ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ , ৫ বৈশাখ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

nogod
nogod
bkash
bkash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
nogod
nogod
bkash
bkash

বাল্যবিয়ের উদ্বেগজনক বিস্তার : কর্তৃপক্ষের নজরদারি জরুরি 

মতামত

মো. জিল্লুর রহমান

প্রকাশিত: ০০:০০, ৯ মে ২০২৩

সর্বশেষ

বাল্যবিয়ের উদ্বেগজনক বিস্তার : কর্তৃপক্ষের নজরদারি জরুরি 

বাল্যবিবাহ শব্দটির সঙ্গে শৈশব কৈশোরের একটা সম্পর্ক রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যাগুলোর মধ্যে বাল্যবিয়ে প্রধানতম একটি। একসময় বাল্যবিয়ে বাংলাদেশে মহামারী আকার ধারণ করেছিলো। সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ ও তদারকির কারণে বাল্যবিয়ে অনেকটা নিয়ন্ত্রণেও আসে। কিন্তু করোনা অতিমারীর কারণে এ যেন আবার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের জন্য শব্দটা আজ অনেকটা বিভীষিকাময়। অনেকে বলেন, এটি একটি সামাজিক অভিশাপ। কিন্তু সংশ্লিষ্ট অভিভাবকরা এটিকে সামাজিক বাস্তবতা বলে অভিহিত করে থাকেন।
বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য, শিশুমৃত্যু, মানুষের গড় আয়ু ও মাতৃস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বেশ কিছু অগ্রগতি  হলেও বাল্যবিয়ের হার কোনভাবেই কমানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাল্যবিয়ের হার এখনো শীর্ষে। এটি মাতৃস্বাস্থ্য ও শিশুস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও মারাত্মক হুমকি। সম্প্রতি জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) ‘৮০০ কোটি জীবন, অপরিসীম সম্ভাবনা’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন গত ১৯ এপ্রিল বৈশ্বিকভাবে প্রকাশিত হয়। বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি–২০২৩ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৮ বছরের আগেই ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, যা খুবই উদ্বেগজনক চিত্র। ২০০৬ থেকে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাল্যবিবাহের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। 
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের (বিডিএইচএস) প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৭-১৮ খ্রিষ্টাব্দে বাল্যবিয়ের হার ছিলো ৫৯ শতাংশ। কিশোরী মায়ের গর্ভধারণের হার ছিলো ২৮ শতাংশ; যা ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে ছিলো ৩১ শতাংশ। কিন্তু করোনাকালে এ সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা করেছিলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এক জরিপেও দেখা গিয়েছিলো, ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম ১০ মাসের তুলনায় ২০২০ এর প্রথম ১০ মাসে বাল্যবিয়ে বেড়েছিলো ৬৮ শতাংশ। আসলে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও সেই আশঙ্কাজনক চিত্রটিই ভেসে উঠেছে।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম বাল্যবিবাহ ঘটছে মালদ্বীপে— মাত্র ২ শতাংশ। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কায় ১০, পাকিস্তানে ১৮, ভারতে ২৩, ভুটানে ২৬, আফগানিস্তানে ২৮ এবং নেপালে ৩৩ শতাংশ বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটছে। তবে বিশ্বে বাল্যবিয়ের দিক থেকে এক ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান এখন পঞ্চমে। গত বছরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো ষষ্ঠ। নতুন প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পাশাপাশি পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বুরকিনা ফাসোর অবস্থানও পঞ্চম। আফ্রিকার আরও পাঁচটি দেশ শীর্ষ চার অবস্থানে রয়েছে। নাইজারে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে হয় এবং এ হার ৭৬ শতাংশ। এরপর ৬১ শতাংশ বাল্যবিয়ের হার নিয়ে যৌথভাবে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র (সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক) ও চাদ। এরপর আছে মালি (৫৪ শতাংশ), মোজাম্বিক (৫৩ শতাংশ) ও দক্ষিণ সুদান (৫২ শতাংশ)। তবে বাল্যবিয়ে একদম নেই সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, বেলজিয়াম, লিথুয়ানিয়া এবং যুক্তরাজ্য ও উত্তর আয়ারল্যান্ডে।
করোনার অতিমারীর কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা স্কুলবিমুখ হয়ে পড়েছিলো। বিশেষত মেয়ে শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা তখনই আশঙ্কা করেছিলেন, বিদ্যালয় খুলতে দেরি হওয়ার কারণে বাল্যবিবাহের মতো সমস্যা আরও প্রকট হতে পারে। বৈশ্বিক পরিসংখ্যান বলছে, সংঘাত, দুর্যোগ কিংবা মহামারির সময় বাল্যবিয়ের সংখ্যা বাড়ে। করোনা অতিমারীর আগে বাংলাদেশে ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতো এবং করোনার কারণে আরও ২৩ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে গেছে বলে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন। তাই বাল্যবিয়ের ঝুঁকি এ সময়ে অনেক বেড়ে গিয়েছিলো। সরকারের পক্ষ থেকেও স্বীকার করা হয়েছে, করোনা অতিমারীর কারণে বাল্যবিয়ে পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। ওই সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিলো এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রমও সীমিত ছিলো। এখন সব কার্যক্রম পূর্ণোদ্যমে শুরু হয়েছে, এটার ফল পেতে কিছুটা হলেও সময় লাগবে। 
করোনা মহামারির সময় দেশে বাল্যবিবাহের হার যে বেড়ে গিয়েছিলো, তা বিভিন্ন জরিপেও ফুটে উঠেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাল্যবিয়ের ওপর ইউএনএফপিএর এক জরিপ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার ২০২১ এর আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি। কোভিডের প্রাদুর্ভাবে ওই দুই বছর এই বয়সী প্রায় ২৭ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়েছিলো।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল বা ইউনিসেফের তথ্যে বলেছে, বিগত বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশেই বাল্যবিয়ের প্রচলন এখনও সবচেয়ে বেশি, যা বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যেও রয়েছে। যদিও বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের প্রবণতা ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের তুলনায় ৯০ শতাংশেরও বেশি কমেছে, তা সত্ত্বেও এখনও এই হার অনেক বেশি। বর্তমানে ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের ৫১ শতাংশের বিয়ে হয়েছে তারা শিশু থাকা অবস্থাতেই। এটি এই দেশকে ৩ কোটি ৮০ লাখ ‘শিশু কনের’ দেশে পরিণত করেছে, যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের ১৮তম জন্মদিনের আগেই। আবার এদের মধ্যে ১ কোটি ৩০ লাখ নারীর বিয়ে হয়েছে তাদের বয়স ১৫ বছর হওয়ার আগেই।
ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে বন্ধে জোরদার পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়, বাল্যবিয়ে বন্ধ করা বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফ উভয়েরই একটি অগ্রাধিকার। তবে ২০৩০ এর মধ্যে বাল্যবিয়ে বন্ধের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) এবং ২০৪১ এর মধ্যে বাল্যবিয়ে বন্ধের জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশে আরও পরিবর্তন আনার প্রয়োজন রয়েছে। জাতীয় লক্ষ্য পূরণের জন্য বাল্যবিয়ে বন্ধের হারে অগ্রগতি গত দশকের তুলনায় কমপক্ষে ৮ গুণ এবং এসডিজির লক্ষ্য পূরণের জন্য ১৭ গুণ দ্রুততর করতে হবে।
ইউনিসেফের মতে, একসঙ্গে অবশ্যই ক্ষতিকর রীতিনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে হবে এবং বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে হবে। মানবাধিকারের এই লঙ্ঘন ব্যক্তি ও সমাজের জন্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি বয়ে আনছে, যা শিশুদের কাছ থেকে তাদের শৈশব ছিনিয়ে নিচ্ছে এবং নিজের পছন্দের জীবন বেছে নেয়ার সুযোগ সীমিত করে দিচ্ছে। মেয়েদের বেঁচে থাকা ও শিক্ষা গ্রহণের অধিকার সুরক্ষিত রাখতে এবং তাদের সহিংসতা ও নিগ্রহের শিকার হওয়া কমাতে এখনই সংশ্লিষ্ট পক্ষকে বিনিয়োগ করতে হবে।
ইউনিসেফ সামাজিক রীতিনীতির পাশাপাশি আইন ও নীতিমালার মতো লিঙ্গ বৈষম্যের কাঠামোগত কারণগুলোকে পরিবর্তন করতে সরকার, সুশীল সমাজ ও এনজিওসহ অংশীদারদের একটি বিস্তৃত জোটের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করে। এটি মেয়েদের স্কুলে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন বিকল্প থেকে নিজের পছন্দের জীবন বেছে নেয়ার সুযোগ করে দেয়। প্রথাগত এবং ডিজিটাল উভয় প্ল্যাটফর্মে কিশোরীদের প্রতিনিধিত্ব ও দাবি-দাওয়া তুলে ধরার মাধ্যমে ইউনিসেফ তাদের ক্ষমতায়নেও কাজ করে।
বাল্যবিবাহের যে সমস্ত কারণ রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দরিদ্রতা, অশিক্ষা, সচেতনতার অভাব, প্রচলিত প্রথা ও কুসংস্কার, সামাজিক অস্থিরতা, যৌন নিপীড়ন, মেয়েশিশুর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, নিরাপত্তার অভাব, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, যৌতুক প্রথা এবং বাল্যবিয়ে রোধ-সংক্রান্ত আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া। বাল্যবিয়ের কারণে অপরিণত বয়সে সন্তান ধারণ, মাতৃমৃত্যুর হার বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যহানি, তালাক, পতিতাবৃত্তি, অপরিপক্ক সন্তান প্রসবসহ নানাবিধ জটিলতার শিকার হচ্ছে। তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাল্যবিয়ের সঙ্গে মাতৃমৃত্যুর একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে হলে প্রজননস্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে। আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে বাল্যবিয়ে পরিস্থিতি উন্নয়নে আশানুরূপ কোনো অর্জন নেই। এর পেছনে শুধু দারিদ্র্য নয়, সামাজিক আচার আচরণও দায়ী। এখনো কম বয়সে বিয়ে দেয়াকে ভালো বলে মনে করা হয়। এ পরিস্থিতি রোধে মেয়েদের উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক করে উপবৃত্তি দেয়া দরকার।
১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের বাল্যবিয়ে আইন ২০১৭ তে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনে রূপান্তরিত হয়। ২০১৭ তে বাল্যবিয়ে আইন সংশোধন করা হলেও এখনো গ্রামগঞ্জ-মফস্বল এলাকাসহ সারা দেশে বাল্যবিয়ে হচ্ছে অহরহ। এ আইনে বাল্যবিয়ের সংজ্ঞায় ছেলেমেয়ের বিয়ের বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশ সরকার সর্বশক্তি দিয়ে বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে, এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচারও করছে। বাল্যবিয়ে বন্ধের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন এনজিও সংগঠনের কার্যক্রমও পরিপূরক ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও কার্যকরভাবে বাল্যবিয়ের ছোবল রোধ করা যাচ্ছে না। অনেকে অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক ছেলে মেয়েদের বয়স বাড়িয়ে জন্ম নিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করে বাল্যবিয়ে রেজিস্ট্রেশন করছেন। তাদের যুক্তি হচ্ছে দরিদ্র্যতা কিংবা যৌন নিপীড়ন থেকে রক্ষা পেতে তারা বাস্তবতার নিরিখে এসব করতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকে এটাকে সামাজিক বাস্তবতার সাথে তুলনা করছেন। ফলে বেড়ে যাচ্ছে বিবাহ বিচ্ছেদ, বহুবিবাহ, নারী-নির্যাতন, পরকীয়া, আত্মহত্যা, পুষ্টিহীন ও প্রতিবন্ধী শিশুপ্রসব এবং গর্ভজনিত ও অপুষ্টিজনিত মৃত্যু। উদ্ভূত এসব সমস্যা মোকাবিলায় সরকারকে প্রতিনিয়ত ব্যতিব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। বাল্যবিয়ে রোধে সর্বপ্রথম দরকার পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধি এবং দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অগ্রসর ভূমিকা। শুধু সরকারের একার পক্ষে নয়, সবার সম্মিলিত প্রয়াসই কেবল রুখে দিতে পারে বাল্যবিয়ের এই বিপজ্জনক ঊর্ধ্বমুখীতা।

লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট

জনপ্রিয়