আজ রোববার বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস। বিশ্ব জুড়ে শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধিতার শিকার মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও সুরক্ষার অঙ্গীকার নিয়ে উদযাপন হতে যাচ্ছে ৩২ তম বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস। বাংলাদেশ এবছর ২৫তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস উদযাপন হবে। এ বছর প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্মিলিত অংশ গ্রহণ, নিশ্চিত করবে এসডিজি অর্জন’। সারা বিশ্বে প্রায় ৪ বছর ধরে বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ মানব জীবনে যেসব নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে স্বভাবতই প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনকেও তা প্রভাবিত করেছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী নারী, পুরুষ ও তৃতীয় লিঙ্গসহ বাংলাদেশে মোট প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ৩০ লাখ। বর্তমানে তাদের মধ্যে ২৩ লাখ ৮৫০ টাকা করে ভাতা পান। নতুন বাজেটে ভাতা বাড়ানো হয়নি। তবে উপকারভোগী বাড়িয়ে ২৯ লাখকে ভাতা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।
প্রতি বছর আমরা বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে ৩ ডিসেম্বর বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস পালন করে থাকি। কিন্তু প্রতিবন্ধীদের মানবাধিকারের কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা মূল্যায়নের সময় এসেছে। অথচ অন্য সব সাধারণ নাগরিকের মত তাদেরও রয়েছে সমান সুযোগের অধিকার।
প্রতিবন্ধী শব্দটি যেন এক বৈষম্যের প্রতিধ্বনি। শব্দের অর্ন্তগত অর্থ সেই শব্দের নাম নির্দেশ করে থাকে। সেজন্য অন্য শব্দ ব্যবহৃত হলেও হয়তো নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সেই শব্দকেও নেতিবাচক করে তুলবে। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বৈষম্যের উৎপত্তি এবং বৈষম্য থেকে জনবিচ্ছিন্নকরণ। প্রতিবন্ধী নাগরিকরা যেনো সমাজে অন্য সব নাগরিকের মত সমান অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বসবাস করতে পারেন সে বিষয়ে সচেতনতা তৈরি ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রতিবছর বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস পালিত হয়। আর শারীরিকভাবে অসম্পূর্ণ মানুষদের প্রতি সহমর্মিতা ও সহযোগিতা প্রদর্শন ও তাদের কর্মকাণ্ডের প্রতি সম্মান জানানোর জন্যই দিনটি পালন করা হয়। তাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে তাদের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করা খুবই জরুরি। সমাজের অবিচ্ছেদ্য এ অংশকে সব নাগরিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। তবেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম হবেন।
প্রতিবন্ধী মানুষের রয়েছে নানা রকম প্রকারভেদ। শারীরিক প্রতিবন্ধী, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, শ্রবণ প্রতিবন্ধী, বাক প্রতিবন্ধী, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, এমন কি বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়ে বয়স, লিঙ্গ, জাতি, সংস্কৃতি বা সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী এই মানুষগুলো নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে জীবন যুদ্ধ করছে। দুঃখজনক হলেও এটাই চূড়ান্ত বাস্তবতা যে, প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনে রয়েছে পদে পদে বাধা। এরা পৃথিবীর রং, রূপ ও রসের বিলাস-বৈচিত্র্যের বৃত্ত থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। স্বাভাবিক মানুষের ন্যায় সুন্দর এই জীবনটাকে যথাযথ ভাবে উপভোগে বরাবরই অক্ষম। দিকে দিকে যে বিচিত্র কর্মধারা নিত্যপ্রবাহিত, সেখানে যোগদানের ক্ষেত্রেও তারা প্রতিনিয়ত অবহেলিত ও নানা প্রকার প্রতিবন্ধকতার শিকার। ফলে ধীরে ধীরে এদের জীবনে আসে হতাশা। অদৃশ্য শিকলে হাতদুটো যেন বাঁধা পরে যায় অজান্তেই। অনিশ্চয়তার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় সর্বদিক।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯ (১) নম্বর অনুচ্ছেদে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ এদেশের সব নাগরিকের সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা হয়েছে। তাই, দেশের প্রতিবন্ধী জনগণের সার্বিক উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের জনগণ, সংশ্লিষ্ট সব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। তাই একজন প্রতিবন্ধী মানুষকে কেবল প্রতিবন্ধী হিসেবে অনুগ্রহ নয় দিতে হবে মানুষ হিসেবে যথাযোগ্য সম্মান। প্রতিবন্ধীদের যদি মানুষ হিসেবে যথাযোগ্য সম্মান ও সমঅধিকার ও সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা যায় তাহলে তারা দেশ ও জাতীর জন্য বয়ে আনতে পারে অকল্পনীয় সম্ভাবনাময় অর্জন । তাদের অনেকের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে অসাধারণ প্রতিভা। সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং পরিচর্যার মাধ্যমে তাদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটানো সম্ভব।
পরিশেষে বলতে চাই, এ দিনটি উপলক্ষে প্রতিবছর সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সভা সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। তাই আসুন বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসকে সামনে রেখে আমরা সবাই মিলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের সামাজিক দায়িত্ব পালন করি এবং সেই সঙ্গে সুখী ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ি।
লেখক: ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি