
আমাদের শিক্ষার নানা স্তরে এতো বেশি অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা যে, এক্ষেত্রে আশু সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি বলে কিংবা লিখে শেষ করার মতো নয়। এজন্যে আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এমনকি গোটা জাতির চাহিদার অন্ত নেই। এই চাওয়া অলীক, অসম্ভব কিংবা অবাস্তব কিছু নয়। যুগোপযোগী শিক্ষার এই চাহিদা যুক্তিযুক্ত এবং খুবই প্রাসঙ্গিক। এ কারণে একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং স্থায়ী শিক্ষা কমিশনের দাবি উত্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
আমাদের রাজনীতিবিদেরা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের কথা সব সময় বলে থাকেন। এটি রাষ্ট্রীয় কাঠামো তথা গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার জন্য একান্ত অপরিহার্য বিষয়। এটি না থাকার কারণে আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক কাঠামো যেমন প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি লাভ করতে পারেনি, তেমনি স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধ শত বছর পরেও আমরা সত্যিকারের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করতে পারিনি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। কেনো জানি না আমাদের শিক্ষাবিদেরা আজ পর্যন্ত একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠনের দাবিটি জোরালোভাবে উত্থাপন করেননি।
কোনো সরকারই স্বপ্রণোদিত হয়েও কাজটি করে দিয়ে যায়নি। শিক্ষাবান্ধব হলে যেকোনো সরকার এটি করে দিয়ে যেতে পারতো। মুখের কথায় আর কাগজে কলমে সব সরকারই শিক্ষা ও শিক্ষকদের সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। নিজেদের শিক্ষাবান্ধব বলে জাহির করে। একটি একটি কালচার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বক্তৃতা বিবৃতিতে আমরা শিক্ষকদের মাথায় উঠিয়ে রাখি। পঞ্চমুখে শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার কথা বলি। বাস্তব অর্থে শিক্ষা ও শিক্ষকদের এতোটুকু গুরুত্ব দিতে কাউকে দেখিনি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কথাই যদি বলি, তাহলে একই চিত্র প্রতীয়মান।
এই সরকার ক্ষমতায় এসেই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার মৌলিক কয়েকটি বিষয়ে সংস্কারের জন্য দশ-বারোটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু, শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনের কথা মুখে এনেছে বলে কারো কাছে শুনিনি। এ বিষয়টি নিঃসন্দেহে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সবাইকে বিস্মিত করেছে। বেসরকারি শিক্ষকদের ন্যায়সংগত দাবির ব্যাপারে তাদের মনোভাব এখনো স্পষ্ট নয়। অন্তত এই রমজানে তারা শিক্ষকদের শতভাগ উৎসব ভাতা দিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু, সেটি তারা দেয়নি।
রাজনৈতিক সরকারগুলোর মতো অনেকটা চোখ-কান বন্ধ করে তারা বসে আছে। তা না হলে, শিক্ষকেরা রোজার মাসে কর্মসূচি পালন করেও তাদের কাছ থেকে কিছু আদায় করতে পারেননি। অন্তর্বর্তী আর রাজনৈতিক সরকারে তাহলে কী পার্থক্য? আমার মনে হয়, এই সরকার রাজনৈতিক সংস্কারেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার প্রতি অতীতের সরকারগুলোর ন্যায় তারাও মনে হয় কিছুটা উদাসীন। প্রকৃতপক্ষে কোনো সরকারেরই শিক্ষাকে খাটো করে দেখার যুক্তিসংগত কারণ খুঁজে পাই না। শিক্ষা একটি দেশ ও জাতির মুল চালিকা শক্তি। নেলসন ম্যান্ডেলা এটিকে পৃথিবী বদলে দেবার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার বলেছেন। এটিকে বাদ দিয়ে কোনো দেশ কিংবা জাতি উন্নতির শীর্ষে উঠতে পেরেছে বলে কোনোদিন শুনিনি।
পৃথিবীর যতো দেশ ও জাতি সভ্যতার সোপানে আরোহণ করেছে, সে কেবল শিক্ষার বদৌলতে সম্ভব হয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক, সামরিক, তত্ত্বাবধায়ক এমনকি অন্তর্বর্তী সরকার পর্যন্ত শিক্ষাকে কেনো খাটো করে দেখে, সেটি আমার বোধগম্য নয়। একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী শিক্ষা কমিশন শিক্ষার যাবতীয় অসংগতি দূর করে যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে। শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ওপর দাঁড় করাতে পারে। শিক্ষায় নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে পারে। ঘুষ ও টাকা মেরে খাওয়ার সংস্কৃতি চিরতরে বন্ধ করতে পারে। যুগোপযোগী সিলেবাস, কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও একটি নির্ভরযোগ্য মুল্যায়ন পদ্ধতি চালু করতে পারে। শিক্ষকদের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য উঠিয়ে দিতে পারে। তাদের সত্যিকারের মর্যাদার আসনে বসাতে পারে। শিক্ষার্থী, অভিভাবক তথা গোটা জাতির চাহিদা পূরণ করে একটি সুশিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠি তৈরি করতে পারে। এই জনগোষ্ঠী পৃথিবীর যেকোনো দেশে সমাদৃত হবে। বর্তমান সময়ের মতো দেশে দেশে অবহেলিত হবে না। বিদেশে আমাদের জনশক্তির দৈন্যদশা সত্যি আমাদের ভীষণ পীড়িত করে। শিক্ষায় কারিগরি ও আইসিটি এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সিলেবাস ও কারিকুলামের ওপর কমিশন গুরুত্বারোপ করতে পারে। এতে আমাদের শিক্ষা আরো অর্থবহ ও প্রাণবন্ত হবে। দেশে কারিগরি ও তথ্য প্রযুক্তি জ্ঞান সমৃদ্ধ একটি নতুন প্রজন্ম তৈরি হবে।
আমাদের শিক্ষায় কোন দুর্নীতিটি নেই? অন্য যেখানে যা-ই থাকুক না কেনো, শিক্ষা সেক্টরটি অন্তত পবিত্র থাকা চাই। দুঃখজনক সত্যি যে, আমাদের শিক্ষায় যতো দুর্নীতি হয়, মনে হয় অন্য কোথাও এতোটা নেই। শিক্ষা ব্যবস্থাপনার তৃণমূল থেকে শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত দুর্নীতি আর দুর্নীতি। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় সব পর্যায়ে এই দুর্নীতির বিস্তার ঘটে থাকে। আজ তাই রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। সর্বাগ্রে একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা আমাদের জন্য একান্ত অপরিহার্য। এই লক্ষ্যে সর্বপ্রথম শিক্ষাখাতকে দুর্নীতিমুক্ত করা আবশ্যক। শিক্ষা ব্যবস্থাপনার কোন স্তরটি দুর্নীতির ঊর্ধ্বে আছে, সেটি আমার জানা নেই। প্রায় চার দশকের শিক্ষকতা জীবনে শিক্ষা ব্যবস্থাপনার কোথাও ঘুষ, দুর্নীতি নেই এমন জায়গা খুঁজে পাইনি। উপজেলা ও জেলা থেকে শুরু করে বিভাগীয় অধিদপ্তর, শিক্ষা ভবন এমনকি খোদ মন্ত্রণালয় পর্যন্ত দুর্নীতিতে সয়লাব। ঘুষ ছাড়া ফাইল দূরের কথা, এক টুকরো কাগজও এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে যায় না। পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন থেকে শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত অনিয়ম আর অনিয়ম। পৃথিবীর আর কোথাও শিক্ষায় এই হ-য-ব-র-ল অবস্থা নেই। এসব জঞ্জাল কে দূর করবে? শিক্ষাবোর্ড, অধিদপ্তর, ব্যানবেইস, এনসিটিবি, এনটিআরসিএ যেখানেই চোখ যায় না কেনো, সব জায়গায় দুর্নীতি আর অনিয়ম। একেকটি শিক্ষা বোর্ড কতো রকম ফি আদায় করে, সে কেবল তারাই জানে। বছরে কয়টি ভাতা নেয়, সেটি আমরা অনেকে জানি না। জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসির রেজিস্ট্রেশনের সময়, প্রত্যেকটি পাবলিক পরীক্ষার সময় বোর্ডের লোকেরা বাড়তি একেকটি ভাতা পেয়ে থাকে। সব মিলিয়ে বছরে তারা আট-দশটা ভাতা পায়। এখন শুনছি ষষ্ঠ শ্রেণিতেও নাকি শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। তাহলে তাদের আরেকটি ভাতা বাড়বে। তাদের প্রতিটি শতভাগ ভাতা। অথচ এদেশে বেসরকারি শিক্ষকেরা মাত্র দুটি শতভাগ উৎসব ভাতার জন্য কতো আহাজারি করেন।
শিক্ষা বোর্ডগুলো শিক্ষকদের সম্মানীর টাকা এক বছরের আগে দেয়ার নাম মুখে নেয় না। পরীক্ষার খাতা দেখার সম্মানী, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও পরিশোধনের সম্মানী সময়মতো দেয়ার নাম গন্ধ নেই। তীর্থের কাকের মতো পথ চেয়ে থাকতে থাকতে অবশেষে বছর পূর্ণ হলে এই টাকা ছাড় হয়। ম্যানেজিং কমিটি কিংবা গভর্নিং বডি অনুমোদন, স্কুল-কলেজের স্বীকৃতি নবায়ন ইত্যাদি নানা বিষয়ে ফির নামে বছরে বোর্ডগুলো কতো টাকা আয় করে, সে হিসাব কেউ জানে না। কমিটির মেয়াদ দুবছর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বীকৃতির মেয়াদ তিন বছর। মেয়াদ যতো কম, ততো তাদের লাভ। কমিটির মেয়াদ তিন বছর আর স্বীকৃতির মেয়াদ পাঁচ বছর করলে কী হয়? সবই ব্যবসার ধান্ধা। আয় কমে যাবার ভয়। আমার আশঙ্কা হয়, কখন জানি এরা কমিটির মেয়াদ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতির মেয়াদ কমিয়ে মাত্র এক বছর করে ফেলে। তাদের হাতে অপরিসীম ক্ষমতা। অটোনোমাস বডি! একটি সার্কুলার দিয়ে দিলেই হলো। বেশ কয়েক বছর জেএসসি পরীক্ষা উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তদুপরি বোর্ডগুলো রেজিস্ট্রেশন ফি আদায় করে। শিক্ষার্থীদের ফরম ফিলাপ করা লাগে। শিক্ষার একই স্তরে তিন তিন বার রেজিস্ট্রেশন। একবার ষষ্ঠ, একবার অষ্টম আরেকবার নবম শ্রেণিতে। অভিভাকদের ওপর এ কেমন অত্যাচার? সবই টাকার জন্য। এটি ওপেন সিক্রেট ব্যাপার। কেউ কিছু বলে না। কারো কিছু বলার নেই। এ যেনো ‘মগের মুল্লুক’। সমগ্র শিক্ষা জীবনে একবার রেজিস্ট্রেশন করে কি চালিয়ে নেয়া যায় না? ডিজিটাল যুগে এটিই হওয়া উচিত।
আমাদের দেশে অতীতে কোনো সরকার শিক্ষা কমিশন গঠন করেনি, এমন কথা আমি বলছি না। যখন যারা ক্ষমতায় এসেছে, তখন তারা নিজেদের মতো করে শিক্ষা কমিশন গঠন করেছে। কমিশনে নিজেদের লোক ঢুকিয়েছে। নিজেদের চিন্তা চেতনা ও বিশ্বাসের আলোকে সিলেবাস, কারিকুলাম, পাঠ্যবই এমনকি শিক্ষানীতি সাজিয়েছে। জাতীয় চিন্তা-চেতনা এবং ঐকমত্যের প্রতিফলন কদাচিৎ দেখতে পেয়েছি। নির্লজ্জ দলীয়করণ ও রাজনৈতিক মতাদর্শের শিকার হয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বার বার মরে যেতে দেখেছি। একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও সর্বজনীন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে না পারার ব্যর্থতার কারণে তা মাঝপথে আটকে যেতে দেখেছি। কখনো কখনো বিদেশের অনুসরণে সিলেবাস, কারিকুলাম, মুল্যায়ন প্রক্রিয়া এমনকি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে গিয়ে কেউ কেউ কোটি টাকা মেরে খেয়েছে। দেশ ও জাতি এ থেকে ন্যূনতম উপকার পায়নি। আমরা উন্নয়নশীল জাতি। উন্নত জাতির আদলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর খায়েশ গরিবের ঘোড়া রোগের মতো। তাদের মুল্যায়ন পদ্ধতি অনুসরণ করে আমাদের শিক্ষার্থীদের মুল্যায়ন করা কতোটা যুক্তিযুক্ত? তাদের শিক্ষকের মান-মর্যাদা আর আমাদের শিক্ষকের মান-মর্যাদায় আকাশ-পাতাল তফাৎ। তাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত এবং আমাদের অনুপাত কেউ বিবেচনা করে না। তাদের শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা আর আমাদের শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধায় কতো তারতম্য। খালি খালি কাউকে অনুসরণ করার কোনো মানে হয় না। এতে হিতেবিপরীত হয়। বিদেশের পাঠদান পদ্ধতি ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনা পর্যবেক্ষণ করতে আমাদের এখান থেকে যে দলটি বিদেশ সফরে যায়, সেখানে এক-দুজন মাত্র শিক্ষক প্রতিনিধি থাকেন। বাকিরা আমলা-কামলা, না হয় দলীয় আশীর্বাদপুষ্ট লোকজন। শিখন-শেখানো তো আমলা-কামলা কিংবা রাজনীতিকদের কাজ নয়। তাহলে শিক্ষকদের বিদেশে ট্রেনিংয়ে যাবার সময় অন্যদের সঙ্গে নেবার কী দরকার? এই করে করে আমাদের শিক্ষকদের বিদেশে উন্নত ট্রেনিং গ্রহণের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে। আবার যে দু-এক জন শিক্ষক প্রতিনিধি সুযোগ পেয়ে বিদেশে ট্রেনিং নিতে যান, তারা আমলা-কামলা বা মন্ত্রীর আত্মীয় কিংবা দলীয় লোক। এক্ষেত্রে যোগ্য শিক্ষকেরা বেশিরভাগ সময় বঞ্চিত থাকেন।
আমাদের দেশে বিভিন্ন স্তরে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে একাডেমিক সার্টিফিকেট অর্থাৎ শিক্ষাগত যোগ্যতার ওপর প্রাধান্য দেয়া হয়ে থাকে। পেশাগত সার্টিফিকেট কিংবা পেশাগত যোগ্যতার কোনো মর্যাদা নেই। শিক্ষকতায় প্রবেশ করে তারপর সুবিধা মতো সময়ে পেশাগত সার্টিফিকেট অর্থাৎ প্রশিক্ষণ নিলেই হলো। উদাহরণস্বরূপ, প্রাইমারি শিক্ষকদের ডিপইনএড এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের বিএড প্রশিক্ষণের কথাই ধরা যাক। তাদের শিক্ষকতায় প্রবেশের প্রান্তিক যোগ্যতা হিসেবে এগুলো গণ্য করা হয় না। কিন্তু পৃথিবীর অন্য অনেক দেশে শিক্ষকতায় প্রবেশের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার সঙ্গে পেশাগত যোগ্যতাকেও আবশ্যিক প্রান্তিক যোগ্যতা হিসেবে ধরা হয়। এজন্য শিক্ষকতায় আসার আগে পেশা সংক্রান্ত একটি বুনিয়াদি কোর্স করে আসতে হয়। ফলে, তারা শুরু থেকেই যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক পেয়ে যায়। আর আমাদের এখানে যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষক তৈরি হতে হতে অনেকের চাকরি জীবন শেষ হয়ে যায়। এমন অনেক শিক্ষককের কথা জানি, যারা পেশাগত বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ ব্যতিরেকে চাকরি জীবন সমাপ্ত করেছেন। শিক্ষকতা পেশায় যোগ্য লোক পেতে হলে শিক্ষকদের আকর্ষণীয় বেতন দিয়ে প্রবেশকালীন শিক্ষাগত যোগ্যতার সঙ্গে প্রান্তিক যোগ্যতা হিসেবে পেশাগত যোগ্যতা অবশ্যই সংযুক্ত করতে হবে। আমাদের কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেলায়ও এরকম হওয়া প্রয়োজন। ইদানিং কলেজ শিক্ষকদের কদাচিৎ প্রশিক্ষণ দেয়া হয় বটে। প্রারম্ভে পেশাগত যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করে সেটি প্রান্তিক যোগ্যতা হিসেবে বাধ্যতামূলক করা হলে জাতি অনেক ভালো ও যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষকের সেবা পেতো। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের বিষয়টি মাঝে মাঝে গোটা জাতিকে চরম লজ্জায় ফেলে দেয়। খোদ ভিসি পর্যন্ত অনেক সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত হন। কোনো প্রকার থিসিস এবং পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়াই কখনো কখনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। এখানে রাজনৈতিক পরিচয়কে প্রায়োরিটি দেয়া হয়। অনেক সময় স্বজনপ্রীতি করে ভার্সিটির শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। ভিসির আত্মীয়-স্বজন কিংবা সিন্ডিকেট সদস্যদের কাছের লোকজন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেয়ে থাকেন। এতে শিক্ষার বারোটা বাজে এবং গোটা দেশ ও জাতি চরম ক্ষতির মধ্যে পড়ে। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে আমরা যুগ যুগ ধরে এর খেসারত দিয়ে চলেছি। এসবের আশু অবসান হওয়া দরকার। শিক্ষার সব স্তরে শিক্ষক নিয়োগে শতভাগ স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা এবং মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে না পারলে আমাদের কপালে আরো অনেক দুর্গতি অপেক্ষা করছে। এজন্যে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে একটি শক্তিশালী স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠনের জোর আবদার জানিয়ে এখানেই শেষ করছি।
লেখক: আবাসিক প্রতিনিধি, আমাদের বার্তা, লন্ডন