ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫ , ১০ বৈশাখ ১৪৩২ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

জলবায়ুসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলায় বনভূমিই ভরসা

মতামত

সাধন সরকার, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০৭:০০, ২১ মার্চ ২০২৫

সর্বশেষ

জলবায়ুসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলায় বনভূমিই ভরসা

আজ ‘বিশ্ব বন দিবস’। বন ও বনভূমি রক্ষায় ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২১ মার্চকে আন্তর্জাতিক বন দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বনভূমির গুরুত্ব অপরিসীম। উদ্ভিদ ও প্রাণীদের বাঁচার প্রধান উপাদান অক্সিজেন আসে বনের গাছ থেকে। বন উদ্ভিদ ও প্রাণীদের ক্রমাগত অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে। বন ধ্বংস হলে বায়ুমন্ডলের অক্সিজেন ও কার্বনের ভারসাম্য নষ্ট হবে এবং জলবায়ুগত দুর্যোগ বাড়বে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় সংসদে দেয়া তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ মোট আয়তনের ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। কিন্তু একটি দেশের সুরক্ষায় মোট ভূমির ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় অঞ্চলকে টিকিয়ে রেখেছে সুন্দরবন। উপকূলের বন একটার পর একটা দুর্যোগ মোকাবিলা করে জনজীবন ও সম্পদ রক্ষায় কাজ করে চলেছে। সুন্দরবন তথা বনভূমির কারণে ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ‘সিডর’ ও ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে ‘আইলা’র মতো দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিলো। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ও উপকূলীয় মানুষের বনকেন্দ্রিক জীবন-জীবিকায়ও বনের গুরুত্ব অপরিসীম। গ্রিনহাউজ গ্যাসসমূহ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। কার্বন ডাই অক্সাইডসহ অন্যান্য গ্রিন হাউস গ্যাস বৃদ্ধির কারণে জলবায়ুসৃষ্ট দুর্যোগ বাড়ছে। ক্রমবর্ধমানহারে তাপমাত্রা বাড়ছে। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ও লবণাক্ততা বাড়ছে। আর এতসব সমস্যার সমাধান হতে পারে বনভূমি রক্ষা করে । গবেষণায় দেখা গেছে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের মোট ভূমির ১৩ ভাগ এলাকা ইতিমধ্যে পুরোপুরিভাবে লবণাক্ত হয়ে গেছে। ২০৫০ খ্রিষ্টাব্দে এই লবণাক্ততার হার বেড়ে হবে ১৬ ভাগ। তাই বনভূমি বাড়িয়ে কার্বন শোষণের মাধ্যমে জলবায়ুসৃষ্ট দুর্যোগ কমানো ছাড়া উপায় নেই।

অবাক করা বিষয় হলো, বাংলাদেশের সুন্দরবনসহ পুরো বনাঞ্চল যেমন জলবায়ুগত দুর্যোগ মোকাবিলায় ভূমিকা রাখছে সেই সুন্দরবনই আবার জলবায়ু সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে। তথ্য মতে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৫০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেলে ম্যানগ্রোভ বনের অর্ধেকের বেশি এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যাবে। আর সুন্দরবনের ক্ষতি মানেই কার্বনের পরিমাণ বৃদ্ধি ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি। বন রক্ষা না পেলে উপকূল টিকবে না।

বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবন রক্ষাকবচ হিসেবে আমাদের টিকিয়ে রেখেছে। প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, সাইক্লোন ও লবণাক্ততায় উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। উপকূল জুড়ে ঘরবাড়ি, ফসল ও জানমালের ক্ষতি হয়। ভৌগোলিক দিক বিবেচনায় ও জলবায়ুগত তারতম্যের কারণে বাংলাদেশে সুন্দরবন ছাড়া পাহাড়ি বন, শালবন, উপকূলীয় সৃজন করা বন, জলাভূমির বন ও সামাজিক বনায়ন রয়েছে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাংশসহ বিভিন্ন অংশের এসব বন বাংলাদেশকে যেমন বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে চলেছে তেমনি কার্বন শোষণ করে তাপমাত্রার ভারসাম্য বজায় রাখতে ভূমিকা রাখছে। জলবায়ু সমস্যা রোধে ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষায় বনভূমির ভূমিকা সর্বব্যাপী। এককথায় আবহাওয়া বিশুদ্ধকরণ, জলবায়ুসৃষ্ট প্রভাব মোকাবিলায় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ হ্রাসে বনভূমিই ভরসা। তাই বিদ্যমান বনভূমি রক্ষা করার পাশাপাশি নতুন বনভূমি সৃজন করা ছাড়া বিকল্প নেই।

পৃথিবী জুড়ে বনভূমির পরিমাণ কমছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুসারে, পৃথিবীতে যেসব দেশের বনভূমি কমছে বাংলাদেশ তাদের একটি। সংস্থার তথ্য অনুসারে, পৃথিবীর মোট স্থলভাগের প্রায় ৩০ শতাংশ বনভূমি। বৃক্ষনিধনের কারণে প্রতিদিন ২০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বনভূমি হারাতে হচ্ছে। পৃথিবীব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ হিসেবে অনেকাংশে বনভূমি ধ্বংস হওয়া দায়ী। বন্যা, দাবানল, খরা, ভূমিধস ও বিশুদ্ধ পানি সংকটের জন্য পরোক্ষভাবে বনভূমি ধ্বংসকে উল্লেখ করা হয়। আমেরিকার মতো উন্নত দেশে একটার পর একটা দাবানল আঘাত হানছে। দাবানলের ক্ষত না শুকাতেই আবার বন্যার সমস্যা। পৃথিবীর কোনো না কোনো দেশে প্রতিদিন কোনো না কোনো দুর্যোগ আঘাত হানছে।

মিয়ানমার থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ বাংলাদেশের পাহাড়ি বন ধ্বংসে ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া বন কেটে রাস্তা নির্মাণ, গাছ কাটা, বনের মধ্যে ইচ্ছাকৃত আগুন লাগানোর মতো মনুষ্যসৃষ্ট কর্মকাণ্ডের দরুণ বনভূমি কমছে। অনেক বনে আবাসস্থল ও স্থাপনা গড়ার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। বনের লতা-গুল্ম ও ঘাস পুড়িয়ে সবুজ উজাড় করা হয়। অনেক সময় বন ইজারা দেয়া হয়। এমনসব নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের ফলে বনভূমি হারাতে হচ্ছে। জলবায়ুসৃষ্ট দুর্যোগ থেকে বাঁচতে এবং আবহাওয়ার বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে রক্ষা পেতে বনভূমি রক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা উপকূলীয় দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর বনভূমি রক্ষা করতে হবে সবার আগে। বনাঞ্চল ও গাছপালা রক্ষা করা না গেলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। বনভূমি ও বৃক্ষ নিধনের কারণে নদীভাঙন ত্বরান্বিত হবে। আগামীতে আরো বড় ধরনের জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলা করতে হতে পারে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টেকসই, নিরাপদ ও বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে বনভূমি সংরক্ষণ করতে হবে। আর জলবায়ু সমস্যা রোধে উদ্ভিদ ও প্রাণীকুলের অস্তিত্ব রক্ষার উপায় হলো বনজ সম্পদ রক্ষা।

লেখক: শিক্ষক

জনপ্রিয়