
গতানুগতিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে আসা কারিকুলামের মতো যদি বর্তমান নতুন কারিকুলামটিও পরিমার্জিত কারিকুলাম হতো তাহলে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে কারিকুলাম বিস্তরণের প্রশিক্ষণ যে মাত্রায় দেয়া হয়েছে সে মাত্রায় সেসকল স্টেকহোল্ডারের মাঝে শিক্ষাক্রম বিস্তরণের উদ্দেশে প্রশিক্ষণ দিলেই হতো। কিন্তু শিক্ষাক্রম নিয়ে বিভিন্ন নেতিবাচক কথা উঠছে নানা মহলে। এটা এমন সময় হচ্ছে যখন প্রায় ৩০০ বছর ধরে চলে আসা কারিকুলামের খোলনলচে পাল্টে ফেলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপযোগী বাংলাদেশি তৈরির জন্য নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে নামা হয়েছে। পূর্বের ২০১০ এর শিক্ষাক্রমের ন্যায় স্বল্প পরিসরে শিক্ষাক্রম বিস্তরণের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে এটা করা হচ্ছে। যেহেতু শিক্ষাক্রম নতুন তাই বেশি সংখ্যক স্টেকহোল্ডারের নিকট শুরুতেই বিস্তরণ প্রয়োজন; ধীরে ধীরে নয়।
নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন নিয়ে যেসব দিক তেমন কোনো চ্যালেঞ্জই হওয়ার কথা ছিলো না সেসবই এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ চারিদিক থেকে আংশিক দেখে পুরোটা না বুঝেই - কেউ কেউ কলাম লিখছেন, অভিভাবকরা শঙ্কিত হয়ে নানা আচরণ করছেন। কেউ কেউ সংবাদ সম্মেলন পর্যন্ত করছেন এবং এ সকল স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বিরোধিতা করার মানসিকতা সম্পন্ন একটা শ্রেণিও অবশ্য রয়েছেন যারা সবসময়ই নেতিবাচক কাজ করেন, নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে পানি ঘোলাটে করার জন্য এবং যারা সবসময়ই থাকবেন।
এ সকল স্টেকহোল্ডার কর্তৃক কেনো এতো শক্ত চ্যালেঞ্জ তৈরি হলো তা ব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্টজনের নিকট কম-বেশি অনুমেয়। তাই লেখার কলেবর বৃদ্ধি করে সে ব্যাপারে আর উল্লেখ করতে চাই না। যে স্টেকহোল্ডারদের শিক্ষাক্রম বিস্তরণের প্রশিক্ষণ যে মাত্রায় দিলে এ ধরনের উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ নিরসন করা সম্ভব বলে মনে হয় তা নিম্নরূপ।
১. নতুন শিক্ষাক্রম গত বছর বাস্তবায়নের শুরুতেই শুধু ৬ষ্ঠ এবং ৭ম শ্রেণির শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ না দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষককে (পাঠদানের সঙ্গে যিনি যেকোনোভাবে সম্পৃক্ত) প্রশিক্ষণ দেয়া গেলে ভালো হতো, যেটা দেরিতে হলেও এ বছর করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
২. যেহেতু ৩০০ বছরের মধ্যে বড় ধরনের একটা পরিবর্তন এ কারিকুলাম, তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বাদে অন্য পদের কর্মচারীদেরও তাদের উপযোগী করে সংক্ষিপ্ত আকারে কারিকুলাম রূপরেখা এবং শিখন-শেখানোর পদ্ধতির ওপরে এক দিন হলেও প্রশিক্ষণ দেয়া উচিত। নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে চোখে পড়ে এমন সাধারণ দিকগুলো দ্রুত বিস্তরণের সুবিধার্থেই এ কাজ করা উচিত।
৩. প্রতিষ্ঠান প্রধানদেরকে শুধু কারিকুলাম রূপরেখা-২০২১ এর ওপর প্রশিক্ষণ না দিয়ে একাডেমিক শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা সম্পর্কেও স্বচ্ছ ধারণা দেয়া প্রয়োজন।
৪. সহকারী প্রতিষ্ঠান প্রধানদেরকেও প্রতিষ্ঠান প্রধানদের মতো টপিক অন্তর্ভুক্ত করে প্রশিক্ষণ দেয়া উচিত।
৫. প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ/ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষে আগ্রহীদের আবেদন প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়ে সভাপতিসহ ডিগ্রিধারী সকলকে সম্ভব হলে প্রশিক্ষণ দেয়া উচিত শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ সহজপাঠ্য করে তুলে ধরে তার সঙ্গে একাডেমিক শিখন-শেখানো অংশ যেমনভাবে পরিচালিত হচ্ছে তা তুলে ধরে একটা প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল প্রস্তুত করে।
৬. ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রশিক্ষণ ম্যানুয়ালের ন্যায় একটা ম্যানুয়াল প্রস্তুত করে প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আগ্রহী অভিভাবকদের একটা অংশকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা উচিত।
৭. যেসকল শিক্ষা কর্মকর্তা কারিকুলাম রূপরেখা ২০২১ ছাড়াও একাডেমিক শিখন-শেখানো কার্যক্রমের ওপর কমপক্ষে ৫/৭ দিনের প্রশিক্ষণ পাননি তাদের পুণরায় কমপক্ষে ৪ দিনের প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা উচিত।
এমতাবস্থায় কারিকুলাম ডিসেমিনেশন স্কিমে প্রশিক্ষণ ব্যয় বৃদ্ধি করার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। আর যেহেতু কারিকুলাম ডেসিমিনেশন স্কিমে প্রশিক্ষণ বাজেট বাবদ একটা পরিমাণ অর্থ অনুমোদিত হয়ে আছে তাই বললেই প্রশিক্ষণ বাজেট বৃদ্ধি করা রাতারাতি সম্ভব নয় সেহেতু বিদ্যমান প্রশিক্ষণ বাজেটের ব্যয় বিভাজনে একটু পরিবর্তন এনে আরো বেশিসংখ্যক স্টেকহোল্ডারকে বেশিদিনের প্রশিক্ষণ দেয়া যায় কি না তা ভেবে দেখা যেতে পারে।
দেরিতে হলেও ব্যাপক আকারে বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে বর্তমানে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে যে একটা বোঝাপড়াহীন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা কেটে যাবে বলে আমার ধারণা। কেনোনা অবস্থাদৃষ্টে যা মনে হচ্ছে তা হচ্ছে প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষক/কর্মকর্তা/ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রভাবশালী সদস্য/শিক্ষিত অভিভাবকদেরকে যখন কেউ কিছু একটা বোঝার জন্য নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে প্রশ্ন করছেন আর যখন তাদের মধ্যে কেউ নেগেটিভ উত্তর দিচ্ছেন তখন নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে বেশি মাত্রায় নেগেটিভ গুজব ছড়াচ্ছে।
লেখক: থানা একাডেমিক সুপারভাইজার, বাড্ডা, ঢাকা