
বর্তমান বিশ্ব প্রযুক্তিনির্ভর। ইন্টারনেট, স্মার্টফোন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তরে ঢুকে গেছে। ভার্চুয়াল জগতে আমরা এতটাই নিমগ্ন যে বাস্তব জীবন, সম্পর্ক, মনুষ্যত্ব ও আধ্যাত্মিকতা দিন দিন ক্ষীয়মান হচ্ছে। এ অবস্থায় ‘ডিজিটাল ডিটক্স’- অর্থাৎ প্রযুক্তি থেকে কিছু সময় দূরে থাকা ও মানসিক প্রশান্তি অর্জনের প্রক্রিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
ইসলাম চায় ভারসাম্যপূর্ণ জীবন। যেখানে মানুষ ইবাদত, আত্মীয়তা, শিক্ষা, কাজ ও বিশ্রাম– সবকিছুর সমন্বয় ঘটিয়ে চলে। এই ভারসাম্য বিনষ্ট হলে শুধু আত্মিক নয়, দেহ-মনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই ইসলাম ও আধুনিক বিজ্ঞান উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই ডিজিটাল ডিটক্সের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। ইসলামের মূল শিক্ষা হলো প্রতিটি ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা ও ভারসাম্য রক্ষা। মহান আল্লাহ বলেন: এবং এভাবেই আমি তোমাদেরকে একটি মধ্যপন্থী উম্মত বানিয়েছি। (সুরা বাকারা: ১৪৩) জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা প্রযোজ্য। সময় ব্যবস্থাপনা, দৈনন্দিন আমল-ইবাদত, কাজ, ঘুম, ও বিনোদনে। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তি ব্যবহারে এই ভারসাম্য নষ্ট হয়, ভেঙে পড়ে।
বেশি সময় স্ক্রিনে কাটালে বিষণ্নতা (depression), উদ্বেগ (anxiety), নিঃসঙ্গতা (loneliness) দেখা যায়। হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘ সময় ফোন/স্ক্রিন ব্যবহারে ডোপামিন ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়। যার ফলে মানুষ দ্রুত বিরক্ত, ক্লান্ত ও অনভিপ্রেত আচরণে লিপ্ত হয়।
‘আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’ জানায়, সপ্তাহে অন্তত এক দিন স্ক্রিনমুক্ত জীবন যাপন মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। হার্ভার্ডের ডিজিটাল ওয়েলনেস ল্যাব’র মতে, নির্দিষ্ট সময় ফোন বন্ধ রাখা ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার সীমিত রাখা মস্তিষ্ককে সতেজ রাখে।
অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেয়। অথচ পাঁচ ওয়াক্ত সালাত সময়মতো আদায় করার প্রয়োজনবোধ করে না। রাসুল (সা.) বলেন: দুইটি এমন নেয়ামত আছে, অধিকাংশ মানুষ এগুলোর ব্যাপারে ধোঁকায় পড়ে যায়— নেয়ামত দুটি হলো, স্বাস্থ্য ও অবসর। (সহিহ বুখারি: ৬৪১২)
চোখ কান মন-মস্তিষ্ক মহান আল্লাহর প্রদত্ত নেয়ামত। এই নেয়ামত কোন কাজে ব্যবহার করছি হাশরের দিন তার জবাব দিতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন: নিশ্চয়ই কান, চোখ ও অন্তর- এর প্রতিটি সম্পর্কে (তোমাদেরকে) জিজ্ঞেস করা হবে। (সুরা ইসরা: ৩৬)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন: তোমরা অপচয় করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না। (সুরা আরাফ: ৩১) প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহারও এক ধরনের অপচয়, সময় ও শক্তির অপচয়। তাই আত্মসংযমের মাধ্যমে ভার্চুয়াল জগতের আসক্তি থেকে বের হয়ে আসার নামই ডিজিটাল ডিটক্স।
রাসুলুল্লাহ (সা.) সময়ের মূল্য বুঝতেন। তিনি সময়ের যত্ন নিতেন। তাঁর ঘুম, খাবার গ্রহণ, ইবাদত ও সফর- সব কিছুতেই ছিল সুশৃঙ্খলতা। সুতরাং আমরা সময় ব্যবহারে যত্নবান হব। প্রতিটি কাজের জন্য সময় নির্ধারণ করে নিব। মোবাইল ব্যবহারের জন্যও নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত করব। সপ্তাহে অন্তত একদিন ভার্চুয়াল দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ আলাদা থেকে আত্ম-উন্নয়ন, দোয়া, ইবাদত, পরিবার ও প্রকৃতির সাথে সময় কাটানো। এভাবে ‘ডিজিটাল ইতিকাফ’ হতে পারে।
ভার্চুয়াল জগতে আমাদের জীবন আজ অনেকটাই আবদ্ধ। কিন্তু আমরা মানুষ;যন্ত্র নই। আমাদের হৃদয়, আত্মা ও বিবেকের শান্তি, সংযোগ ও আত্মিক উন্নয়ন প্রয়োজন। ইসলাম সেই ভারসাম্যপূর্ণ পথ দেখায় যা মানুষকে ভার্চুয়াল জগৎ নয়, বাস্তব জীবনের সৌন্দর্য, আত্মশুদ্ধি এবং পরকালীন সাফল্যের দিকে আহ্বান করে। সুতরাং, ডিজিটাল ডিটক্স কেবল আধুনিক থেরাপি নয়, বরং ইসলামেরই অন্তর্নিহিত শিক্ষা।
লেখক: শিক্ষক ও অনুবাদক