ঢাকা শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫ , ২৫ বৈশাখ ১৪৩২ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

গণহ*ত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি কেনো

মতামত

ইমরান ইমন, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০৮:৩০, ২৫ মার্চ ২০২৫

সর্বশেষ

গণহ*ত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি কেনো

আজ ভয়াল ২৫ মার্চ, জাতীয় গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের এই দিন গভীর রাতে অস্ত্র সরঞ্জাম নিয়ে নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইতিহাসের নির্মম নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকহানাদাররা। মাত্র এক রাতে এমন গণহত্যার ঘটনা বিশ্বে নজিরবিহীন।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে পরিচালিত অভিযানে প্রায় এক লাখ বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এরপর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।

এই অপারেশন নির্দেশনামা তৈরি করেন পাকিস্তানের দুই সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। নির্দেশনামার কোনো লিখিত নথি রাখা হয়নি। গণহত্যার সেই পুরো নির্দেশ মুখে মুখে ফরমেশন কমান্ডার বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানো হয়। দীর্ঘ সময় পরে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ‘অ্যা স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওউন কান্ট্রি: ইস্ট পাকিস্তান, ১৯৬৯-১৯৭১’ নামে তার আত্মজীবনী প্রকাশ করেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত সে আত্মজীবনীতে প্রথমবারের মতো অপারেশন সার্চ লাইট সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়।

অপারেশন সার্চলাইট কীভাবে পরিকল্পিত হয়, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের সেই স্মৃতিচারণ করে খাদিম হোসেন রাজা লিখেছেন, ‘১৭ মার্চ, সকাল প্রায় ১০টা বাজে। টিক্কা খান আমাকে ও মেজর জেনারেল ফরমানকে কমান্ড হাউসে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে খবর পাঠান। খবর পেয়ে আমরা দুজন টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করি। গিয়ে দেখি, সেখানে জেনারেল আবদুল হামিদ খানও রয়েছেন। টিক্কা খান আমাদের বলেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ মুজিবের সমঝোতা আলোচনা ইতিবাচক দিকে এগোচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট চান আমরা যেনো সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করি এবং সে অনুযায়ী একটা পরিকল্পনা তৈরি করি। এ ছাড়া আর কোনো মৌখিক বা লিখিত নির্দেশনা আমরা পাইনি। আমাদের বলা হয়, পরদিন ১৮ মার্চ বিকেলে আমরা দুজন যেনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ওই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করি।’

পরদিন সকালেই খাদিম হোসেন রাজা তার কার্যালয়ে রাও ফরমান আলীকে নিয়ে বসেন। তারাই গণহত্যার এ অভিযানের নাম দেন ‘অপারেশন সার্চ লাইট’। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ২৫শে মার্চকে ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস এখন শুধু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বাকি।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও কেনো ২৫ মার্চের গণহত্যা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি? এর কারণ হলো, এ নিয়ে ওভাবে কেউ মাথা ঘামায়নি, চেষ্টা করেনি।

বাংলাদেশে ২৫ মার্চের গণহত্যাকে‌ জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির আগে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য ইউনেসকোও চিঠি পাঠানো হয়েছিলো। সে চিঠির জবাবে জানতে চাওয়া হয়েছিলো, বাংলাদেশে কি ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা হয়? আমাদের উত্তর ছিলো, হয় না। পরে জবাব এলো, যেটা বাংলাদেশ জাতীয়ভাবে পালন করে না সেটা আন্তর্জাতিকভাবে কেনো জাতিসংঘকে পালন করতে হবে?

২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে না হয়ে আরো বহু আগে ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির দরকার ছিলো।‌ অনেক দেরি হয়ে গেছে আমাদের। সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানি গোষ্ঠী ও এদেশীয় দোসররা মিলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির খেলায় মেতে ওঠে। জুনায়েদ আহমেদ নামে এক পাকিস্তানি লেখক তার ‘ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ: মিথস এক্সপ্লোডেড’ নামে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানি এজেএ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত বইয়ে ২৫ মার্চের গণহত্যার ছবিকে বাংলাদেশিদের হাতে বিহারী হত্যা বলে চালানোর অপচেষ্টা করেছে। এই বইয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দোষারোপ করা হয়েছে এই বলে যে, একাত্তরে ২৫ মার্চের গণহত্যার জন্য মুক্তিযোদ্ধারাই দায়ী।

অথচ ২৫ মার্চের গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব-পাকিস্তানের সংকট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিলো তাতে বলা হয়: ‘১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত ১ লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিলো।’

দেশ স্বাধীনের পর থেকে গণহত্যাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ব্যাপারে দেশের বাইরে কোনো প্রকার কার্যক্রম বা জনমত গড়ে তোলা হয়নি। তা ছাড়া দেশের ভেতরে গণহত্যা নিয়ে ওভাবে কোনো  কাজও হয়নি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারের উদাসীনতাও এর অন্যতম কারণ।

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, আর্মেনিয়ার গণহত্যাকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ানোর জন্য আর্মেনিয়ানরা ১০০ বছর ধরে সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আর্মেনিয়ানরা এটি নিয়ে রীতিমতো আলাপ-আলোচনা ও জনমত গড়ে তুলেছে। আমরা তা করতে পারিনি বলে ২৫ মার্চের গণহত্যার এখনও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি। অথচ বাংলাদেশের ২৫ মার্চের গণহত্যা বিশ্বের উল্লেখযোগ্য গণহত্যাগুলোর একটি। সরকারের একক প্রচেষ্টায় সেটা সম্ভব হয়ে ওঠবে না। এর জন্য দেশ ও বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালিদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।

২১ ফেব্রুয়ারির আমরা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করেছি। ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এটা সম্ভব হয়েছে কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে। ২৫ মার্চের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়েও আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। দেশকে রক্ষা করতে জাতির যেসব সূর্যসন্তান জীবন বিসর্জন দিয়েছেন তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

জনপ্রিয়