
কবি রজনীকান্ত সেন তার ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতায় লিখেছেন-বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই,/ ‘কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই,/ আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে/তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে।’ সময় ফুরিয়েছে, চড়ুই পাখির আর মহাসুখ নেই। বাঁচার জন্য লড়াই করছে চড়ুই পাখি। আজ ২০ মার্চ ‘বিশ্ব চড়ুই দিবস’ বা ‘ওয়ার্ল্ড স্প্যারো ডে’।
২০১০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে চড়ুই পাখি ও অন্যান্য পাখি রক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টিতে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। গ্রামে চড়ুই পাখির কিচিরমিচির শোনেননি এমন লোক হয়তো কমই পাওয়া যাবে। একটা সময় ছিলো চড়ুই পাখির আনাগোনা দেখা যেতো হরহামেশাই। বাসাবাড়ির আশপাশে, গৃহস্থালির গাছগাছালিতে, পুরাতন ঘরবাড়ির ফাঁকফোঁকরে এই পাখি দেখা যেতো। ভদ্র ও অমায়িক এই মিষ্টি পাখিটি মানুষের সহচার্যে থাকতেই বেশি ভালোবাসে। আর এ কারণেই কবি-সাহিত্যিকদের লেখালেখিতেই এসেছে চড়ুই পাখির কথা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশসহ বহু কবি-সাহিত্যিক প্রকৃতির এই ফূর্তিবাজ পাখিকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। বিশ্বকবি তার ‘বালক’ কবিতায় লিখেছেন- ‘চড়ুই পাখির আনাগোনা মুখর কলভাষা/ঘরের মধ্যে কড়ির কোণে ছিলো তাদের বাসা।’
যতো বেশি নগরায়ণ হচ্ছে, পৃথিবী যতো আধুনিক হচ্ছে ততো বেশি চড়ুই পাখি কমছে। একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দশকেও গ্রামে ও শহরে দুজায়গাতেই চড়ুই পাখির দেখা মিলতো। কিন্তু শহরে তো বটেই গ্রামেও ব্যাপকভাবে কমে গেছে চড়ুই পাখি। প্রকৃতির এই ছোট পাখিটি বিভিন্ন ধরনের দূষণ, বাসস্থানের অভাব, গাছপালা কমে যাওয়া, গ্রীষ্মকালে পানির কষ্ট, জলাভূমি ভরাট, টাওয়ারের ক্ষতিকারক রেডিয়েশন, ফ্ল্যাটবাড়ির প্রসার, খাবারের অভাব, পাখি নিধন ও জমিতে কীটনাশকের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ চড়ুই পাখির সংখ্যা কমতে থাকায় জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
প্রকৃতি ও পরিবেশের কী পরিমাণ সর্বনাশ হলে চড়ুই পাখির মতো ছোট্ট প্রাণীটিও ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় তা ভাববার সময় হয়েছে। মানুষ ও চড়ুই পাখি উভয়ই প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। অথচ মানুষের নানা প্রকার কর্মকাণ্ডের কারণেই চড়ুই পাখি হারিয়ে যেতে বসেছে।
চড়ুই পাখি হারিয়ে গেলে কী অবস্থা হয় তার একটা উদাহরণ দেয়া যাক। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের কথা। ফসল খেয়ে শেষ করে দিচ্ছে-এই অভিযোগে মশা, মাছি, ইঁদুর আর চড়ুই পাখি মারার সিদ্ধান্ত নিলেন চীনের তৎকালীন চেয়ারম্যান মাও সে তুং। সবাই চড়ুই পাখি মারতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে চড়ুই পাখি নির্মূলে নেমে পড়লো। এই অপারেশনের নাম ছিলো ‘দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন’। সে বছর লাখ লাখ চড়ুই পাখি মারা হয়। পরের বছর চীনে ফসলে ব্যাপক পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। খাদ্যশস্য উৎপাদনের বড় একটি অংশ চলে যায় পোকামাকড়ের পেটে। খাদ্যের অভাবে চীনে দেখা দেয় ব্যাপক দুর্ভিক্ষ। ‘দ্য গ্রেট চাইনিজ ফ্যামিন’ দুর্ভিক্ষে কোটিরও বেশি মানুষ মারা যায়। চীন সরকার তার ভুল বুঝতে পেরে ফসল বাঁচাতে আবারও চড়ুই পাখি রক্ষার আন্দোলনে নেমে পড়ে।
চড়ুই পাখি প্রায় জনমানবহীন অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া সব মহাদেশেই দেখা যায়। চড়ুই পাখি এমনভাবে মানুষের আশপাশের পরিবেশের সঙ্গে থাকে যেনো দেখে মনে হয় মানুষ তার অতি আপন প্রতিবেশী। মরুভূমি, তৃণভূমি ও আশপাশে জনবসতি নেই এমন বনে এই পাখির দেখা মেলে না। আমাদের দেশে দুই প্রজাতির চড়ুই পাখির সন্ধান মিলে। পাতি ও গেছো চড়ুই। মানুষ ও বাসাবাড়ির কাছাকাছি থাকতে ভালোবাসে বলে এই পাখির ইংরেজি নাম ‘হাউজ স্প্যারো’। একটা সময় ব্রিটেনে ও ভারতে ব্যাপক চড়ুই পাখি ছিলো। এখন ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চড়ুই পাখির সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে এবং পাচ্ছে। চড়ুই পাখি কমতে থাকায় ব্রিটেনে ‘রয়্যাল সোসাইটি অব প্রোটেকশন অব বার্ডস’ কর্তৃক লাল তালিকাভুক্ত করা হয়েছে চড়ুইকে। খড়কুটো ও শুকনো ঘাস দিয়ে এই পাখি সহজেই বাসা তৈরি করতে পারে। এরা সহজেই বাসাবাড়ির ফাঁকফোকর, চিলেকোঠা, ঘুলঘুলি ও কড়িবরগায় বাসা বানিয়ে থাকে। বাসা বানাতে গ্রামের একতলা ও দোতলা ঘর এদের বেশি পছন্দ। এ ছাড়া চারপাশে ফাঁকা রয়েছে এমন ছোট বিল্ডিংয়ের ভাঙা ভেন্টিলেটরের মধ্যে বাসা বানাতে এদের দেখা যায়। এরা পোকামাকড় ও শস্যদানা খেতে পছন্দ করে। এ ছাড়া বাদাম জাতীয় ফলও গ্রহণ করে।
পাখিবিনাশী কর্মকাণ্ড চলতে থাকলে চড়ুই পাখির সংখ্যা কমতে কমতে এমন একটা সময় আসবে যখন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম চড়ুই পাখি হয়তো আর সরাসরি চোখে দেখতে পাবে না। খুঁজে চড়ুই পাখির ছবি দেখতে হবে। আমরা কী পারি না চড়ুই পাখির প্রতি একটু সদয় হতে? গ্রীষ্মকালে বাড়ির এক কোণে বা ছাদে চড়ুই পাখির জন্য কী পানি রাখতে পানি না। আমরা কী পারি না, বাসাবাড়ির এক কোনায় বা ফাঁকা জায়গায় চড়ুই পাখির জন্য নিরাপদ একটু স্থান রাখতে। চড়ুই পাখির জন্য বাসাবাড়ির সামনের গাছপালার শাখায় একটা ছোট মাটির কলস পেতে রাখতে আমরা কী পারি না! আমাদের ছোট ছোট উদ্যোগ পারে চিরচেনা প্রতিবেশী চড়ুইকে রক্ষা করতে। পাখি শিকারিদের কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। চড়ুই পাখি যেনো বেঁচে থাকার স্বাভাবিক পরিবেশ পায় সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ছোট পাখি হলেও এ পৃথিবী তাদেরও। তাদেরও বেঁচে থাকার সমান অধিকার রয়েছে।
লেখক: শিক্ষক