ঢাকা শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫ , ৪ বৈশাখ ১৪৩২ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

বুড়িগঙ্গা নদীর সুখ-দুঃখ 

মতামত

সাধন সরকার, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০০:০০, ৩০ অক্টোবর ২০২৪

সর্বশেষ

বুড়িগঙ্গা নদীর সুখ-দুঃখ 

একসময় বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেতো, পানিতে কোনো দুর্গন্ধ ছিলো না। নদীর পানির রং ছিলো স্বচ্ছ, নদীতে স্নান করত স্থানীয়রা। জোয়ারের সময় নদীর উত্তাল ঢেউ ছিলো মনোমুগ্ধকর। ক্ষেত্রবিশেষে বিভিন্ন কাজে পানিও ব্যবহার করা হতো। কিন্তু সেসব এখন দূর অতীতের বিষয়। আগের মতো নদীর সেই যৌবনভরা উচ্ছ্বাস আর হৃদয় ছোঁয়া টান নেই। প্রায় ৪০০ বছর আগে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরেই ঢাকা শহরের গোড়াপত্তন হয়েছিলো। বুড়িগঙ্গা মূলত ধলেশ্বরী নদীর শাখা। বুড়িগঙ্গা সাভারের দক্ষিণে ধলেশ্বরী থেকে বের হয়ে ফতুল্লার দক্ষিণে আবারও ধলেশ্বরীর সঙ্গে মিশেছে। যদিও উৎসমুখটি অনেক আগেই ভরাট হয়ে গেছে। অনেক ইতিহাস ও ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে বুড়িগঙ্গা নদীর সঙ্গে। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে ইউরোপের বিখ্যাত বণিক টেইলর বুড়িগঙ্গা নদীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন, ‘বর্ষাকালে যখন বুড়িগঙ্গা পানিতে ভরপুর থাকে তখন দূর থেকে ঢাকাকে দেখায় ভেনিসের মতো।’ কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার বুড়িগঙ্গাকে বর্ণনা করেছেন এভাবে- ‘সমালয় সন্নিহিত/বুড়িগঙ্গা প্রবাহিত/বান্দাঘাট শোভিত যাহাতে/সেখানে বসিয়ে গিয়া/জুড়ায়া সন্তপ্ত হিয়া/সলিল শিকারসিক্ত রাতে।’ প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ নদী বুড়িগঙ্গা। এর গড় প্রশস্ততা প্রায় ৪০০ মিটার। গভীরতা প্রায় ৪০ মিটার (যদিও বর্তমানে গড় গভীরতা ১০ মিটার)। ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে এর পানিপ্রবাহের পরিমাণ সর্বোচ্চ ২ হাজার ৯০২ কিউসেক থাকলেও বর্তমানে তা অর্ধেকে এসে ঠেকেছে (বাংলাদেশের নদী, মোকারম হোসেন)।

ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা। বলা হয়ে থাকে হাডসন তীরে যেমন নিউইয়র্ক, টেমসের তীরে যেমন লন্ডন, সেইনের তীরে প্যারিস, তেমনই বুড়িগঙ্গার তীরে ঢাকা। ঢাকার দক্ষিণ ও পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা। সলিল সমাধির পুরাতন অনেক কাহিনী বর্ণিত আছে এ নদীকে ঘিরে। কালে কালে যে কত-শত প্রভাবশালীর প্রভাব, অহংকারীর অহংকার এই বুড়িগঙ্গায় বিলীন হয়েছে তা কে জানে। মুঘল আমলে ১৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দে বুড়িগঙ্গার ওপর যে সেতু তৈরি হয়েছিলো সেটি এখন পাগলার পুল নামেই পরিচিত।

সেই সময়ে বুড়িগঙ্গার দু’তীরে গড়ে ওঠেছে নামকরা সব ভবন ও স্থাপনা। নদীর উত্তরপাড়ের তীরে নির্মিত হয়েছে পোস্তা প্রাসাদ(যদিও এখন বিলীন), সদরঘাট নৌবন্দর, পুরান কেল্লা(জেলখানা নামেই পরিচিত ছিলো), চকবাজার, সাত মসজিদ, মিলব্যারাক, বাকল্যান্ড বাঁধ, আহসান মঞ্জিল, নথব্রুক হল, রূপলাল হাউস, নওয়াববাড়ি, বড়কাটরা, ছোটকাটরা, নীলকুঠি, লালবাগ কেল্লাসহ আরো অনেক স্থাপনা। নদীর ওপারে জিঞ্জিরা প্রাসাদ। 

১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে নদী ভাঙন ও বন্যা থেকে ঢাকাকে রক্ষাসহ ঘাটমুখে পলি জমা রোধ করার জন্য যে বাকল্যান্ড বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে তা মোটামুটি ভালোভাবেই অক্ষত আছে।  জানা যায়, একসময় স্বচ্ছ জলরাশি ও মনোরম পরিবেশের জন্য দেশ-বিদেশি পর্যটক ও ব্যবসায়ীরা ঢাকায় ভিড় জমাতেন। ধীরে ধীরে আরব, পর্তুগিজ, ফরাসি, ওলন্দাজ, গ্রিক, আর্মেনীয় ও ব্রিটিশদের প্রিয় স্থান হয়ে পড়ে বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা ঢাকা। ব্রিটিশ আমলে বুড়িগঙ্গার বুকে প্রচুর স্টিমার-লঞ্চ দেখা যেতো।

ঢাকা থেকে মালামাল ভর্তি নৌকা যেতো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। বুড়িগঙ্গা হয়ে বার্মার রেঙ্গুন ও ভারতের কলকাতা দিয়ে নৌকা চলাচল ছিলো (আপেল মাহমুদ, ২০১৫)। পর্যটক ও সওদাগরদের থাকা-খাওয়ার জন্য মুঘল সুবেদার শাহ সুজা ১৬৬৪ খ্রিষ্টাব্দে বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে তুলেছিলেন বড় কাটরা। যতই ঢাকা শহরের উন্নয়ন ও পরিবর্তন হয়েছে ততই যেনো বুড়িগঙ্গার অবস্থা খারাপ হয়েছে। বিষাক্ত হয়ে গেছে বুড়িগঙ্গার পানি। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ এতই কম যে এখানে মাছ বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব। ঢাকা শহরের উন্নয়নে বিভিন্ন সময় নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হলেও বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে পরিকল্পিত ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।

ফলে বুড়িগঙ্গা তার সৌন্দর্য হারিয়ে এখন দূষণে জর্জরিত। মানববর্জ্য, নদী তীরের কারখানার শিল্পবর্জ্য, হাসপাতালের বর্জ্য, নৌবর্জ্য, পোশাক শিল্পের বর্জ্য, পলিথিন-প্লাস্টিক বর্জ্য, নদী তীরের জাহাজ নির্মাণের বর্জ্য, গৃহস্থালি বর্জ্য ও বিভিন্ন স্যুয়ারেজ লাইনের ময়লা-আবর্জনার দূষণে বুড়িগঙ্গা নদীর অবস্থা মৃতপ্রায়। পরিবেশ ছাড়পত্র নেই এমন অনেক ডায়িং কারখানা নদীকে দূষণ করছে। নদীর দু’তীর দখল করে গড়ে ওঠেছে বহু স্থাপনা। ফলে নদীর দু’তীর ক্রমেই সংকুচিত হয়েছে। বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল অনেক আগেই ভরাট হয়ে গেছে।

বুড়িগঙ্গার মূল নদীতে এখন মাঝে মাঝে চর দেখা যায়। দিন দিন এই নদীর পানি প্রবাহ কমছে। দূষণ ও দখলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা হলেও তাতে নদীর দখল-দূষণ কমেনি। নদী তীরের স্থানীয় প্রভাবশালীরাই মূলত নদী দখল-দূষণের সঙ্গে যুক্ত। নদীটিকে দখল-দূষণের হাত থেকে বাঁচাতে বিভিন্ন সময় নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হলেও তার কোনোটাই পরিকল্পিত ও কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। একসময় বুড়িগঙ্গার তীরে ট্যানারি শিল্প ছিলো, এখন সেটা সাভারে ধলেশরীর তীরে চলে গেছে। তবুও বুড়িগঙ্গার দূষণ রোধ করা যায়নি।

বুড়িগঙ্গা নদীকে বাঁচানো না গেলে ঢাকা শহরও টিকে থাকবে- এমনটি মনে করা ঠিক হবে না। কত-শত ইতিহাস, ঐতিহ্য ধারণ করে দশকের পর দশক অত্যাচার সহ্য করে এখনো বয়ে চলেছে বুড়িগঙ্গা। বর্ষাকালে বুড়িগঙ্গা নদী কিছুটা হলেও তার যৌবন ফিরে পায়। ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নৌযোগে যাত্রী ও মালামাল প্রতিদিন বহন করে চলেছে বুড়িগঙ্গা। নদীর ওই পাড়ের কেরানীগঞ্জের সাথে ঢাকার ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রেখেছে বুড়িগঙ্গা।

বুড়িগঙ্গার বুকে ইট-বালুবাহী লঞ্চ-কার্গোর চলাচল অবিরাম। মোটকথা ঢাকার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় একটা অংশই হয় বুড়িগঙ্গা দিয়ে। পৃথিবীর বড় বড় শহরের মধ্যে অথবা পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীকে দখল ও দূষণমুক্ত করে বিনোদনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে এবং হচ্ছে। বুড়িগঙ্গা নদীকে ঘিরে এমনটি করা হলে নদী যেমন বাঁচবে তেমনি নগরবাসীর বিনোদনের চাহিদাও পূরণ হবে।

লেখক: জলবায়ু ও পরিবেশকর্মী

জনপ্রিয়