নারী নির্যাতন, ধর্ষণের রাশ টানেনি।”
পাঠক, এতক্ষণ ছয় বছর আগে মোবাইল কোর্ট নিয়ে মিজানুর রহমান খানের লেখার অংশ বিশেষ পড়ছিলেন। ৫ আগস্টের পরের বাংলাদেশের গত কয়েকমাসের ধর্ষণের পরিসংখ্যান দেখলে জনাব খানের পর্যবেক্ষণ “বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ডের বিধান নারী নির্যাতন, ধর্ষণের রাশ টানেনি”-- যে শতভাগ জীবন্ত সত্য তা স্বীকার করতে বোধ করি কেউ অস্বীকার করবেন না।
এবার জনাব খানের ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের জুলাইয়ে লেখা আরেকটি নিবন্ধের বরাত দেবো। প্রথম আলোতে প্রকাশিত ওই লেখার শিরোনাম ছিলো “রায় উল্টে দিতে ডিসিদের বায়না” ।
লেখার কয়েকটা প্যারাগ্রাফ এমন : ফৌজদারি কার্যবিধির আগের ক্ষমতা ফেরত চাওয়ার পটভূমিতে প্রধানমন্ত্রী [ওই সময়কার] শেখ হাসিনা ডেপুটি কমিশনারদের ‘অসাংবিধানিক শাসক যেন ক্ষমতায় আসতে না পারে সে জন্য মনোযোগী’ হতে পরামর্শ দিয়েছেন। ডিসিরা এবার বেশ চড়া গলায় সংক্ষিপ্ত বিচারসহ বহু রকম ক্ষমতা চাইছেন। এসব গণতন্ত্রসম্মত নয়।
যেকোনো স্বৈরশাসনে আমলাচালিত মোবাইল কোর্ট হলো তাসের ইশকাপন। তাই মহীউদ্দীন খান আলমগীর, যিনি জনতার মঞ্চের পথিকৃৎ, তাঁর নেতৃত্বাধীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কত অবলীলায় মোবাইল কোর্টের ক্ষমতার পরিধি বাড়াতে সম্মতি দিচ্ছেন।
….সরকারগুলো ডিসিদের কত গুরুত্ব দেয়, তা আমরা সব সময় দেখি। মন্ত্রিপরিষদ সচিব সাংবাদিকদের বলছেন, গণতান্ত্রিক দেশ। তাই ডিসিরা মত দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা এবার যা করছেন, তা রীতিমতো গুরুতর আদালত অবমাননা। তাঁরা সম্ভবত মনে রেখেছেন যে, এই মামলায় আদালত অবমাননার অভিযোগ বহুবার বহুভাবে আনা হলেও কারও চাকরির ক্ষতি হয়নি। তাই মাসদার হোসেন মামলা-সংক্রান্ত বিষয়ে অন্তত আদালত অবমাননার অভিযোগ তাঁদের বিচলিত করবে না। ওটা তাঁদের সয়ে গেছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন, প্রতিবছরই ডিসিদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করেন। এটা দাবি আদায়ের ফোরাম নয় যে সব বিষয় আলোচনার উপযোগী, সেগুলোরই কেবল এখানে আলোচনা হবে। কিন্তু তিনি আমাদের বলেননি, ডিসিদের ওই দাবি ২০০ বছরের পুরোনো। এর প্রেতাত্মা অনাদিকাল ধরে ভেসে বেড়ায়। দেশে কী অমাবস্যা আসছে যে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের রায় পাল্টানোর আবদার ওঠে? পৃথককরণের পর এবারেই এই লম্ফঝম্পটা বেশি দেখছি।
ডিসিদের এই দাবি গণকর্মচারী শৃঙ্খলাবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। দেশে কার্যকর পার্লামেন্ট ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকলে ডিসিদের এই দুঃসাহস হতো না। তবু বলব, পার্লামেন্টের উচিত মন্ত্রিপরিষদ ও জনপ্রশাসনসচিবকে তলব করে ছবক দেওয়া। এটা বলে দেওয়া যে সুপ্রিম কোর্টের রায় বদলাতে আলোচনার অধিকার ডিসিদের নেই। তাঁদের দায়মুক্তি দেওয়া নেই। আমার আশঙ্কা, বিচারকদের বেতন স্কেল বাড়ানোটা পুষিয়ে দিতে ডিসিদের আরও বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া হতে পারে। এবারের আলোচনা এবং সংবাদপত্রে তার বড় বড় হরফে শিরোনাম অশুভ অগ্রগতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
পৃথককরণের পর থেকে প্রশাসন ক্যাডার ছলে-বলে-কৌশলে বিচারিক ক্ষমতা হরণ করছে। তারা একটি ইঁদুরে গর্ত করেছে, এর নাম মোবাইল কোর্টের তফসিল। সেনাবাহিনীকেও তাদের সঙ্গে আপস করতে হয়েছিল। বিচার বিভাগ পৃথককরণের বিরুদ্ধে তারা জিহাদ ঘোষণা করলে একটা আপসরফা হয়। একটি উদ্ভট মোবাইল কোর্ট-ব্যবস্থা তারা চালু করিয়ে নেয়। এটা আগেকার আমলাদের লালসালু ঘেরা আদালত বিলোপের ক্ষতিপূরণ। তবে মোবাইল কোর্টের তুলনা কেবল সামরিক আদালত কিংবা ক্যাঙারু কোর্টের সঙ্গে তুলনীয়। মোবাইল কোর্ট শব্দটি একটা সাধারণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এঁরা ফরমালিনযুক্ত খাবার ও পণ্য চিহ্নিত করেন। কিন্তু আমরা লক্ষ করি না তাঁরা ফরমালিনযুক্ত বিচার দিচ্ছেন। টিভি ক্যামেরা থাকে। বেশ একটা টাটকা বিচার এখানে পাওয়া যায়। সামরিক শাসকেরা ক্ষমতায় এসে যেভাবে চুল খাটো করে, শরীরে আলকাতরা মেখে সমাজে তথাকথিত শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন, সে রকমের একটা ব্যবস্থার নাম আমলা পরিচালিত মোবাইল কোর্ট। গত দু-তিন দিন সংবাদপত্রে সংক্ষিপ্ত বিচারের ব্যানার হেডিংগুলোও ইঙ্গিত দেয়, সংবাদকর্মীরা এর গুরুত্ব সম্পর্কে কতটা সচেতন।
আইন মন্ত্রণালয়টা দখলে নিতে প্রশাসন ক্যাডারের জিহ্বা প্রসারিত। পৃথককরণের বদলা নিচ্ছে তারা। আইনসচিব পদে তারা কাউকে বসতে দেয়নি। কিন্তু এ নিয়ে কোনো টুঁ শব্দটি নেই। ছাত্রলীগনামীয় সাবেক ক্যাডাররা নিম্ন আদালতের বিচারকদের পেশাগত একমাত্র সংগঠনটিকে সরকারের ‘বি’ টিমে পরিণত করেছে। কোনো সম্মেলন ডাকতে হচ্ছে না। কারণ, সম্মেলন ডাকলে ডিসিদের দাবি খণ্ডাতে হবে। এর পুরস্কার হিসেবে অবৈধভাবে কৃত্রিম পদধারীরা তাঁদের বেতন-ভাতা হালাল করার মওকা পাচ্ছেন।
সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় গঠনের মুলা সামনে ঝোলানো আছে। এই সরকার তার পুরো মেয়াদ করে দিল আইনসচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিবের পদ শূন্য রেখেই। সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শে আইনসচিব নিয়োগে আলোচিত রায় আছে। সেটা নীরবে কাঁদছে। সম্প্রতি আরও করুণ রস আস্বাদন করলাম। আমলাদের মতো ওএসডি বিচারকদের একটি তালিকা হয়েছে। এটা নজিরবিহীন। গত ৩ জুন এক ওএসডি একটি রিট করলেন। সুপ্রিম কোর্টকে না জানিয়ে সচিব পদে এক আগন্তুকের তিন বছর পার করানোর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেছেন। আবেদনকারীর ওপরে সাঁড়াশি বিভাগীয় তদন্ত চলেছে। রিপোর্টগুলো তাঁকে মুক্তি দিলেও তাঁর ফাইল ডানে-বাঁয়ে নড়ে না। শুধু ধূর্ততা ও আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বছরের পর বছর আইনসচিবের পদ শূন্য করে রাখা একটি অকার্যকর রাষ্ট্রের সূচক বটে।
এটা দেখার একক সাংবিধানিক দায় সুপ্রিম কোর্টের। সেই প্রশ্ন রিট আকারে হাইকোর্টে যাওয়ার পরে অ্যাটর্নি জেনারেলের সময় প্রার্থনায় আমরা হতভম্ব। অন্তত চার দফায় তিনি সময় নিয়েছেন এই বলে যে, এর শুনানি শুরু করার ব্যপারেই তাঁর আপত্তি আছে। ইতোমধ্যে দেড় মাস কেটে গেছে। এখন পর্যন্ত জানা যায়নি, তাঁর আপত্তিটা কী। আবেদনকারীর আইনজীবী এম কামরুল হক সিদ্দিকী নিশ্চিত করেন যে, তাঁর বিরোধিতা সত্ত্বেও অ্যাটর্নি জেনারেলের অনুরোধক্রমে আদালত সময় মঞ্জুর করছেন।
বিচার প্রশাসনের মলিন জৌলুশ একেবারে লুপ্ত হতে বসেছে। সারা দেশের বিপুলসংখ্যক বিচারকের নৈতিক মনোবল, বিচার ক্যাডার নিয়ে গর্বে চিড় ধরেছে বলে প্রতীয়মান হয়। একাত্তরের চেতনার ধ্বজাধারী গুটিকয়েক তোষামোদকারী ব্যক্তি আত্মতুষ্টিতে ভুগছেন। তাঁরা শয়ে শয়ে বিচারকের মনঃকষ্টের কারণ হয়ে এবং জুডিসিয়াল সার্ভিস সমিতির লালবাতি জ্বালিয়ে খালি চাপার জোরে পার পাচ্ছেন। একদিকে প্রশাসন ক্যাডার বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে, অন্যদিকে বিচার প্রশাসনে নৈরাজ্য অব্যাহত রয়েছে। তাই মাসদার হোসেনের রায় কেবল আমলারাই নষ্ট করছেন, তা বলা একচোখা হবে। বরং বিচার প্রশাসন বিচারিক মনন দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই আমলা ও বিচারকেরা পৃথকযাত্রায় অভিন্ন চর দখল নীতিই আঁকড়ে আছেন।”
জনাব খানের ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জুলাইয়ে ওই লেখায় আরো উল্লেখ পাই, ঢাকায় তিনজন মার্কিনীর সঙ্গে খানের আলোচনার। যাদের মধ্যে মিনেসোটার একজন জেলা জজ ছিলেন। তাদের সঙ্গে খানের কথা হয়েছিলো নানা বিষয়ে। আমলা আদালত শুনে তাঁরা [মার্কিনীরা] বেশ মজা পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেন খান।
সবশেষ খান লেখেন, “আচ্ছা, একটা প্রস্তাব দিই। ক্ষমতার পৃথককরণ যখন আমাদের মাথায় ঢুকবেই না, তখন একটা কাজ হোক। হাইকোর্টের বেঞ্চে একজন করে সেক্রেটারিকে প্রেষণে দেওয়া হোক! সেখানে সামারি ট্রায়াল হোক! এমনকি তাঁদের দিয়ে মোবাইল কোর্টও হতে পারে! ”
পাঠক, এতক্ষণ ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের পটভূমিতে জনাব খানের লেখা পড়ছিলেন। লেখাটার অনেকাংশই এখনকার প্রেক্ষাপটের সাজুজ্যতায় অবাক হওয়ার মতো নয়। এবার বিশ্বখ্যাত ও নোবেলজয়ী অধ্যাপকের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে এতটুকু প্রত্যাশা। আমার [আমাদের] মন থেকে প্রায় শতবর্ষ আগের ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট ব্লান্ডির নৃশংতা ও রাজধানীর ইউল্যাবের সামনে পেটের দায়ে হকারগিরিতে নামা শিক্ষার্থীকে স্বাধীন দেশের ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে কিল-ঘুষির ট্রমা মুছে দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়ে জাতিকে আজীবনের জন্য রক্ষা করে বিচারালয় তথা সারাদেশের মানুষের মনে চিরনমস্য হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করবেন।