
যার মাধ্যমে প্রাণীর আচরণের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন হয় তাই শিক্ষা। এরই মাধ্যমে প্রাণী শ্রেষ্ট থেকে শ্রেষ্টতর হয়ে ওঠে। শিক্ষার মধ্য দিয়েই মানুষ পরিবারে, দলে, সমাজে, রাষ্ট্রে কিংবা বিশ্বগ্রামে বসবাসের উপযোগী হয়। এই শিক্ষা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে জড়িত থাকে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, পরিবার, সরকার বা রাষ্ট্র এবং পরিবেশ।
পৃথিবীর সম্মানিত ব্যক্তিদের মধ্যে সবার ওপরে থাকে শিক্ষক। তাদের সবাই অনুকরণ, অনুসরণ করতে চাই। তাদেরকেই আদর্শ হিসেবে মানে সবাই। দেশের জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করে শিক্ষক সমাজ। সুশৃঙ্খল ও দক্ষ জনশক্তি তৈরির মাধ্যমে শিক্ষক একটি উন্নত জাতি গঠন করে। আমরা প্রতিটা মুহূর্তে কারো না কারো কাছ থেকে কিছু না কিছু শিখি। সেই হিসেবে অনেকেই আমাদের শিক্ষক।
প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি না পেলেও মা পৃথিবীর শ্রেষ্ট শিক্ষক। তবে আমার আজকের লেখায় আমি কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকের কথাই বলবো। সাধারণত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নির্দিষ্ট যোগ্যতা সম্পন্ন লোকদের নির্দিষ্ট বেতন কাঠামোর আওতায় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষাদান কাজে কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরাই আনুষ্ঠানিক শিক্ষক। স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানে নিয়োজিত ব্যক্তিরা। বিভিন্ন চাকরিতে যোগদানের পর বুনিয়াদি কিংবা নতুন জ্ঞানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে হয়।
সেখানেও শিক্ষকরা কাজ করেন। এই শিক্ষকতা পেশা হলো পৃথিবীর সেরা পেশা। সেরা পেশার সেরা মানুষটি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কেবল সার্টিফিকেট কিংবা জ্ঞান যাচাই পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগদান যথেষ্ট নয়। সঙ্গে থাকতে হবে নৈতিকতা যাচাইয়ের উত্তম পদ্ধতি যার নির্দিষ্ট মান বজায় রাখতে না পারলে সে কখনো শিক্ষকতার চাকরিতে নিয়োগ পাবার যোগ্যতা অর্জন করবে না।
আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান তিনটি স্তরের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রাথমিক স্তর। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষককে হতে হবে সবচেয়ে দক্ষ, স্মার্ট, জ্ঞানসমৃদ্ধ, স্বদালাপী, সদাহাস্য, আন্তরিক ও ঠান্ডা মাথার মানুষ। এই মানুষগুলো তাদের পেশাকে নিতে হবে ব্রত হিসেবে। অন্য স্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠদানের ছেয়ে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠদান তুলনামূলক জঠিল।
কারণ, এই স্তরের শিশুদের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অত্যন্ত সক্রিয় থাকে। তাদের পাঠদানের সময় প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিশেষ করে হাত-পা, চোখ-মুখ এবং মনকে এক কেন্দ্রে নিবদ্ধ করার ব্যবস্থা করতে হয়। এসব সতেজ ও নিষ্পাপ শিশুকে শিক্ষা দেয়ার জন্য দরকার একদল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। তাদের মনে লালিত থাকবে একটি স্বপ্ন, যা হবে এসব শিশুকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। নিজেদের উৎসর্গ করে শিশুদের গড়ে তুলবে যে মানুষগুলো তাদের চাকরির আর্থ-সামাজিক মর্যাদা হতে হবে অত্যন্ত উঁচু।
জাতীয় শিক্ষক নিয়োগ কমিশনের মাধ্যমে একটি সমন্বিত প্রক্রিয়ায় প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত একই বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে শিক্ষক নিযোগ হবে। প্রাথমিকের শিক্ষকের ন্যূনতম যোগ্যতা ডিগ্রি পাস এবং মাধ্যমিকের শিক্ষকের ন্যূনতম যোগ্যতা মাস্টার্স। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে বিজ্ঞপ্তি হবে।
শিক্ষক হবার জন্য আগ্রহী ব্যক্তিরা কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদন ও সিভি জমা দেবে। এতে উল্লেখ থাকবে কোন স্তরে শিক্ষক হতে চাই অথবা উন্মুক্ত। যোগ্যতা, দক্ষতা ও নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল অনুসারে কর্তৃপক্ষ যে স্তরে নিয়োগ দেন সে স্তরে শিক্ষকতা করতে সম্মত। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত (সিইনএড, বিএড বা এমএড), উচ্চতর ডিগ্রি (এমফিল বা পিএইচডি) সম্পন্ন কোনো ব্যাক্তি প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্তরে কাজ করতে চাইলে তাকে অধিকতর প্রণোদনা দিয়ে ধরে রাখতে হবে।
প্রাপ্ত সিভিগুলো যাচাই-বাছাই করে যোগ্য সবাইকে একটা অভিন্ন প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হবে। যেখানে নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে। তিন বা চার মাসের প্রশিক্ষণকালীন ধারাবাহিক আচরণগত মূল্যায়ন ও প্রশিক্ষণের পর একাডেমিক অর্জিত জ্ঞানের মাত্রা, প্রযোগে দক্ষতা, নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধসহ সবকিছু মূল্যায়নের যথাযথ ব্যবস্থা থাকবে। উক্ত মূল্যায়নের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে সবচেয়ে মেধাবীদের নিয়োগ দেয়া হবে প্রাথমিক স্তরে। তারপর অন্য স্তরে। তবে কেউ যদি ভালো ফলাফল করা সত্বেও অন্য স্তরে শিক্ষকতা করতে চাই সে সুযোগ থাকবে। প্রশিক্ষণে যারা ৫০ শতাংশএর কম নম্বর পাবে তারা শিক্ষকতায় সুযোগ পাবে না। তবে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহনকারী হিসেবে একটি সনদ পাবে, যা অন্য চাকরিতে আবেদনের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে কাজ করবে। মেধাবী ও নৈতিকতা সম্পন্ন শিক্ষকের মায়াবী ছোঁয়াতে শিশুগুলোর ভিত্তিটা মজবুত হবে, যার ওপর দাড়িয়ে সে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখবে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো করতে পারলে ভালো হতো। সেটা যতোদিন না হচ্ছে ততোদিন জাতীয় বেতন কাঠামো যেভাবে আছে সেখানেই একটু সংস্কার হোক। শিক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক পর্যন্ত যেখানেই কাজ করুক না কেনো যোগ্যতা অনুসারে বেতন স্কেল পাবে। যেমন মাস্টার্স পাস কোনো ব্যক্তি যদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন তাহলে তিনি প্রথম শ্রেণির (নবম গ্রেড) স্কেল পাবেন। ডিগ্রি পাস হলে পাবে দ্বিতীয় শ্রেণির (দশম গ্রেড) স্কেল পাবেন। এমফিল বা পিএইচডি ডিগ্রিধারী কোনো ব্যাক্তি প্রাথমিকে শিক্ষক হিসেবে কাজ করলে তিনি অধিকতর উচ্চতর স্কেল পাবেন। যদি এ রকম হয় তাহলে দেশের সব চেয়ে যোগ্য ও মেধাবী যুবকটি প্রাথমিকের শিক্ষক হতে আগ্রহ প্রকাশ করবেন। তখনই শিক্ষার ভিত্তিটা মজবুত ও টেকসই হবে। একই যোগ্যতা (মাস্টার্স) থাকা সত্বেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করলে বেতন স্কেল ১৩তম গ্রেড আর কলেজে যোগদান করলে বেতন ৯ম গ্রেড।
আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি দেখেছি কলেজে শিক্ষকতার চেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা অনেক বেশি সময় সাপেক্ষ, কষ্টসাধ্য ও জবাবদিহীতামূলক। সেই কারণে প্রাথমিকে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর বেতন কম হওয়ার কারণে অন্যত্র চলে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকেন। একটা প্যানেলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে একটা উপজেলায় আমরা চারজন যোগদান করে ছিলাম। দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে চারজনের কেউ সেখানে নেই। আরেকটা প্যানেলে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে একই উপজেলায় আমরা তিন জন যোগদান করেছিলাম। এক বছরের মধ্যে আমরা দুইজনের একজন গ্লাসগোতে সহকারী কেমিস্ট হিসেবে আরেকজন এমপিওভুক্ত কলেজের প্রভাষক হিসেবে চলে গেছেন। আমি নিজে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতাকে খুব উপভোগ করছিলাম। সেখানে শিক্ষার্থীদের নির্ভেজাল আন্তরিকতা, অকৃত্রিম সম্মান ও প্রাণবন্ততায় আমি খুব মুগ্ধ। কিন্তু বেতন কম, সামাজিক মর্যাদা কম, বিয়ের বাজারে আকর্ষণ কম ইত্যাদি কারণ দেখিয়ে পরিবারের বড়রা চাপ দিলে ওই চাকরি ছাড়তে বাধ্য হই। ডিগ্রি বা মাস্টার্স পাস করা একজন সহকারী শিক্ষক বেতন পান মাসিক সাকুল্যে মাত্র ১৭ হাজার ৯৫০ টাকা অথচ ২০২৩-২৪ খ্রিষ্টাব্দের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় মাসিক ২৭ হাজার ৮৪০ টাকা। গড়ে মাথাপিছু আয় থেকে জাতি গড়ার প্রধান কারিগরের মাসিক আয় প্রায় ১০ হাজার টাকা কম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পাঠদান কর্মসূচির বাইরে আরো অনেক ধরনের কাজ করতে হয়। তাদেরকে খবরদারি বা তদারকি করার জন্য অফিসিয়াল কর্মকর্তা ছাড়াও রিকশাওয়ালা, দোকানদার থেকে শুরু করে মেম্বার-চেয়ারম্যান সবাই ব্যস্ত থাকেন। এমন পরিস্থিতিতে সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরা সুযোগ পেলেই ভালো বেতনের অন্য চাকরিতে চলে যায়। এতে ঘন ঘন শিক্ষক পদ শূন্য হয়ে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ব্যাঘাত ঘটে।
আর্থিক মর্যাদা বাড়ালে সামাজিক মর্যাদা বাড়বে। এতে অধিকতর যোগ্য লোকেরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আসবে। জাতির ভিত্তি শক্ত হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ফতেয়াবাদ সিটি করপোরেশন ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম